তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগ করে তথ্য পাওয়া খুব সহজ – এমন না ভাবাই ভালো। আবেদন করে পাওয়া তথ্য যে সবসময় আপনার কাজে লাগবে তা-ও নয়। তবু লেগে থাকলে ভালো ফল পাওয়া যায়। একারণে বিশ্বের যেখানেই এই আইন আছে, সেখানেই সাংবাদিকরা একে কাজে লাগিয়ে তৈরি করছেন অসাধারণ সব রিপোর্ট। একের পর এক বাধা পেরিয়ে যারা শেষ পর্যন্ত কঠিন সব তথ্য হাতে পাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, চাইলে তাদের পথ ধরে হেঁটে যেতে পারেন আপনিও। তখন, বিষয়টি সম্পর্কে আপনার ভয়ও কমে আসবে অনেকটাই।
একেক দেশের তথ্য অধিকার আইন একেকরকম হতে পারে। এই বৈচিত্র্যের কারণে, সবার কাজে আসবে এমন গড়পড়তা পরামর্শ দেয়া কঠিন। তবুও, অভিজ্ঞ সাংবাদিক এবং তথ্য অধিকার বিশেষজ্ঞদের দেয়া পরামর্শে উল্লেখযোগ্য মিল পাওয়া যায়।
ভারত, মেক্সিকো, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক-গবেষকদের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে জিআইজেএন তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারের আটটি সাধারণ দিক খুঁজে পেয়েছে। এখানে রইল তাদের সেই পরামর্শ যা আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেবে এই আইন ব্যবহারের কিছু কার্যকর কৌশলের সাথে।
জিআইজেএনের ৮ পরামর্শ
১. আগাম পরিকল্পনা: খুঁজে বের করুন আপনি কী চান। তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগে বিশেষজ্ঞ কমবেশি সবাই জোর দিয়ে বলেছেন, নথিপত্র চাওয়ার আগে, পর্যাপ্ত গবেষণা করে নিন। নিশ্চিত হোন আপনি কী চান।
২. বিকল্প ভাবনা: ভিন্ন পথেও চেষ্টা করুন। আগে এদিক-ওদিক খুঁজে দেখুন, বিকল্প পথে সেই তথ্য পাওয়া যায় কিনা। সেটি আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে চেয়ে দেখুন। না পেলে আরটিআই ব্যবহার করুন।
৩. অবস্থান: তথ্য চাওয়ার আগে নিশ্চিত হোন, সেটি কোথায় আছে। কী খুঁজছেন তা জানা যত জরুরি, সেটি সরকারের কোন অফিসে আছে, তা নিশ্চিত হওয়াও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ।
৪. পূর্বপ্রস্তুতি: আগে জেনে নিন আইন সম্পর্কে। তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগ করার আগে, সেটি সম্পর্কে ভালোমতো জেনে নিন। যেমন, কত টাকা ফি দিতে হয়? জবাব দেয়ার জন্য তাদের সময়সীমা কেমন? আপনার নিজের কী কী অধিকার আছে?
৫. সঠিক জায়গায় সঠিক প্রশ্নটি করুন। তথ্য অধিকার আইন নিয়ে যারা কাজ করেন তারা সবাই বলেছেন, প্রশ্ন যেন স্পষ্ট হয়। আপনার আবেদনে কোনো অস্পষ্টতা থাকলে, তা আপনার বিপক্ষেও চলে যেতে পারে। আপনার প্রশ্ন যত সুনির্দিষ্ট হবে, তথ্যও তত দ্রুত পাওয়া যাবে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, তথ্য চেয়ে একটা বিশাল আকারের আবেদনের চেয়ে, ছোট ছোট কয়েকটি আবেদন বেশি কার্যকর। “যা আছে, সব কিছু দিন”- এই ধরণের আবেদন খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না। “কেন” জাতীয় প্রশ্ন কাজে আসবে না। আপনার জানবার বিষয় নিয়ে খুবই সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করুন। “আপনাদের পরিচালক কী করেন?” এই প্রশ্ন না করে বরং বলুন, “দয়া করে আপনাদের পরিচালকের কর্ম বিবরণীটা দিন।”
৬. হাল ছাড়বেন না: ফলোআপ সবসময়ই কাজে দেয়। তথ্য চেয়ে একটা আবেদন পাঠিয়ে শুধুই বসে অপেক্ষা করবেন না। সেই তথ্যের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন, সম্ভব হলে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখুন। ধৈর্য্য ও ধারাবাহিকতা খুবই জরুরি। দরকার হণে আলাপ-আলোচনা, এমনকি দরকষাকষিও চালিয়ে যান।
৭. আপিল করুন। তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানানোর প্রবণতা খুবই সাধারণ ব্যাপার। এর জন্য তৈরি থাকুন। আপনি আপিল করুন।
৮. প্রকাশ করুন: সংকোচের কিছু নেই। তথ্য চেয়ে আবেদন করার পর থেকে শেষপর্যন্ত কী হলো, সব কিছু লিখে রাখুন। হার-জিত, যা-ই হোক; তথ্য পেলে ভালো, কিন্তু না পেলেও সেটি নিয়ে রিপোর্ট করুন।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকরা তথ্য অধিকার ব্যবহার নিয়ে কলাম লিখেছেন। এখানে থাকছে বিশেষজ্ঞদের কিছু পরামর্শ। পরামর্শগুলো দেয়া হয়েছে সংক্ষিপ্ত আকারে।
কখনো রাগের মাথায়, প্রতিশোধের কথা চিন্তা করে বা খারাপ মেজাজ নিয়ে আরটিআই আবেদন লিখবেন না। এমন আবেদন ব্যর্থ হয়।
“গাইড টু ড্রাফটিং আ গুড আরটিআই অ্যাপ্লিকেশন” শিরোনামে প্রকাশিত লেখার শুরুটা সিজে কারিরা করেছেন এভাবে, “ভালো একটি আরটিআই আবেদন লেখা সাধারণ একটা ছুটির দরখাস্ত লেখার মতোই সহজ। তথ্য অধিকার আইনের মৌলিক জিনিসগুলো জানা থাকলে; কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চেয়ে আবেদন করার ব্যাপারটা মনে হবে ছেলেখেলা।”
• তথ্য পেতে হলে কী কী করতে হবে, জেনে নিন
• তথ্য অধিকারের আবেদনপত্র তৈরির প্রস্তুতি নিন
• তথ্য কেন দরকার, এবং পেলে, তা দিয়ে কী করবেন – নিশ্চিত হোন।
• শুধু তথ্যই জানতে চান, অন্য কিছু নয়।
• কী জানতে চান – সুনির্দিষ্টভাবে লিখুন। অস্পষ্ট অনুরোধ করবেন না।
• আরটিআই আবেদন বেশি বড় করবেন না।
• কোন সময়ের জন্য তথ্য চাওয়া হচ্ছে, সুনির্দিষ্টভাবে করে লিখুন।
• তথ্যটি এমনিতেই কোথাও পাওয়া যায় কিনা, খোঁজ নিন।
• তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারের আগে নিজের ক্ষোভ প্রশমন করুন।
• কখনো রাগের মাথায়, প্রতিশোধের কথা চিন্তা করে বা খারাপ মেজাজ নিয়ে আরটিআই আবেদন লিখবেন না। এমন আবেদন ব্যর্থ হয়।
“কীভাবে সবচেয়ে যথাযথ উত্তর পাওয়া যায় এবং প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আশঙ্কা কমিয়ে আনা যায়” তা নিয়ে লিখেছিলেন কিনি। এখানে থাকছে সেখান থেকে নেওয়া কিছু টিপস:
১. আপনার চাওয়া তথ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় তথ্য অধিকার আইন।
২.মনে রাখবেন যে, শুধু মূল তথ্যটাই যেন জানতে চাওয়া হয়। যে কোনো বিষয়ে কে, কেন, কীভাবে- এসব প্রশ্নের উত্তর নয়।
৩. তথ্য অধিকার আইনের অধীনে আপনি তথ্য জানতে চাইতে পারেন কেন্দ্রীয়, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। সংসদ, বিচারবিভাগ, পুলিশ, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারী সেক্টরের কোনো কাজ বিষয়ে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত যেকোনো সংগঠন থেকে আপনি তথ্য জানতে চাইতে পারেন।
৪. আপনার ঠিক কী ধরনের তথ্য দরকার, সেটা শুরুতে খুব ভালোমতো চিন্তা করে নিন। এরপর সেটা খুব অল্প কথায় লিখে ফেলুন। বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা, সুপারিশ বা অস্পষ্ট ঘোরানোপ্যাঁচানো কথাবার্তা দিয়ে কিছু জানতে চাইবেন না।
৫. কোনো ঝামেলা মেটানো অথবা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে হেনস্তা করার উদ্দেশ্য নিয়ে কখনোই আরটিআই ব্যবহার করা উচিৎ নয়।
৬. কোনো তথ্য বের করে আনার পর সেটি কাজে লাগান। ফাইলবন্দি করে রাখবেন না।
৭. আপনি যে তথ্য চাইছেন সেই সংক্রান্ত কোনো রেকর্ড, দলিলপত্র, মেমো, চিঠিপত্র, মতামত, পরামর্শ, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, সার্কুলার, ছবি অথবা যে কোনো কম্পিউটার উৎপাদিত জিনিস, অর্ডার, লগবুক, কনট্রাক্ট, রিপোর্ট, কাগজপত্র, নমুনাপত্র, মডেল বা ইলেকট্রনিক ডেটা চাইতে পারেন।
৮. আগে থেকে সাক্ষাতের সময় ঠিক করে নিয়ে আপনি কোনো অফিসের দলিল, অফিসিয়াল কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে পারেন এবং সেগুলোর কপিও নিতে পারেন, কপি করার অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে।
৯. এই আইন আপনাকে কোনো সরকারী কাজ পরিদর্শন করা এবং সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহেরও সুযোগ দেয়।
১০. তথ্য অধিকার আইনে আবেদনের জন্য খুবই সহজ সাধারণ একটা ফর্ম দেয়া আছে, যেটা সাদা কাগজে কপি করার পর নিজের সাক্ষর দিয়ে নিতে পারেন আবেদনকারী।
আপনি একজন নাগরিক, কোনো তদন্তকারী সংস্থা নন। অভিযোগ থাকলে কর্তৃপক্ষকে জানান। আরটিআই আবেদনে অভিযোগ আনার দরকার নেই।
১. ভালো একটা আরটিআই আবেদন, লন্ড্রি লিস্টের মতোই একঘেয়ে। নিছক কিছু তথ্যের একটি তালিকা, যেখানে কোনো যুক্তিতর্কের বালাই নেই।
২. একটি ভালো আরটিআই দরখাস্ত হবে সংক্ষিপ্ত।
৩. আপনার যদি অনেক তথ্য দরকার হয়, তাহলে অনেকগুলো ছোট ছোট আবেদন করুন।
৪. যে তথ্য চান তার সময়সীমা অল্পের মধ্যে রাখুন। বেশি উচ্চাকাঙ্খী হবেন না।
৫. আপনি একজন নাগরিক, কোনো তদন্তকারী সংস্থা নন। অভিযোগ থাকলে কর্তৃপক্ষকে জানান। আরটিআই আবেদনে অভিযোগ আনার দরকার নেই।
৬. প্রথমে লিখে ফেলা আবেদন জমা দিয়ে দেবেন না। প্রথমবারেরটাতে সবসময়েই কিছু ভুল থেকে যায়।
তথ্য অধিকার আইনের ধারায় যে শব্দগুলো দেওয়া আছে, সেগুলো উল্লেখ করে কাগজপত্র চান। যেমন রিপোর্ট, লগবুক, ইমেইল, অ্যাডভাইস, রুলস, রেগুলেশনস, ম্যানুয়ালস ইত্যাদি।
প্রায়শই আমরা আরটিআই আবেদন লিখতে বসি রাগের মাথায়, খারাপ মেজাজ নিয়ে। কিন্তু লেখার সময় মনোযোগ থাকা উচিৎ তথ্য পাওয়ার দিকে। তা না করে আমরা চিন্তা করতে থাকি কীভাবে কিছু অন্যায় থামানো যায়, কীভাবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও ঠিকাদারকে শাস্তি দেওয়া যায়, কীভাবে অযত্ন-অবহেলার জন্য কর্তৃপক্ষকে ‘জবাবদিহি করা যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকম পরিস্থিতিতে, আমরা পরিস্কারভাবে চিন্তা করতে ব্যর্থ হই। বুঝতে পারি না, ঠিক কী ধরণের তথ্য দরকার। রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট একটা আইন। এর কার্যকরিতা নির্ভর করে রাগ-বিরক্তি ইত্যাদির উর্ধ্বে থেকে তাকে ব্যবহার করতে পারার ওপর।
তাঁর চারটি গোল্ডেন রুল হচ্ছে:
১. আবেদনে সুনির্দিষ্ট নথিপত্রের কথা উল্লেখ করুন।
২. তথ্য অধিকার আইনের ধারায় যে শব্দগুলো দেয়া আছে, সেগুলো উল্লেখ করে কাগজপত্র চান। যেমন রিপোর্ট, লগবুক, ইমেইল, অ্যাডভাইস, রুলস, রেগুলেশনস, ম্যানুয়ালস ইত্যাদি।
৩. প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন না, কোনো ব্যাখ্যা চাইবেন না, আর কোনো অভিযোগ তুলবেন না।
৪. অস্পষ্ট অনুরোধ করা থেকে বিরত থাকুন। যেমন: আমার অভিযোগটির কী অবস্থা? আমার অভিযোগপত্র/চিঠির ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
নিচের নির্দেশনাগুলো পালন করতে পারেন:
১. প্রথমে চিন্তাভাবনা গুছিয়ে নিন।
২. আরটিআই ছাড়াই যে তথ্য পাওয়া যায় সেগুলো দিয়ে শুরু করুন।
৩. প্রশ্ন করবেন না, শুধু তথ্যের কথা জানতে চান।
৪. আবেদন সহজ ও স্পষ্ট রাখুন। ফাঁকফোকর সম্পর্কে সচেতন থাকুন।
৫. অধিকার প্রয়োগ করার আগে জেনে নিন, কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
৬. একই তথ্যের জন্য সংশ্লিষ্ট সব সরকারী কর্তৃপক্ষকে ব্যবহার করুন।
৭. দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিন।
৮. প্রয়োজন বুঝে লক্ষ্য পরিবর্তন করুন।
৯. সাংবাদিক পরিচয় প্রকাশ করার কোনো প্রয়োজন নেই।
১০. যেকোনো ধরণের প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
১১. মনে রাখবেন, “না”-এর অর্থ সবসময়ই না-ই হবে, এমন কোনো কথা নেই।
১২. সময় নষ্ট করবেন না, আবেদন অনলাইনে জমা দিন অথবা ডাকে।
১৩. ধৈর্য্য ধরুন, হাল ছাড়বেন না।
১৪. তথ্য পাওয়ার জন্য বাড়তি কাজ করুন।
১৫. আরটিআই কর্মকর্তাদের প্রতি সংবেদনশীল হন।
১৬. তথ্য কমিশনারদের সাহায্য নিন।
১৭. কাগজপত্র পরিদর্শন করুন।
১৮. ফলোআপ চালিয়ে যান।
সৌজন্যে – জিআইজেএন