ঢাকা   শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১   বিকাল ৪:২২ 

Home Blog Page 173

হাইকোর্টের নির্দেশনা দ্রুত কার্যকর হোক

0

র‍্যাগিংবিরোধী কমিটি
রাষ্ট্রের অব্যাহত নীরবতার প্রেক্ষাপটে হাইকোর্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিংবিরোধী কমিটি গঠন করতে একটি যথার্থ নির্দেশনা দিয়েছেন। র‍্যাগিং ও বুলিয়িং কমবেশি বেদনাদায়ক বৈশ্বিক প্রবণতা। এটা মানবাধিকারের লঙ্ঘনও বটে।

বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ডের পর এটা আশা করা স্বাভাবিক ছিল যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজ গরজে র‌্যাগিংবিরোধী কমিটি করবে। কিন্তু তারা তা করেনি। বরং ছাত্ররাজনীতি–বিষয়ক বিতর্কে অংশ নিতে কার্যত তাদের অনেককে উৎসাহী দেখা গেছে। গত ৯ অক্টোবর রিটকারী সাত দিন সময় দিয়ে সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিশ দেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। আইনি নোটিশ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

আমরা আশা করব, আবরার হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে হাইকোর্ট আগামী তিন মাসের মধ্যেই কমিটি গঠনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা তামিল হোক। এই বিষয়ে যেকোনো ধরনের কালক্ষেপণ অমার্জনীয় বিবেচিত হওয়া উচিত। কারণ, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে একইভাবে হাইকোর্ট কমিটি করতে বলেছিলেন। কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেই কমিটি গঠিতই হয়নি। আবার কোথাও গঠিত হলেও তা কাগজে-কলমে রয়ে গেছে। এই মনোভাব পরিহার করতে হবে।

এই জনগুরুত্বসম্পন্ন মামলাটির শুনানি যাতে দ্রুত সম্পন্ন হয়, সে জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা প্রত্যাশিত। কারণ, তাঁর দপ্তর তৎপর না হলে প্রস্তাবিত কমিটি গঠন প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাবে। আমরা তখন দেখব, রাষ্ট্রপক্ষ রুটিনমাফিক সময় বাড়ানোর দরখাস্ত হাতে হাজির হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রসচিব, শিক্ষাসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানসহ বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। তঁারা এই বিষয়ে প্রতিবেশী ভারতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০০১ সালে র‍্যাগিংবিরোধী নীতিমালা জারি করেন। তবে বুয়েটের ঘটনায় আমরা ২০০৯ সালে হিমাচল প্রদেশের উদাহরণটিকে সব থেকে প্রাসঙ্গিক মনে করি। সেখানে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ুয়া নবাগত শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় তাঁর চার অগ্রজ ছাত্রের মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি কলেজের অধ্যক্ষ, যাঁর কাছে নিহত ছাত্রটি অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি, তঁাকে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে হয়েছে। বুয়েটের ঘটনায় ভিসির অপসারণের দাবি অপূর্ণই থেকেছে।

র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই বাদী হয়ে থানায় এজাহার দায়ের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ২০০৭ সালে ভারতের রাঘবন কমিটির কিছু পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। তারা বলেছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সহশিক্ষা কার্যক্রমের ঘাটতি র‍্যাগিং বাড়ার জন্য দায়ী। এ ধরনের অপরাধ কমাতে নবাগত ও জ্যেষ্ঠদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি, আবাসন সংকট দূর, ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা ছাত্রাবাসগুলোর নিবন্ধন ও তদারকি দৃঢ় করা প্রয়োজন। এসব আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেও প্রযোজ্য। ভারত আমাদের ৯৯৯–এর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা র‍্যাগিংবিরোধী বিশেষ সেল খুলেছে। এ ধরনের সেল খোলা থাকলে তা র‍্যাগিং বা যৌন হয়রানি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে।

তবে সার্বিক বিচারে জনস্বার্থে করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক সৃষ্ট আইন বা নীতিমালা অনুসরণে আমাদের দেশের রেকর্ড প্রীতিপ্রদ নয়। এটা অনিচ্ছুক ঘোড়াকে পানি খাওয়ানোর মতো একটি বিষয়। আমরা মনে করি, সংসদের চলতি অধিবেশনে নির্দিষ্টভাবে র‍্যাগিংবিরোধী নির্দিষ্ট আইন করার বিষয়টি আইনপ্রণেতারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে পারেন।

যদি এমনটা প্রতীয়মান হয় যে, র‍্যাগিং বা বুলিংয়ের সঙ্গে জড়িতরা ক্যাম্পাসগুলোতে বোধগম্য কারণে প্রভাবশালী, তাহলে সংসদীয় আইন শ্রেয়তর। এটি সংশ্লিষ্টদের প্রতি বেশি জোরালো বার্তা পৌঁছাবে।

সৌজন্যে: প্রথম আলো

আইডিয়ালের অধ্যক্ষ শাহানার এমপিও স্থগিতের আদেশ হাইকোর্টে স্থগিত

0

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের এমপিও স্থগিতের আদেশ স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতিঝিল, বনশ্রী ও মুগদা শাখায় ২০১৮ সালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় ওই এমপিও স্থগিত করেছিলো মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের এই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়। ওই রিটের শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি সরদার রাশেদ মো. জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের অবকাশকালীন ডিভিশন বেঞ্চ আজ রবিবার ওই স্থগিতের আদেশ দেন। তবে হাইকোর্টের এই আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিনউদ্দিন মানিক।

গত ২২ অক্টোবর শাহান আরা বেগমের এমপিও সুবিধা স্থগিত করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। এ সংক্রান্ত স্মারকে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগমের বিরুদ্ধে বর্ণিত প্রতিষ্ঠানের মতিঝিল, বনশ্রী এবং মুগদা শাখায় ২০১৮ সালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ এর ১৮(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার এমপিও স্থগিত করার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে (মাউশি) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়। আবেদনের পক্ষে আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান শুনানি করেন। শুনানি শেষে এমপিও স্থগিতের ওই স্মারক কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষিত হবে না তাও জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট।

সৌজন্যে: দৈনিক ইত্তেফাক

মামলাজট নিরসনে দ্রুত পাঁচ হাজার বিচারক নিয়োগ দিতে হবে

0

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন, গত ১১ বছরে বিচার বিভাগের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো প্রশংসনীয়। তবে বিচারাধীন মামলাজট কমাতে না পারাটা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ। তাই বিচার বিভাগের চলমান মামলাজট নিরসনে যত দ্রুত সম্ভব অন্তত পাঁচ হাজার বিচারক নিয়োগ দিতে হবে।

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, আমাদের দেশের বিচার বিভাগের মামলা নিষ্পত্তির হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ভালো। মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা কম হওয়ায়ই মামলাজট বাড়ছে। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগের হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩২ কোটি মানুষের জন্য ৮৬ হাজার বিচারক ছিল। এখন হয়তো এটা আরও বেড়েছে।

সে হিসাবে আমাদের দেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য ৪৩ হাজার বিচারক থাকার কথা। আমাদের ১৬ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ১৭০০ থেকে ১৮০০ বিচারক কাজ করছেন। সে তুলনায় আমাদের বিচারকরা অনেক পরিশ্রম করছেন। ফলে মামলাজট দূর করতে আমাদের এই মুহূর্তে অন্তত পাঁচ হাজার বিচারক প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, আমি জেনেছি, বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু আছে। হয়তো কিছু দিনের মধ্যেই আমরা সর্বমোট ২ হাজার বিচারক পাব। তিনি আরও বলেন, বিচারক নিয়োগের পাশাপাশি বিচারকদের লজিস্টিক সাপোর্টটাও জরুরি। প্রতিটি বিচারকের জন্য পাঁচ-ছয়জন স্টাফ প্রয়োজন। এজলাস সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা খবর পাই এখনো কোনো কোনো আদালতে বিচারকরা ভাগাভাগি করে এজলাসে ওঠেন। তাই প্রয়োজনীয় এজলাস বৃদ্ধিতেও সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।

মামলাজট নিরসনে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেহেতু চার-পাঁচ হাজার বিচারক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, এই সময় তো আর বিচার প্রার্থীরা বসে থাকবেন না। তাই অবসরে যাওয়া বিচারকদের মধ্যে যারা এখনো সক্ষম তাদের পরীক্ষামূলকভাবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে যেসব জেলায় মামলা বেশি ওই জেলাগুলোতে।

উচ্চ আদালতের মামলাজট প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা দেখছি উচ্চ আদালতে যত বিচারপতি নিয়োগ হচ্ছে মামলাজট তত বাড়ছে। তাই হাই কোর্টের বিচারপতিদের উচিত হবে, যে কোনো রুল ইস্যুর আগে আবেদনটির অন্তত ৫০ শতাংশ মেরিট আছে কি-না, তা নিশ্চিত হওয়া। ৫০ শতাংশ মেরিট না থাকলে আবেদনটি নট প্রেস না করে রায় দিয়ে ডিসমিস করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি রুল জারি করা মানে, নতুন একটি মামলা হওয়া। আর হয়রানিমূলক মামলা করলে পিটিশনারকে জরিমানা করার পাশাপাশি আইনজীবীকে তিরস্কার করার ব্যবস্থা হলেও মামলাজট কমবে বলে মনে করেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি।

‘আইন পেশা শুধুই টাকা উপার্জনের পেশা নয়’

0

অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং সাবেক সংসদ সদস্য। আইন পেশায় অর্ধশতাব্দী কাটানো এই বিশিষ্ট আইনজীবীর জীবনের নানা গল্প উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে

ছোটবেলা কেমন কেটেছে?
বাড়ি ভোলা জেলার দৌলতখান (তৎকালীন রাধাবল্লভ) উপজেলার কালিয়া গ্রামে হলেও আমার জন্ম বরিশাল শহরেই। ১৯৩৬ সালের ১৪ নভেম্বর, বুধবার। আমাদের গ্রাম, বাপ-দাদার ভিটা মেঘনা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বহু আগেই। বাবা আলহাজ মোবারক আলী ছিলেন বরিশাল বারের (আইনজীবী সমিতি) প্রখ্যাত আইনজীবী। মা শামসুন্নাহার বেগম। বাবার কারণেই শহরে থাকা। বরিশাল জিলা স্কুলে লেখাপড়া করেছি। আমরা ৯ ভাই, চার বোন। প্রথমে চার ভাই, এরপর আমি। এরপর আবার চার ভাই। এরপর বোনেরা। বাবা আমাকে আদর করে ‘লকেট’ নামে ডাকতেন।

পরিবারের বিশেষ স্মৃতি?
ভাই-বোন বেশি হওয়ার কারণে নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো অনেক ঘটনা ঘটত। তবে বড় দুই ভাইয়ের সংস্পর্শে সারাক্ষণ থাকার সুযোগ ছিল না। কারণ তাঁরা কলকাতায় চাকরি করতেন। তাই আমার পিঠাপিঠি বড় ভাই আর আমি একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। মা তাঁকে বেশি আদর করতেন। আর বাবা আমাকে। সাধারণত মায়ের কাছে ছেলে আর বাবার কাছে মেয়েরা আদরের হয়। আমার ক্ষেত্রে উল্টো। আমরা যখন খেতে বসতাম, মাকে বাবা বলতেন, ‘ওকে (আমাকে) আরেকটু খাবার দাও।’ মা বলতেন, ‘খালি ওর কথাই বলবা? ও তো তোমার কলিজার টুকরা!’ বড় ভাই কিছু বলতে পারতেন না। পরবর্তীকালে দেখেছি, আমার সংসারে বিষয়টি গতানুগতিক। মেয়েটা আমার, আর ছোট ছেলে তার মায়ের ভক্ত। গত ২৬ অক্টোবর ভোরে ছোট ছেলেটা আমেরিকায় ফিরে গেল। যাওয়ার সময় তার মায়ের যে কী চেহারা! তা দেখে ছেলেকে বললাম, ‘এটা ভিডিও করে রাখো। কয়েক দিন পর আমি আরেকটি ভিডিও পাঠাব। দুটি মিলিয়ে দেখো!’ আমার মেয়ে আমেরিকায় একটি ব্যাংকে চাকরি করে। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার আগে আর অফিস থেকে ফিরে আমাকে ফোনে কল করে।

বাবার স্মৃতি?
বাবার সিভিল ল ইয়ার হওয়ার পেছনে একটি ইতিহাস আছে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে বরিশাল জেলা জজ আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। তখন বরিশালসহ সারা দেশে হিন্দুরাই একচেটিয়াভাবে (প্রায় শতভাগ) সিভিল ল ইয়ার ছিলেন। এখনো সিভিল ল ইয়ারদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যাই বেশি। বাবা যখন বরিশাল বারে যোগ দেন, তখন একজন সিনিয়র আইনজীবী (হিন্দু) ঠাট্টাচ্ছলেই তাঁকে বলেছিলেন, ‘কী! কোন বিষয়ে প্র্যাকটিস করবি? সিভিল, নাকি ক্রিমিনাল? তোরা তো মুছ্লা (মুসলমানদের অনেকেই তাচ্ছিল্য করে এভাবে সম্বোধন করত)! তোরা তো আড়াইখানা বই পড়ে উকিল হস!’ বাবার কাছে এ কথা শুনে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আড়াইখানা বই মানে কী?’ বাবা বলেছিলেন, সিআরপিসি (ফৌজদারি কার্যবিধি) ও পেনাল কোড (দণ্ডবিধি) পুরোটা। আর অ্যাভিডেন্স অ্যাক্টের (সাক্ষ্য আইন) আদ্দেক (অর্ধেক)। ফৌজদারি মামলা করতে এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না। অন্যদিকে সিভিল প্র্যাকটিস করতে হলে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। ওই হিন্দু সিনিয়র আইনজীবীর কথা বাবার মনে দাগ কেটেছিল। খুব মর্মাহত হয়েছিলেন। তাই জেদ করে সিভিল প্র্যাকটিস শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

আপনার শিক্ষাজীবন?
বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিক (এসএসসি) এবং বিএম কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে আইএ (এইচএসসি) ও ১৯৫৮ সালে গ্র্যাজুয়েশন পাস করি। (আমার অনার্স করা হয়নি। কারণ তখন বিএম কলেজে অনার্স ছিল না।) এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হই। থাকতাম এসএম হলে। মাস্টার্সের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এলএলবি সম্পন্ন করি। এরপর আইন পেশায় যোগ দিয়েছি।

বাবার ইচ্ছায়ই আইনজীবী হয়েছেন?
বাবাকে সন্তুষ্ট করতেই আইন পড়েছি। আইনজীবী হিসেবে ১৯৫৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এনরোল্ড (বার কাউন্সিলে তালিকাভুক্ত) হওয়ার পর হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বাবার ইচ্ছায় বরিশাল জেলা জজ আদালতে যোগ দিই। তিনি চেয়েছিলেন আমি যেন তাঁর সঙ্গেই থাকি। এ কারণে তাঁর সঙ্গে একই চেম্বারে কাজ শুরু করি। আমি বরিশাল বারে গিয়েছি ১৯৬৫ সালে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ঠিক ছয় মাস আগে। বাবা সিভিল ল ইয়ার হলেও আমি বরং ফৌজদারি মামলা লড়তাম। হাইকোর্টে এসেছি অনেক পরে। ১৯৯২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য হয়েছি।

ফৌজদারি আইনজীবী হওয়ার কারণ?
যাঁরা সিভিল প্র্যাকটিস করেন, তাঁরা রাজনীতি করতে পারেন না। তা ছাড়া সিভিল প্র্যাকটিসের জন্য প্রচুর লেখাপড়া করতে হয়। অনেক রেফারেন্স দেখতে হয়। প্রিভি কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত জানতে হয়। এত সময় কোথায়? ছাত্র অবস্থায় রাজনীতি করেছি। ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। তখন থেকেই রাস্তায় স্লোগান দেওয়ার অভ্যাস। তাই বরিশালে গিয়ে সেখানকার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। এ কারণে সিভিলে না গিয়ে ক্রিমিনাল প্র্যাকটিস শুরু করি। বিশেষ করে ট্রায়ালে বেশি জোর দিয়েছি।

সরকারি চাকরি করেননি কেন?
সে সময় সিভিল সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হই। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করার পর পুলিশ ভেরিফিকেশন হলো। কিন্তু সক্রিয় ছাত্ররাজনীতি করার কারণে সেই ভেরিফিকেশনে আটকে যাই। আমার আর সরকারি চাকরি করা হলো না।

বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেওয়া আসনে এমপি হয়েছিলেন…
আইন পেশার পাশাপাশি সমানতালে রাজনীতি করেছি। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত তখন বরিশাল শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি। আমি সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমাকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা উঠল। কিন্তু মনোনয়নপত্র না কিনে পালিয়ে গেলাম। আমার ইচ্ছা ছিল রাষ্ট্রদূত হওয়ার। যা হোক, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু চারটি আসনে নির্বাচন করেন। এর মধ্যে দুটি গোপালগঞ্জ, একটি ভোলা, আরেকটি ঢাকার মিরপুরে। চারটি আসনেই তিনি নির্বাচিত হলেন। এরপর ভোলার আসন ছেড়ে দিলেন। সেখানে উপনির্বাচনে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হলো। এমপি হলাম। মিরপুর আসনের উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হলো ড. কামাল হোসেনকে। আমার রাষ্ট্রদূত হওয়ার ইচ্ছা ছিল বিদেশে ঘুরতে পারব বলে। কিন্তু তা আর হলো না। নির্বাচনের প্রস্তাব পাওয়ার স্মৃতি এখনো মনে আছে। তখন তো মোবাইল টেলিফোন সেট ছিল না।

একদিন বরিশাল কোর্টে মামলা লড়ছি, এমন সময় জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে একজন এলেন। এরপর কিছু না বলে কোর্ট থেকে নেমে গেলেন বিচারক। মিনিট পাঁচেক পর আমাকে খবর দিয়ে বললেন, ‘ডিসি অফিসে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে ফোন এসেছে।’ তখন প্রধানমন্ত্রীর পিএস (একান্ত সচিব) ছিলেন রফিকুল্লাহ চৌধুরী। জাতীয় সংসদের বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর পিতা। ফোনে সংবাদ পেয়ে আমি ঢাকায় চলে এলাম। গেলাম প্রধানমন্ত্রীর (বঙ্গবন্ধু) বাসায়। এখনো মনে আছে, বঙ্গবন্ধু সোফায় বসা। আমাকে দেখেই বুড়ো আঙুল নাচাতে নাচাতে, হাসতে হাসতে বললেন—‘হলো না, হলো না, হলো না!’ আমি ভয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বয়স কম। কী বলব, বুঝতে পারছি না। তিনি নিজেই বললেন, ‘অ্যাম্বাসাডর হওয়া হলো না তোর!’ আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কাছে আয়। ভোলায় আমার সিটে তুই ছাড়া কে? অ্যাম্বাসাডর হওয়ার চিন্তা বাদ দে। পার্লামেন্টে আসতে হবে।’ এটা আমার জীবনের স্মরণীয় দিন।

দালাল-রাজাকারদের বিচারের জন্য আপনাকে পিপি নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল…
দেশ স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর অনেক দালাল, রাজাকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একদিন বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে বরিশালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) হওয়ার প্রস্তাব দিলেন। আমি মন থেকে সায় না পেলেও ভয়ে কিছু বলতে পারছিলাম না। বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেব? সাহস কোথায়! তবে আকারে-ইঙ্গিতে বোঝাতে চাচ্ছিলাম, আমি রাজি নই। আমতা আমতা করে বললাম, ‘একাত্তরে তো আমার বাসা লুট হয়ে গেছে। কিছু নেই। থাকার সমস্যা…!’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দেখ, জীবনে অনেক টাকা কামাই করতে পারবি। দালাল-রাজাকারদের বিচার করতে হবে। এই দায়িত্ব আর কারে দেব?’ কী আর করা? বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। আমাকে পিপি করা হলো। বরিশাল বারেই থেকে গেলাম। পরবর্তীকালে ১৯৮৩ সাল থেকে শুরু করে পর পর তিনবার বরিশাল বারের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। এর পরও আমাকে সেই পদে দাঁড়াতে বলা হয়েছিল। নতুনদের সুযোগ দেব বলে রাজি হইনি।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশেষ স্মৃতি?
১৯৭০ সালে তিনি আমার বাসায় এসেছিলেন। আগে এত সড়কপথ ছিল না। ঢাকা থেকে ‘রকেট’ নামে একটি স্টিমার খুলনায় যেত (এখনো যায়)। সেটা পিরোজপুর-বরিশাল হয়ে খুলনায় যেত। সেই স্টিমারে বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বরিশাল আসতেন। কারণ তাঁর সেজো বোন আমেনা বেগমের বিয়ে হয়েছে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সঙ্গে। ঢাকা থেকে স্টিমারে হুলারহাট নামতেন বঙ্গবন্ধু। সেখান থেকে টুঙ্গিপাড়া। আবার টুঙ্গিপাড়া থেকে বরিশাল হয়ে ঢাকা ফিরতেন। এই স্টিমারে তাঁর সফরসঙ্গী হয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। আমাকে অনেক স্নেহ করতেন।

১৯৭৩ সালে বরিশালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালন করেছেন?
তখনো আমরা জানি না বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন কবে। আমার কন্যা তখন কলেজে পড়ে। আমার মামা মহিউদ্দিন আহমেদও ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বরিশালে এসেছেন। সেরনিয়াবাতের বাসায় উঠেছেন। তাঁর আসার খবর পেয়ে আমার মেয়ে ও মামাতো বোন শাম্মীসহ (আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদিকা ড. শাম্মী আহমেদ) কয়েকজন মেয়ে হাজির। সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসার কাছেই আমার বাসা। কালীবাড়ি রোড। তারা বাসায় গেলে বেগম সেরনিয়াবাত সবাইকে বললেন, ‘তোমরা কি জানো আজ (১৭ মার্চ) খোকা ভাইয়ের জন্মদিন?’ বঙ্গবন্ধুর ডাকনাম ছিল খোকা। এই কথা শুনে মেয়েদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। আমরা এর কিছুই জানি না। আমরা বেলপার্কে জনসভা নিয়ে ব্যস্ত। বরিশালে বেল সাহেব নামে এক জেলা প্রশাসক ছিলেন, তাঁর নামেই নামকরণ। পরে সেটির নাম ‘বঙ্গবন্ধু উদ্যান’ করা হয়েছে। একটু দূরেই কীর্তনখোলা নদী। মার্চ মাস। বসন্তের বাতাস আসছে দক্ষিণ দিক থেকে। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে বসা। চুরুট খাচ্ছেন। পাশে বসা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত। পাশে বসার সাহস পাইনি বলে আমি পেছনে বসেছি। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা সেখানে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা…’ গানটি গাইল। পেছনে বসেই শুনতে পেলাম, সেরনিয়াবাত সাহেবকে বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘টেপু, এই গানটিতে বাংলার রূপ অনেক বেশি প্রকাশ পেয়েছে। গানটি আমি কাজে লাগাব।’ তখনই জানলাম, সেরনিয়াবাত সাহেবের ডাকনাম টেপু। পরে গানটিকে বঙ্গবন্ধু ঠিকই কাজে লাগান। এই গান এখন সামরিক বাহিনীতে গাওয়া হয়। যা হোক, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের কথা জেনে সে সময় মেয়েরা বরিশাল শহর থেকে কিভাবে যেন একটা কেক জোগাড় করল। আমরা জনসভা শেষে সার্কিট হাউসে এলাম। বঙ্গবন্ধু আগেই ফিরেছেন। ভেতরে ঢুকব, এমন সময় তিনি বললেন, ‘স্টপ। কেউ ঢুকবে না।’ ঘাবড়ে গেলাম। আমাদের সঙ্গে সেরনিয়াবাত সাহেবও ছিলেন। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আসো।’ আমরা ঘরে ঢুকলাম। দেখি টেবিলের ওপর কেক। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমরা আমার খোঁজ রাখো না। কিন্তু আমার স্নেহের মেয়েরা ঠিকই খবর রেখেছে। আসো, কেক কাটি।’ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উদ্‌যাপনের সেই ঘটনা আমার জীবনের একটি মধুর স্মৃতি।

কোনো দুঃখময় স্মৃতি?
বিশ্বাসঘাতক কী জিনিস, তা নিজের চোখে দেখেছি। আগেও বিশ্বাসঘাতকের ব্যাখ্যা শুনেছি, ইতিহাসের পাতায় পড়েছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তাঁদের দু-একজনকে চোখের সামনে দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় ১৯৭৫ সালের ১০ আগস্ট। আমি বরিশাল থেকে মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসতাম। সেদিন সন্ধ্যায় গণভবনে গেলাম। মন্ত্রী সোহরাব হোসেনসহ আরো অনেকেই ছিলেন সেখানে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন না। তিনি তখনকার শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীকে নিয়ে বাইরে হাঁটতে গেছেন। এরই মধ্যে বাকশাল হয়ে যাওয়ায় সারা দেশে গভর্নর নিয়োগ চলছে। আমার পাশে বসা সোহরাব ভাইকে বললাম, ‘আমাকে ভোলার গভর্নর হতে বলা হচ্ছে। ভাই, আমি গভর্নরের মধ্যে নাই! ভোলায় যাবে কে?’ এমন সময় বঙ্গবন্ধু এলেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘কিরে বাদশা হুমায়ুন! কেমন আছিস? কবে আসছিস?’ বঙ্গবন্ধু আমাকে মাঝেমধ্যে বাদশা হুমায়ুন বলে ডাকতেন। বললাম, ‘পরশু।’ এই সময় সোহরাব উদ্দিন বললেন, ‘লিডার, সে তো গভর্নর হতে চায় না।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তাই নাকি?’ আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কী বলব?

এরই মধ্যে সেখানে এলেন তখনকার তথ্যমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর। তিনি ঢুকেই নিলডাউনের মতো করে বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে বসে পড়লেন। ভাগ্য ভালো আমার। বঙ্গবন্ধুর মনোযোগ চলে গেল তাঁর দিকে। আমি বেঁচে গেলাম। যা হোক, বঙ্গবন্ধুর হাতে একটা ছড়ি থাকত। সেই ছড়ি তাহের উদ্দিন ঠাকুরের পিঠের ওপর রেখে তিনি বললেন, ‘কিরে? কী হয়েছে?’ তাহের উদ্দিন ঠাকুর বললেন, ‘নয়ারহাট বেতার কেন্দ্র (সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত) উদ্বোধন হবে। আমি তো সবাইকে বলে ফেলেছি, বঙ্গবন্ধু এটা উদ্বোধন করবেন। আপনাকে যেতেই হবে।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘না। আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না। আমি এখন রাষ্ট্রপতি। সব অনুষ্ঠানে আমার যাওয়া ঠিক না।’ তাহের উদ্দিন ঠাকুর নাছোড়বান্দার মতো অনুরোধ করতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু রাজি হলেন। তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যা।’ এই ছিল তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক। অথচ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের একজন এই তাহের উদ্দিন ঠাকুর। তিনি জানতেন মাত্র পাঁচ দিন পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে!

আইন পেশায় অর্ধশত বছরের অভিজ্ঞতাকে কিভাবে দেখেন?
আমার জীবনটাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একটি আইনজীবী, আরেকটি রাজনীতিবিদ হিসেবে, অন্যটি সামাজিকভাবে। আইন পেশায় ৫০ বছর হয়ে গেছে। জীবনের প্রথম দিকে জেলা জজ আদালতের আইনজীবী ছিলাম। সে কারণে মামলায় জেরা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এমন অভিজ্ঞতা সব আইনজীবীর থাকে না। এই অভিজ্ঞতার কারণে ওয়ান-ইলেভেনের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলায় তাঁর পক্ষের আইনজীবী ছিলাম। ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, ড. তৌফিক নেওয়াজ ছাড়াও অনেক নামিদামি আইনজীবী আইনগত বিষয়গুলো দেখতেন। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতেন। সাক্ষীকে জেরা করার ভার ছিল আমার এবং সৈয়দ রেজাউর রহমানের ওপর। সুপ্রিম কোর্টে আমি রিট ও ফৌজদারি মামলা লড়ি। কিছু কিছু সিভিল মামলাও লড়ি। অবশ্য কম্পানিসংক্রান্ত মামলার কিছুই বুঝি না। তাই সে ধরনের মামলা লড়ি না।

১৯৯২ সালে বরিশাল ছেড়ে একেবারে হাইকোর্টে চলে এসেছিলাম মূলত সাবেক রাষ্ট্র্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মামলা লড়ার জন্যই। আগে প্রয়াত সিরাজুল হক সাহেব এরশাদের মামলা লড়তেন। তিনি ছেড়ে দিলেন। এরপর এরশাদ সাহেবের এক ভায়রা আমাকে সেসব মামলা লড়ার প্রস্তাব দিলেন। এরশাদের সঙ্গে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। ভাবলাম, একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির মামলা লড়ার অভিজ্ঞতা হোক।

আপনার দেখা বিচার বিভাগের সেকাল-একাল?
বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষা করা সবারই দায়িত্ব। কিন্তু বিচার বিভাগ এবং আইনজীবীদের প্রতি সম্মান দেখানো এখন অনেক কমে গেছে। আমরা (অপেক্ষাকৃত জুনিয়র আইনজীবীরা) সিনিয়রদের যেভাবে সম্মান দেখাতাম, এখন আর সেই চর্চা নেই। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে গেলে দেখতে পাবেন, সামনের সোফায় জুনিয়র আইনজীবীরা বসে আছে। সিনিয়ররা ঢুকলেও আসন ছাড়ছে না। আইনজীবীদের মধ্যে এভাবে অবক্ষয় হয়েছে। আরেকটি জিনিস লক্ষ করবেন, আইনজীবী হিসেবে পেশা শুরু করেই টাকার প্রতি নেশা হওয়া। তাদের কথা হলো, যোগদান করেই টাকা কামাতে হবে। শেখার দরকার নেই! এটা কিন্তু আমাদের সময় ছিল না। আমরা সিনিয়রদের কাছে যেতাম। তাঁরা যদি টাকা দিতেন, নিতাম। না দিলেও কিছু বলতাম না। এখন ঠিক উল্টোটা ঘটছে। জুনিয়ররা মক্কেলের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে টাকা নিচ্ছে।

শুধুই আইনজীবী নয়, বিচারপতি বা বিচারকদের মধ্যেও অবক্ষয় হয়েছে। তখন উচ্চ আদালতের বিচারকদের সম্পর্কে কোনো মন্দ কথা চিন্তাও করা যেত না। নিম্ন আদালতেও কোনো দিন এমন কিছু শুনিনি। এখন তো অনেক কথাই শোনা যায়। উচ্চ আদালতের তিনজন বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। অনুসন্ধান চলছে। তাঁদের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এ ধরনের খবর আমাদের জন্য দুঃখজনক।

এ থেকে উত্তরণের উপায়?
হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ করা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। যাঁরা নিয়োগ পান, তাঁরা ভাবেন তাঁদের পেছনে সরকার আছে। শুধু এই একটিই কারণ নয়। মূল কারণ নৈতিক অবক্ষয়। নৈতিকতা ঠিক থাকলে কারো পক্ষে এমন কিছু ভাবা সম্ভব নয়। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের আইন নেই। আমাদের সংবিধানে আইন করার কথা থাকলেও তা হয়নি। আইন করার সমস্যাও আছে। সরকারি দল সমর্থক আইনজীবীদের মধ্য থেকে বাধা আসে। আইন হলে তো কম যোগ্যতাসম্পন্ন, জুনিয়রকে বিচারক বানানো যাবে না। আমি বলব, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর নয়। এটা এখনই বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ করা হলেও সবার আগে সততা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতা দেখতে হবে। শুধু বার কাউন্সিলের সনদ পেলেই হবে না। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রশাসনিকভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সেখানে নৈতিকতা, সততা ও পেশার প্রতি নিষ্ঠার বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। এই প্রশিক্ষণ কোর্সের সনদ পাওয়ার পরই শুধু আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় বসতে পারবে। এমন ব্যবস্থা করা হলে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হবে।

তরুণ আইনজীবীদের প্রতি পরামর্শ?
আইন পেশা শুধুই টাকা উপার্জনের পেশা নয়। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজকে শান্তিপূর্ণ ও বাসযোগ্য করতে আইনজীবীদের চেষ্টা থাকতে হবে। কিছু মামলা বিনা ফিয়ে লড়তে হবে। উদাহরণ দিয়ে বলি, ফেনীর নুসরাত হত্যা মামলায় একজন আইনজীবী বিনা পারিশ্রমিকে, নিজ উদ্যোগে মামলা লড়েছেন। সব আইনজীবীর মধ্যে এ ধরনের মানসিকতা থাকতে হবে। আরেকটি জিনিস মনে রাখা দরকার, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের ঘটনায় আসামিপক্ষে কোনো আইনজীবীর দাঁড়ানো উচিত নয়। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এ ধরনের অপরাধে আসামিপক্ষে আইনজীবী দাঁড়ানোর প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার। তবে আইন করে নয়, আইনজীবীদের স্বউদ্যোগেই এমনটা করা উচিত। তাহলে একজন অপরাধী এমন অপরাধ করার আগে চিন্তা করবে, তার পক্ষে কোনো আইনজীবীকে পাওয়া যাবে না। আমি নিজেও নৈতিকতার প্রশ্নে অনেক মামলা ফিরিয়ে দিয়েছি।

আপনার ব্যক্তিগত জীবন?
আমার স্ত্রী আফিয়া খাতুন পুরোপুরি গৃহিণী। সে যখন ইডেন কলেজে পড়ত, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। হল থেকে বেরিয়ে আমরা রিকশায় ঘুরতাম। এরপর ১৯৫৯ সালে বিয়ে করেছি। মা-বাবা আপত্তি করেননি। আমাদের দুই ছেলে, এক মেয়ে। ছোট ছেলে আকবর হোসেন জয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করে এখন আমেরিকায় থাকে। মেয়ে সাঈদা পারভীন শম্পা থাকে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে। বড় ছেলে ডা. আফতাব ইউসুফ রাজ স্কয়ার হাসপাতালের শিশুবিষয়ক কনসালট্যান্ট।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

সুপ্রীমকোর্ট দিবসের তাৎপর্য

0

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান:
১৮ ডিসেম্বর তৃতীয়বারের মতো পালিত হচ্ছে ‘সুপ্রীমকোর্ট দিবস’। বরাবরের মতো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এ অনুুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। প্রধান বিচারপতি, আইনমন্ত্রী, সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, সিনিয়র আইনজীবী, সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হবে অনুষ্ঠানটি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টে সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশে ‘ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম প্রতিবছর একটি ম্যাগাজিন বের করেন সংগঠনের পক্ষ থেকে। একবার তাদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘বন্ধন’Ñএ আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল, লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট দিবস’।

দিবসটি পালনের পেছনের কিছু কথা সবার সামনে বলার জন্যই আমার এ লেখা। বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হই ১৯৮৮ সালের ১৮ আক্টোবর। তখন থেকেই জানতে ইচ্ছে হতো- বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট কবে এবং কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়? এই সর্বোচ্চ বিচার প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা যায় কিনা? সময়ের বিবর্তনে এক সময় আমি বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক হিসেবে শপথ গ্রহণ করি। শুরু হয় বিচারক জীবনের যাত্রা। তখন ভাবনাটি আমার মনে আরও প্রোথিত হয়। মনে জাগা প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে আমাদের সংবিধান ও ইতিহাস জানার চেষ্টা করি। যা জেনেছি তার আলোকেই আজ আমার এই কথাগুলো বলা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমি এ বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসন সাহেবকে একটি চিঠি দিয়েছিলাম। তিনি এ নিয়ে চিন্তা করবেন বলেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রধান বিচারপতি থাকাকালে এ বিষয়টি আর এগোয়নি। পরবর্তীতে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা) যখন প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন আমি তাকেও বলেছিলাম বিষয়টি নিয়ে ভাবতে। কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন তিনি আমাকে ও বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে ডেকে পাঠান। প্রধান বিচারপতির খাস কামরার বিপরীতে জজ সাহেবদের বসার জন্য যে ছোট্র লাউঞ্জটি আছে, সেখানে আমি ও এম ইনায়েতুর রহিম পৌঁছে দেখি আপীল বিভাগের বিচারপতি মির্জা হোসাইন হায়দার, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি যথাক্রমে সৈয়দ রেফাত আহম্মেদ ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ অপেক্ষমাণ। আমরা দুজন লাউঞ্জে পৌঁছার পর সকলে একত্রে প্রধান বিচারপতির কক্ষে প্রবেশ করি। প্রধান বিচারপতি আমাদের দুজনের উদ্দেশে বললেন ‘এখন থেকে প্রতিবছর সুপ্রীমকোর্টের পক্ষ থেকে সংবিধান দিবস পালন করার জন্য আমি একটি কমিটি গঠন করেছি। সেটিতে আপনাদের দুজনকে নতুন করে (আমাকে ও বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে) অন্তর্ভুক্ত করে নিলাম। কারণ আপনাদের উভয়েরই বাবা দেশের সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।’ যা হোক, যথারীতি আমরা কাজ শুরু করলাম। কিন্তু এক পর্যায়ে আমরা পাঁচজন একমত হলাম যে, সংবিধান দিবস পালন করাটা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সরকারের পক্ষ থেকে এ উদ্যোগ নেয়া হলে সেটি হবে যথাযথ পদক্ষেপ।
ভারতের সংবিধান দিবস ২৬ নবেম্বর। ১৯৪৯ সালের এ দিনে ভারতীয় গণপরিষদ কর্তৃক তাদের সংবিধান গৃহীত হয়। প্রতিবছর ২৬ নবেম্বর ভারত তাদের সংবিধান দিবস পালন করে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মূল অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় সুপ্রীমকোর্ট অব ইন্ডিয়ার উদ্যোগে। আমরা কমিটির সদস্যরা অনেক চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেই যে, সংবিধান দিবস পালন যেহেতু সরকারী সিদ্ধান্তের বিষয়, এ ব্যাপারে আমাদের উদ্যোগ নেয়াটা সমচীন হবে না। তবে আমরা সুপ্রীমকোর্টের পথ চলার শুরুর দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এখন থেকে সুপ্রীমকোর্ট দিবস নামে প্রতিবছর একটি দিন পালন করতে পারি। আমরা, কমিটির সদস্যরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রধান বিচারপতিকে জানালে তিনি আমাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেন এবং এ ব্যাপারে আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ফুল কোর্টে পেশ করার সিদ্ধান্ত দেন।

আমাদের এ অঞ্চল তথা ভারতবর্ষে উচ্চ আদালত প্রতিষ্ঠার ইতিহাস খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, ১৮৬১ সালের হাইকোর্ট আইনের বিধান মতে ১৮৬২ সালে সুপ্রিমকোর্ট, সদর দেওয়ানি ও সদর নিজামত আদালতসমূহ বিলুপ্ত করে তদস্থলে ব্রিটিশ সরকার কলকাতায় হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা করে। এখানে উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে সদর দেওয়ানি আদালত, ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রীমকোর্ট এবং ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে সদর নিজামত আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৮৬২ সালে কলকাতা হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বর্তমান বাংলাদেশ তদানিস্তন পূর্ববঙ্গ কলকাতা হাইকোর্টের অধীভুক্ত এলাকা ছিল। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মলগ্নে দেশটির পূর্বাংশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য হাইকোর্ট (বেঙ্গল) অর্ডারের বলে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোনণাপত্র জারি করে ২৬ মার্চ। অর্থাৎ, স্বাধীনতা ঘোষণার দিন থেকে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলে ঘোষণা করা হয় এবং একই তারিখে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক Laws Continuance Enforcement Order জারি করে বিধান করা হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে প্রচলিত সব আইন উক্ত ঘোষণাপত্রের বিধান ও প্রয়োজনীয় সংশোধনসাপেক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশে চালু থাকবে এবং বিচারবিভাগসহ সব সামরিক ও বেসামরিক সরকারী কর্মচারী বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্যের শপথ নিলে তারা তাদের স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন।
১৬ ডিসে¤¦র ১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং পরদিন অর্থাৎ ১১ জানুয়ারি, তিনি বাংলাদেশ সাময়িক সংবিধান আদেশ Provisional Constitution of Bangladesh Order জারি করেন। এই আদেশ বলে একজন প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতিবৃন্দের সমন্বয়ে বাংলাদেশ হাইকোর্ট গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ৯১নং আদেশ বলে বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ও অন্য দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে নিয়ে আপীল বিভাগ গঠন করা হয়। এই আপীল বিভাগে পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টে বিচারাধীন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মামলাগুলো স্থানান্তর করা হয়। অতঃপর ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৪ নবেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদ বহুল আকাক্সিক্ষত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করে। সংবিধানের ১৫৩ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখ থেকে এই সংবিধান প্রবর্তিত হয়। সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট প্রতিষ্ঠার বিধান রাখা হয়েছে। আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে আমাদের সুপীমকোর্ট গঠিত হয়।

উল্লিখিত, ধারাবাহিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, আমাদের এ অঞ্চলে একটি উচ্চতর আদালত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ১৮৬২, ১৯৪৭ এবং ১৯৭১-১৯৭২ এর সময়কাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনামলে সর্বপ্রথম বাংলায় একটি উচ্চতর আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের পর আমরা তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে একটি প্রাদেশিক হাইকোর্ট প্রাপ্ত হই। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো ১৯৭১-৭২ খ্রিস্টাব্দ, যখন বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার লাভ করে, তথা স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৭২ এর ১১ জানুয়ারি Provisional Constitution of Bangladesh Order- মাধ্যমে সর্বপ্রথম এই সর্বোচ্চ আদালতটি প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ হাইকোর্ট হিসেবে। পরবর্তীতে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান বলবৎ হওয়ার পর ‘বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট’ তার বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করে।

আমাদের কমিটিতে যখন বিষয়টি আলোচিত হয়, আমি প্রস্তাব করেছিলামÑ ১১ জানুয়ারিকে সুপ্রীমকোর্ট দিবস হিসেবে পালন করার জন্য। আমার যুক্তি ছিল, যেহেতু Provisional Constitution of Bangladesh Order এর মাধ্যমে ১১ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলায় প্রথম উচ্চতর আদালত যাত্রা শুরু করে, সে দিনটিই হওয়া উচিত আমাদের সুপ্রীমকোর্ট দিবস। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ যুক্তি দেন যে, Provisional Constitution of Bangladesh Order অনুযায়ী ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে একটি ‘হাইকোর্ট’ স্থাপিত হয়েছিল; কিন্তু সুপ্রীমকোর্ট স্থাপিত হয় সংবিধান আসার পর। তাই ১৬ ডিসেম্বর অথবা কাছাকাছি অন্য কোন দিনে এ দিবসটি পালন করা উচিত। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও সৈয়দ রিফাত আহমেদ উভয়েই বিচারপতি আরিফের যুক্তি সমর্থন করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে আমার কাছেও মনে হয়েছে ১১ জানুয়ারি দিবসটির প্রতি আমাদের আবেগ থাকলেও বাস্তবে সুপ্রীমকোর্ট কাজ শুরু করেছে ১৬ ডিসেম্বরের পরের কোন দিন থেকে।
তারপর শুরু হলো ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ এর পর কোন্ দিন সুপ্রীমকোর্ট তার যাত্রা শুরু করে, তার খোঁজ করা। সুপ্রীমকোর্টের ইংলিশ সেকশনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শাখার কাগজপত্রাদি থেকে দেখা যায় যে, ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুপ্রীমকোর্টের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। সেদিন থেকে সুপ্রীমকোর্ট তার যাত্রা শুরু করে। উল্লেখ্য যে, প্রথা অনুযায়ী সুপ্রীমকোর্ট সাধারণত ১৫ ডিসেম্বরের পর শীতকালীন ছুটিতে থাকে এবং তখনও তাই ছিল। সংবিধান এর ৬ষ্ঠ ভাগের প্রথম পরিচ্ছদ অনুযায়ী গঠিত সুপ্রীমকোর্টের যাত্রা শুরুর বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির বিশেষ নির্দেশে ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রীমকোর্ট খুলে দেয়া হয় এবং এর উভয় বিভাগ কার্যক্রম শুরু করে। তাই আমরা ১৮ ডিসেম্বরকে সুপ্রীমকোর্ট দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিই। পরবর্তীতে বিষয়টি সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিগণের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ফুল কোর্ট-এ উপস্থাপন হলে গত ২৫/১০/২০১৭ তারিখে এটি অনুমোদনের জন্য আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয় যে, সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ও নেতৃত্বে বীরত্বপূর্ণ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে এদেশের মুক্তিকামী জনতা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। বিজয় অর্জনের এক বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করেন, যা ১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত এবং একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। উক্তরূপ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সভায় বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট দিবস উদযাপন সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা হয়। প্রণীত সংবিধানের অধীন বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের যাত্রাকালীন সময়কে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে এবং ন্যায় বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সুপ্রীমকোর্টের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বছরের একটি দিনকে সুপ্রীমকোর্ট দিবস ঘোষণা করা এবং তা পালন করার বিষয়ে উপস্থিত সভাসদগণ একমত পোষণ করেন। আলোচনান্তে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী যেহেতু ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট প্রথম কার্যক্রম শুরু করেছিল, সেহেতু প্রতিবছর সেই দিনটিকে অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ‘সুপ্রীমকোর্ট দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর ইতোপূর্বে ঘোষিত অবকাশকালীন ছুটির মধ্যে পড়ায় সে বছরের (২০১৭ সালের) ‘সুপ্রীমকোর্ট দিবস’ এর অনুষ্ঠানাদি উক্ত অবকাশকালীন ছুটি শেষে প্রথম কার্যদিবস অর্থাৎ ২ জানুয়ারি ২০১৮ খ্রি. তারিখে উদ্যাপন করা হয়।
বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট এ দেশের মানুষের মৌলিক ও আইনগত অধিকার সুরক্ষায় সদা সর্বদা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। বেআইনীভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকে যেমন এই সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে, ঠিক একইভাবে অযাচিতভাবে সংবিধান সংশোধন করাকেও বেআইনী ঘোষণা করে দেশে সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠায় সুপ্রীমকোর্ট এক অনন্য সাহসী ও প্রজ্ঞাময় ভূমিকা পালন করেছে।

সপরিবারে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চার নেতা হত্যা তথা জেল হত্যাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় প্রদানের মধ্য দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে জাতিকে মুক্ত করেছে এই সুপ্রীমকোর্ট। এই সুপ্রীমকোর্টের প্রজ্ঞাবান বিচারপতিগণ আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশের মাটিতে সংগঠিত অবর্ণনীয় বর্বর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় সম্পৃক্ত অনেকের বিচার চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন করেছেন এবং এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের এই নিবিষ্ট ভূমিকা জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

লেখক : বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট

সৌজন্যে: দৈনিক জনকন্ঠ

সংবিধান দিবস ও সামান্য কথন

0

১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীর পর থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় দেশ পরিচালিত হচ্ছে। কারণ ‘সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা অন্য সরকার ব্যবস্থা থেকে উত্তম।’


কায়ছার আলী: রথযাত্রা লোকারণ্য মহাধুমধাম, ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিতে প্রণাম, পথ ভাবে “আমি দেব” রথ ভাবে “আমি”। মূর্তি ভাবে “আমি দেব” হাসেন অন্তর্যামী। পথ, রথ এবং মূর্তি এ তিন জনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? সবাই নিজেকে দাবি করছে। প্রকৃতপক্ষে শ্রেষ্ঠ হলেন বিধাতা। বিশ্বকবির এ উক্তিখানা পাঠ করলে মনে পড়ে যায় সরকারের আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের মধ্যে কার ক্ষমতা বেশি বা কম বা সমান এ বিতর্কের অবসান করতে পারে শুধুমাত্র সংবিধান। উপমা দিয়ে বলা যায় যে, চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। সূর্যের আলোয় চাঁদ আলোকিত ও উদ্ভাসিত। এখানে সূর্যকে সংবিধানের সঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেয়া যায়। ছোট্ট কথায় সংবিধান হলো যে কোনো রাষ্ট্রের মূল ও সর্বোচ্চ আইন। যা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য লিখিত ও অলিখিত বিধিবিধানের সমষ্টি। অন্যভাবে বলা যায়, একটি রাষ্ট্রের দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি। যার মধ্যে একটি জাতি, দেশ ও রাষ্ট্রের জীবনপদ্ধতি মূর্ত হয়ে উঠে অর্থাৎ সরকারের ক্ষমতা চর্চার শাখাগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটলের মতে “সংবিধান হলো এমন একটি জীবনপদ্ধতি- যা রাষ্ট্র স্বয়ং বেছে নিয়েছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানই আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং নাগরিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষা করে”। অধ্যাপক ফাইনারের মতে, “মৌল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সুষম ব্যবস্থাই সংবিধান।”

যে কোনো দেশের শাসনব্যবস্থা বা সরকারের ক্ষমতার উৎসই হচ্ছে সংবিধান। কোনো কিছু যেমন ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা হতে সৃষ্টি হতে পারে না বা শূন্যতার ভেতর কাজও করতে পারে না। এক কথায় বলা যায়, সংবিধানবিহীন কোনো স্বাধীন, সার্বভৌম ও সভ্য রাষ্ট্র চলতে পারে না। ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, মানব সভ্যতার প্রথম সমাজ হিসেবে পরিগণিত গ্রিক সমাজে দাস প্রথা প্রচলিত ছিল এবং তা স্বাভাবিক হিসেবেও সমর্থিতও হয়েছিল। সেখানে দাসগণের কোনো অধিকার ছিল না। দাসগণ ছাড়া সব নাগরিকই শাসনকার্যে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করত। বিভিন্ন প্রাচীন গ্রিক নগর-রাষ্ট্রের সংবিধানসমূহ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, যে সমস্ত বিশ্বাস এবং ধ্যান ধারণা অনুযায়ী ওই সব সমাজ পরিচালিত হয়েছিল তা সেখানকার সংবিধানগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছিল। এথেন্স ও স্পার্টা নগরীর দুইটির সংবিধানগুলোই এর দৃষ্টান্ত বিশেষ। সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সমাজের ও সংবিধান সেই ধরনের ‘ক্ষমতাগত সম্পর্ক’ প্রকাশ করে। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানে সর্বহারাগণই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং বুর্জোয়াগণের কোনো অধিকার নেই। সর্বহারাগণই সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকারী হবে এমনভাবেই সেখানে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়।

পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংবিধান ভারতের আর ছোট সংবিধান (মাত্র ১৫-১৬ পাতা) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের- তবে ছয় হাজার শব্দের বেশি নয়। ১৭৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তাদের সংবিধান ছাব্বিশ বার সংশোধিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের সংবিধান অলিখিত। আমাদের মহান ও পবিত্র সংবিধান লিখিত, দুষ্পরিবর্তনীয়, মৌলিক অধিকার দ্বারা স্বীকৃত, এক কক্ষবিশিষ্ট আইন সভা, ১৫৩টি অনুচ্ছেদ, ১১টি ভাগ, ৪টি মূলনীতি, ৭টি তফসিন, ১টি প্রস্তাবনাসহ পরিপূর্ণ একটি সংবিধান। তবুও কারণে বা অকারণে আজ পর্যন্ত এ সংবিধানে পনেরবার সংশোধনী আনা হয়েছে। প্রতি বছরের ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সংবিধান দিবস সম্পর্কে লিখতে গেলে এর পটভূমি লেখা অত্যন্ত জরুরি বা আবশ্যক। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সশস্ত্র মুক্তি যোদ্ধাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের দিন। এ দিন ‘জয় বাংলা’ স্স্নোগানে মুখরিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখে বাংলাদেশ ও ভারতের মিত্রবাহিনীর নিকট রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ কার্যত স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপস্নবী সরকার মুজিবনগর হতে ঢাকায় এসে শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি দান করেন। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ তার ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে ‘আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ’ জারি করেন। এ আদেশ ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়। এ আদেশ বলে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো থেকে প্রাপ্ত সব আইনকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অধীনে বৈধতা দান করা হয়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অনুযায়ী দেশ শাসিত হতে থাকে। সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল তার পরিবর্তে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর কালবিলম্ব না করে একটি সংবিধান প্রণয়ন করে জাতির আশা-আকাঙ্খা পূরণের জন্য ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ’ জারি করেন। এ আদেশ ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হবে বলে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪৬৯ জন সদস্যদের মধ্যে (জাতীয় পরিষদের ১৬৯+প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০=৪৬৯ জন) ৪০৩ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। কেননা, ৪৬৯ জন সদস্যের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিহত হয়েছিলেন ১২ জন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন ৫ জন, দুর্নীতির দায়ে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ৪৬ জন, পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন ২ জন (ভাষা আন্দোলনের খুনি নুরুল আমীন ও স্বতন্ত্র সদস্য রাজ ত্রিদির রায়) পররাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ে চাকরি গ্রহণ করেছিলেন ১ জন। এ ৪০৩ জন গণপরিষদ সদস্যের মধ্যে ৪০০ জন ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয়, ১ জন ছিলেন ন্যাপের (মোজাফ্‌ফর) এবং বাকি দুজন ছিলেন নির্দলীয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন আহ্বায়ন করেন। অধিবেশনের প্রথম দিনে গণপরিষদের সদস্যরা কর্তৃক স্পিকার নির্বাচিত হন শাহ্‌ আব্দুল হামিদ ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন মোহাম্মদ উলস্নাহ্‌। ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই ৩৪ জনের মধ্যে ৩৩ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের দলীয় গণপরিষদ সদস্য এবং একজন ন্যাপ (মোজাফ্‌ফর) সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (বর্তমানে আওয়ামী লীগ) একজন মহিলা গণপরিষদ সদস্য (বেগম রাজিয়া বানু) ওই কমিটির অন্তর্ভুক্ত হয়। এই খসড়া কমিটির প্রথম বৈঠক বসে ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল। এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জনমত আহ্বান করা হয়। খসড়া কমিটির সর্বমোট ৪৭টি বৈঠকে ৩০০ ঘণ্টা ব্যয় করে তাদের খসড়া চূড়ান্ত করে। ১৯৭২ সালের ১০ জুন কমিটি প্রাথমিক খসড়া প্রণয়ন করে। এরপর কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন ভারত ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে সংবিধান বেত্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে মূল্যবান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। প্রস্তাবিত সংবিধানের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবর কমিটির শেষ বৈঠকে খসড়া সংবিধানের চূড়ান্ত রূপ গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। এ অধিবেশনে ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে গণপরিষদে উত্থাপন করেন। ১৯ অক্টোবর সংবিধানের ওপর প্রথম পাঠ শুরু হয় এবং ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত চলে। এতে সর্বমোট ১০টি বৈঠকে ৩২ ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। অতএব, ৩১ অক্টোবর দ্বিতীয় পাঠ শুরু হয় এবং ৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলে। ৪ নভেম্বর সংবিধানের ওপর তৃতীয় ও সর্বশেষ পাঠ শুরু হয়। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে এ কাজ শেষ হয়। ঐ দিনটি ছিল ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণ (বেলা ১:৩০ মিনিট)। বিপুল আনন্দ তুমুল করতালি ও হর্ষ ধ্বনির মধ্যে বাংলাদেশ সংবিধান গণপরিষদ কর্তৃক পাস এবং তা চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। গণপরিষদের সংবিধানের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, এই সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত, এ সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকফঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে।

এখানে উলেস্নখ্য যে, পাকিস্তান সংবিধান প্রণয়ন করতে সময় লেগেছিল প্রায় নয় বছর (১৯৪৭-১৯৫৬), ভারতের সময় লেগেছিল প্রায় তিন বছর (১৯৪৭-১৯৪৯), কিন্তু বঙ্গবন্ধু সরকার মাত্র দশ মাসে বাংলাদেশকে একটি সংবিধান উপহার দিতে সক্ষম হন। ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর সংবিধানের হস্তলিপি সংস্করণে গণপরিষদের সদস্যগণের স্বাক্ষর গৃহীত হয়। গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত এ সংবিধান বিজয় দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়। আমাদের সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের সময় বা মহান জাতীয় সংসদের পাসের পূর্বমুহূর্তে কিছু ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল বা গ্রম্নপ বা গোষ্ঠী সতর্কতার সঙ্গে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিল। কারা এবং কেন, কি উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেছিল ইতিহাসে তা লেখা আছে। তারা সমালোচনা করলেও সংবিধানের মূলনীতিসমূহের বিরোধিতা করেনি এবং সংবিধানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে পুরোপুরি ভাবে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় প্রমাণ করে যে, পবিত্র সংবিধানটি সাধারণভাবে গ্রহণ যোগ্য ছিল। বর্তমানে সবাই সংবিধানকে আইন হিসেবে এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিয়েছে।
১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীর পর থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় দেশ পরিচালিত হচ্ছে। কারণ ‘সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা অন্য সরকার ব্যবস্থা থেকে উত্তম।’কায়ছার আলী: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

সৌজন্যে: যায় যায় দিন

বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রথম রাষ্ট্রপতি

0

অমিত দাশগুপ্ত: ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সদ্য স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এ দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দলকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী করেছিল রাষ্ট্রের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের সধহফধঃব দিয়ে। কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় যুদ্ধের কারণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। যুদ্ধাবস্থার মধ্যেই ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত গণপরিষদ জারি করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। সংবিধানের সংজ্ঞা বিশ্নেষণ, প্রণয়ন পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্যগত দিক, রাষ্ট্রের নাগরিকদের মেনে নেওয়া কিংবা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সব মিলিয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান যার আলোকে মুজিবনগর সরকার গঠিত ও পরিচালিত হয়েছিল। স্বাধীনতার সংগ্রামকে বেগবান করার তাগিদে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শত্রুর হাতে বন্দি বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি করা হয়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সব নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির। শুধু তাই নয়- প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীদের নিয়োগ, কর আরোপ ও অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে অর্পণ করা হয়। রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির সব ক্ষমতা প্রয়োগ এবং দায়িত্ব পালন করবেন মর্মে ঘোষণা করা হয়। নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিকারী বাঙালি জনগোষ্ঠী, মুজিবনগর সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র বিনির্মাণের তিনটি উপাদান প্রাপ্ত হয়েছিল; আর ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের মাঝে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

অসম সাহসী বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে কিংবা নির্যাতন করেও পাকিস্তানি জান্তারা ভাঙতে বা মচকাতে পারেনি। ফলে বাধ্য হয়েই তারা বাংলার মুজিবকে বাঙালির কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের একদিনের মধ্যে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ জারি করেন বাংলাদেশ অস্থায়ী সংবিধান আদেশ। যার মাধ্যমে তিনি সদ্যোজাত রাষ্ট্রের জন্য বেছে নেন মন্ত্রিপরিষদশাসিত শাসন ব্যবস্থা। গঠন করেন পৃথক বিচার বিভাগ। তাঁরই নির্দেশনায় দ্রুততম সময়ে প্রণীত ও গৃহীত হয় আমাদের মূল সংবিধান। সরকার ব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, দায়িত্বশীল সরকার গঠনের জন্য মূল সংবিধানেও মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকারের বিধান রাখা হয়। সেখানে রাষ্ট্রপতি পদ হয়ে ওঠে সম্মানের প্রতীক, আর প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করি যে, একজন উদারনৈতিক নেতা, যার নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, তাকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক পন্থায় গঠনের ক্ষেত্রে নানারূপ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত পক্ষ দেশের অভ্যন্তরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে; অন্যদিকে স্নায়ুযুদ্ধের বাস্তবতায় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নবগঠিত রাষ্ট্রের সরকারের পক্ষে মন্ত্রিপরিষদশাসিত শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা দুস্কর হয়ে পড়ে। আর তাই সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলো বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সংবিধান (চতুর্থ সংশোধন) আইন পাস করা হয়। যার মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকার পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু চালু করেন রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় দলের বিধান রেখে রাজনৈতিক অধিকারকে সংকুচিত করা হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত কতখানি উপযুক্ত কিংবা অনুপযুক্ত ছিল, তা যাচাই করার সুযোগ বাঙালির কাছে আসেনি। কেননা অপশক্তি কতটা ভয়াবহরূপে আবির্ভূত হয়েছিল, তার প্রমাণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত। ওই বেদনাবিধুর অধ্যায়ের ঘানি আজও বাঙালি বহন করে চলেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আবার পাকিস্তানি আদলের সামরিক শাসনের ভূত চেপে বসে। সংবিধানে সামরিক শাসনের কোনো বিধান নেই। কিন্তু সংবিধান (পঞ্চম সংশোধন) আইন, ১৯৭৯ এবং সংবিধান (সপ্তম সংশোধন) আইন, ১৯৮৬-এর মাধ্যমে সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। সামরিক শাসকরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি পদকেই বেশি উপযুক্ত মনে করতেন। তাই সামরিক ছায়াতলে রাষ্ট্রপতি পদটি হয়ে ওঠে নির্বাহী প্রধান; পরিণত হয় সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে।

অতঃপর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ দেশে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে (পরে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান পঞ্চম সংশোধন এবং সপ্তম সংশোধন আইন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছেন)। ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৯১ সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯১ পাসের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির উর্ধ্বে স্থান লাভ করলেও সরকারের নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত হয় প্রধানমন্ত্রী ও তার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদের হাতে। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘এই সংবিধানের ৫৬(৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ ফলে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ও ক্ষমতা সীমিত। সংবিধানের ৮০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ কর্তৃক প্রণীত বিল আইনে রূপান্তরের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সম্মতির বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির সম্মতির গুরুত্ব সংকুচিত করা হয়েছে। ইংল্যান্ডের মতো আমাদের দেশে রাষ্ট্রপ্রধানের পদটি বংশানুক্রমিক নয়, বরং জনপ্রতিনিধিদের ভোটে তিনি নির্বাচিত হন। আর নির্বাচনের যোগ্যতা হিসেবে তাকে ৩৫ বছরের বয়স্ক হতে হয় এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হয়। রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদ পাঁচ বছর। তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন। সংবিধান লঙ্ঘন ও গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে এবং শারীরিক ও মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানের যথাক্রমে ৫২ ও ৫৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অভিশংসন ও অপসারণ করা যায়। রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ পদটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে আলঙ্কারিক পদে পরিণত হয়েছে। সময়ের প্রবহমানতায় মন্ত্রিপরিষদশাসিত শাসন ব্যবস্থায়ও রাষ্ট্রপতি পদের গুরুত্ব বৃদ্ধি করা যায়। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব বৃদ্ধি করার জন্য জনমত গঠন করা যেতে পারে। যে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সেই দেশে রাষ্ট্রপতি পদের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্য তৈরি হলে তাতে গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় হবে।

আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল

কন্যাশিশুকে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি

0

ঢাকার দক্ষিণখান এলাকায় সুরাইয়া আক্তার নামের নয় বছরের শিশুকে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন এক নারী। সম্পর্কে ওই নারী সুরাইয়ার সৎমা। ওই নারীর নাম শিবলী খানম (২৬)।

গতকাল বুধবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত আসামি শিবলীর জবানবন্দি রেকর্ড করার পর তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পুলিশ বলছে, সুরাইয়াকে তার বাবা ও সৎমা মিলে দিনের পর দিন নির্যাতনের পর হত্যা করেছেন। সুরাইয়ার বাবার নাম হাফিজুল ইসলাম।

গত সোমবার রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় হাফিজুল ইসলামের বাসা থেকে শিশু সুরাইয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সুরাইয়ার মা আজিরন বেগম বাদী হয়ে দক্ষিণখান থানায় হত্যা মামলা করেন। এরপর পুলিশ অভিযান চালিয়ে সুরাইয়ার সৎমা শিবলীকে গ্রেপ্তার করে। পলাতক রয়েছেন সুরাইয়ার বাবা হাফিজুল।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণখান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শিশু সুরাইয়া হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন শিবলী। সুরাইয়াকে তিলে তিলে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে বলে আদালতকে জানিয়েছেন শিবলী। আড়াই মাস আগে আসামি হাফিজুল বেল্ট দিয়ে মেয়ে সুরাইয়াকে বেধড়ক পেটান। প্রায় প্রতিদিনই শিবলী ও হাফিজুল তাকে নির্যাতন করতেন।

ঢাকার আদালতে জমা দেওয়া পুলিশ প্রতিবেদন এবং পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২১ বছর আগে হাফিজুলের সঙ্গে আজিরন বেগমের (সুরাইয়ার মা) বিয়ে হয়। এই দম্পতির দুটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। বড় মেয়ের নাম হাজেরা বেগম (১৭), আর ছোট মেয়ে সুরাইয়া। দুই সন্তান নিয়ে আজিরন শেরপুরে থাকতেন। তাঁর স্বামী হাফিজুল ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। চার বছর আগে আজিরন জানতে পারেন, তাঁর স্বামী ঢাকায় আরেকটি বিয়ে করেছেন। নাম শিবলী খানম। পরে আজিরন চলে আসেন ঢাকায়। দুই সন্তান নিয়ে তিনি তাঁর মায়ের বাসায় ওঠেন। এরপর হাফিজুল আজিরনকে তালাক দেন। হাজেরা ও সুরাইয়াকে নিজের বাসায় নিয়ে যান হাফিজুল। গত ২০ জানুয়ারি টেলিফোনের মাধ্যমে বাদী আজিরন জানতে পারেন, তাঁর ছোট মেয়ে সুরাইয়া মারা গেছে। ছয় বছর ধরে সুরাইয়া হাফিজুলের কাছে ছিল।

দক্ষিণখান থানার পুলিশ আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, শিশু সুরাইয়ার মাথা, নাক, ঠোঁট, পিঠ, দুই ভ্রু, থুতনি, দুই হাতের আঙুল, পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কাটা দাগ রয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রতিদিন আসামি হাফিজুল ও শিবলী সুরাইয়াকে মারধর করতেন। আশপাশের লোকজন সুরাইয়ার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেতেন। চার দিন আগেও সুরাইয়াকে হাফিজুল ও শিবলী মারধর করেন।

তদন্ত কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বলেন, সুরাইয়ার পায়ে সমস্যা ছিল। হাঁটতে সমস্যা হতো। কিছুটা প্রতিবন্ধী। মাঝেমধ্যে ঘরের ভেতর প্রস্রাব-পায়খানা করে দিত। যখন-তখন হাফিজুল ও শিবলী সুরাইয়াকে মারধর করতেন। আসামি শিবলী আদালতে স্বীকার করেছেন, আড়াই মাস আগে হাফিজুল বেল্ট দিয়ে ইচ্ছেমতো সুরাইয়াকে পিটিয়ে জখম করেন। মেয়েটি অপুষ্টির শিকার। হাত-পা শুকিয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসাও করানো হতো না।

পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ জানান, হাফিজুলকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। যেকোনো সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

সাত বছরের শিশু ধর্ষণ মামলার আসামী কারাগারে

0

রাজধানীর বাসাবোতে সাত বছরের শিশু ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি জুবায়ের অহম্মেদ তালুকদারকে (২৫) কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত্। শনিবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মিল্লাত হোসেন এ আদেশ দেন।
বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে সিলেটের হবিগঞ্জ থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

জুবায়ের আহম্মেদ তালুকদার ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী কলেজে আইন বিষয়ের শিক্ষার্থী। তাঁর গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার মোড়াকুড়ায়। ১৬ জানুয়ারি সকালে বাসাবোতে ধর্ষণের ওই ঘটনা ঘটে।

র‌্যাব-৩ এর সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত জুবায়ের ওই শিশুদের বাসায় সাবলেট থাকতেন। গত ১৬ জানুয়ারি সকালে তার পাশের রুমে বসবাসকারী পরিবারের এক শিশুকে ফুঁসলিয়ে নিজের রুমে নিয়ে ধর্ষণ করেন। ঘটনার পর তিনি পালিয়ে যান। শিশুটির বাবা জুবায়েরের বিরুদ্ধে সবুজবাগ থানায় ধর্ষণের মামলা করেন।

ধর্ষণের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে শিশুটি পরিবারের কাছে কিছু বলেনি। ঘটনার তিনদিন পর শিশুটির মা বিষয়টি টের পান। তিনি এ ব‍্যাপারে শিশুটিকে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সে ঘটনার কথা স্বীকার করে।

এ ঘটনায় ২২ জানুয়ারি রাতে সবুজবাগ থানায় শিশুটির বাবা মামলা করেন এবং শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করেন।

এদিকে মামলার খবর পেয়ে ওই কলেজছাত্র হবিগঞ্জে পালিয়ে আসেন। এ বিষয়ে শিশুটির পরিবার র‌্যাব-৩ এর কাছে অভিযোগ করে। এর প্রেক্ষিতে র‌্যাব-৩ মোবাইল ট্র্যাকিংয়ে অবস্থান নিশ্চিত হয়ে হবিগঞ্জ শহরের রাজনগর এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে তাকে গ্রেফতার করে।

তদন্তে গাফিলতির লিখিত ব্যাখ্যা চাইলেন হাইকোর্ট

0

নাটোরের নলডাঙ্গার গৃহবধূ হালিমা খাতুন ওরফে শারমিন (২০) ও তাঁর দুই বছরের প্রতিবন্ধী ছেলে আব্দুল্লাহকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে গাফিলতির বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।

মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তাকে এমন নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. আমিনুর রহমানকে এই ব্যাখ্যা দাখিল করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী ১৫ জানুয়ারি তাঁকে আদালতে সশরীরে হাজির থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। গত ১৭ ডিসেম্বর এসআই মো. আমিনুর রহমান হাইকোর্টে হাজির হয়ে মৌখিকভাবে নিঃশর্ত ক্ষমার আবেদন করলেও আদালত তা গ্রহণ না করে তাঁকে ১৫ জানুয়ারি হাজির থাকার নির্দেশ দেন। আদালতের এ আদেশের তথ্য নিশ্চিত করেন সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।

জানা যায়, নাটোরের নলডাঙ্গার বাঁশিলা উত্তর পাড়ার গৃহবধূ হালিমা খাতুন শারমিন ও তাঁর দুই বছরের প্রতিবন্ধী ছেলে আব্দুল্লাহকে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরদিন ১৬ মে নিহত গৃহবধূর বাবা ওমর ফারুক বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। মামলায় নিহতের দেবর মাহবুল আলম মুক্তাকে আসামি করা হয়। পুলিশ এদিনই আসামি মুক্তাকে গ্রেপ্তার করে।