ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ, শেয়ার ও ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি এবং অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের বাইরে অর্থ পাচারের অভিযোগে ৫০ জনকে চিহ্নিত করে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ৩ বছর আগে একটি উদ্যোগ নিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু সেই উদ্যোগের এখন আর সাড়াশব্দ নেই। থমকে আছে সেই উদ্যোগ।
এ ছাড়া বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনতে ৪ বছর আগে উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। কথা ছিল এই টাস্কফোর্স বিদেশে অবস্থানরত আসামিদের বিচারের জন্য দেশে ফিরিয়ে আনতে তাদের নামের তালিকা প্রণয়ন, আসামিদের অবস্থান চিহ্নিতকরণ, দেশে ফিরিয়ে আনার উপায় নির্ধারণ, ফেরত আনার কার্যক্রম তদারকি এবং কোনো আসামি ইতিমধ্যে বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করে থাকলে সে ক্ষেত্রে তাকে ফিরিয়ে আনার উপায় নির্ধারণ ও এ-সংক্রান্ত কার্যক্রম তদারকি করার। কিন্তু সেই কাজও গতি পায়নি।
ফলে দুদক ও টাক্সফোর্স দুটির কার্যক্রমই এখন স্থবির।
দুদক সূত্রে জানা যায়, সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দায়িত্বে থাকা কালিন ৫০ জনের একটি তালিকা তৈরী করে তাদের পাচার করা অবৈধ অর্থের সন্ধান দিতে বেশ কয়েকটি দেশে এমএলএআর (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়।
ওই তালিকায় নাম ছিল মানবপাচারের অপরাধে কুয়েত কারাগারে বন্দি সাবেক এমপি শহীদুল ইসলাম পাপুল, আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারির হোতা প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) যুবলীগের বহিষ্কৃত দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রী, বেসিক ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম, ঢাকা ট্রেডিংয়ের কর্ণধার টিপু সুলতান, এবি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী, শেয়ার খাতের ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বাদল, নিম্ন আদালতের একজন বিচারকও।
এদের দেশে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়ার কথা বলা হয়েছিল। বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে দুদকের কাছে তথ্য ছিল এরা দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া,ভারত ও হংকংয়ে অর্থ পাচার করেছেন। এজন্য এমএলএআর পাঠানোর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু এই অনুরোধের পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে আর কিছুই জানেনা দুদক। এখন আর এ নিয়ে মাথাই ঘামাচ্ছে না সংস্থাটি।
দুদক সূত্রে জানা যায়, কাজী আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের তদন্তে অন্তত একশ’ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য মিলেছে। তিনি মালয়েশিয়া ও ভারতে টাকা পাচার করেছেন বলে দুদকের তদন্তে ওঠে আসে।
লিজিং কোম্পানি ও আর্থিক খাত থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচারে জড়িত প্রশান্ত কুমার হালদার। যিনি ভারতের কারাগারে আটক আছেন। পিকে হালদারের বিরুদ্ধে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অফিসিয়াল তথ্য পায় দুদক। দুদক ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে।
বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম দুদকের ৬১ মামলার আসামি। বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অন্তত সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাটে জড়িত কাজী ফখরুল এখন কানাডায় রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এবি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে ৫০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তিনি পাচারের টাকার একটি অংশ দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে কয়েকটি বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করেছেন।
একই ব্যাংকের মোহাম্মদ আলীও অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে যান। ঢাকা ট্রেডিংয়ের কর্ণধার টিপু সুলতান ঋণের নামে জনতা ব্যাংক থেকে ১৯০ কোটি টাকা ও বিডিবিএল ব্যাংক থেকে ১৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেশের চলে যান।
একইভাবে শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িত লুৎফর রহমান বাদলও বিদেশে টাকা পাচার করে পালিয়ে আছেন। এসব ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তা থমকে আছে।
এদিকে,২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর ১১ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এর সভাপতি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী। সদস্য হিসেবে রয়েছেন-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল, পররাষ্ট্র সচিব, জননিরাপত্তা সচিব, সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মহাপরিচালক এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক। জননিরাপত্তা বিভাগ এ টাস্কফোর্সকে সাচিবিক সহায়তা দিয়ে থাকে। কিন্তু টাক্সফোর্স গঠনের পর আজ পর্যন্ত একজন পলাতককেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত বাংলাদেশের সঙ্গে বন্দিবিনিময় চুক্তি রয়েছে মাত্র দুই দেশের। দেশ দুটি হচ্ছে-ভারত ও থাইল্যান্ড। এ ছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (দুবাই) সঙ্গে বন্দিবিনিময় (দণ্ডিত) চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। অন্যান্য দেশ থেকে অপরাধীদের ফিরিয়ে আনতে হলে বন্দিবিনিময় চুক্তি করতে হবে । এ ছাড়া ইন্টারপোলের সহায়তা নিতে হবে। কিন্তু এ ধরণের কার্যক্রমে গতি মন্থর হওয়ায় বিদেশে পাচারকৃত অর্থ আদৌ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কী না এ প্রশ্ন রয়েছে।