দেশের অধস্তন তথা বিচারিক আদালতে চার মাসে চারটি ঘটনায় দেখা গেছে, বিচারকদের সঙ্গে আদালতেই বাদানুবাদ-কলহবিবাদে জড়িয়ে পড়েছেন আইনজীবীরা। এমনকি রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটরও (পিপি) জড়িয়েছেন এমন অপ্রীতিকর ঘটনায়। তাঁদের বিরুদ্ধে এজলাসেই বিচারকদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন ও হুমকি দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে।
সর্বশেষ গত ২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর এজলাসে হট্টগোল, বিচারক ও আদালতের কর্মচারীদের ‘গালিগালাজ ও অশালীন আচরণের’ ঘটনা ঘটে। দুই বিচারক ও একজন নাজিরের অপসারণ চেয়ে আইনজীবীরা গত বৃহস্পতিবার থেকে কার্যদিবস আদালত বর্জন করেছেন; বঞ্চিত করেছেন বিচারপ্রার্থী নাগরিকদের। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতিসহ তিনজনকে আগামী ১৭ জানুয়ারি হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে ৫ জানুয়ারি আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
এর আগে বিদায়ী বছরের শেষ তিন মাসে অনুরূপ আরও তিনটি ঘটনার নজির আছে, যার দুটিতে সংশ্নিষ্ট আইনজীবীরা হাইকোর্টে ক্ষমা চেয়ে নিস্কৃতি পেয়েছেন। এর একটিতে পিরোজপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবু জাফর মো. নোমান গত ১৯ সেপ্টেম্বর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) খান মো. আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে খারাপ আচরণের অভিযোগ এনে সুপ্রিম কোর্টের
রেজিস্ট্রার জেনারেলকে চিঠি দেন। পরে প্রধান বিচারপতি লিখিত অভিযোগটি নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে পাঠান। আলাউদ্দিনকে ১৫ নভেম্বর হাইকোর্টে হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছিল। তিনি আদালতে হাজির হয়ে ক্ষমার আবেদন করেন।
অপরটিতে গত ২২ সেপ্টেম্বর খুলনা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক (বর্তমানে যুগ্ম জেলা জজ) নির্মলেন্দু দাশের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ঘটনায় খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলামসহ তিন আইনজীবীর বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেওয়া হয়। পরে সাইফুল ইসলামসহ তিন আইনজীবীকে তলব করেন হাইকোর্ট। তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুলও জারি করা হয়। ২৩ নভেম্বর হাইকোর্টে হাজির হয়ে ক্ষমা চাইলে তা মঞ্জুর করা হয়।
অধস্তন আদালতের একাধিক বিচারক বলেছেন, বিচারকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ঘটনায় কারও শাস্তি না হওয়ায় এমন ঘটনা ঘটে চলছে।
গত নভেম্বর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জজ শারমিন নিগারের বিরুদ্ধে আইনজীবীরা ‘আদালতে দুর্নীতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করার অভিযোগে’ তাঁর অপসারণ দাবি করে আসছেন।
এ ছাড়া গত দুই বছরে ঝিানইদহ, সিরাজগঞ্জ, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারকদের সঙ্গে আইনজীবীদের বাদানুবাদের ঘটনা ঘটেছে। বর্জন করা হয়েছে সংশ্নিষ্ট আদালতের বিচারকাজ।
বিচার ব্যবস্থায় বার (আইনজীবী) ও বেঞ্চের (বিচারক) সুসম্পর্ক অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আইনজীবীদের ভূমিকার জন্য বিচারকরা আইনের সঠিক প্রয়োগের সুযোগ পান, বিচারপ্রার্থীরাও সহায়তা পান। কোনো রায় ও আদেশ নিয়ে বিচারপ্রার্থী বা আইনজীবীদের ভিন্নমত থাকলে সংক্ষুব্ধরা সংশ্নিষ্ট আদালতে আইন অনুযায়ী অনাস্থা আবেদন করতে পারেন। এতে মামলাটি পরে অন্য আদালতে নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। আর প্রশাসনিক কোনো বিষয়ে ভিন্নমত থাকলে সংশ্নিষ্ট বিচারকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ জেলা জজ বা সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানানোর সুযোগ রয়েছে। তার পরও অঘটন ঘটছে।
২০২০ সালের ৩ মার্চ পিরোজপুর-১ আসনে সাবেক এমপি এ কে এম এ আউয়াল ও তাঁর স্ত্রী লায়লা পারভীনকে জামিন না দেওয়ার ঘটনায় জেলার সংশ্নিষ্ট বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীদের অশোভন আচরণের ঘটনা ঘটে। শতাধিক ‘আইনজীবীদের তোপের মুখে’ ওই দিন দুপুরে জেলার সংশ্নিষ্ট জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুল মান্নানকে বদলি করে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। পরে জেলার যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ নাহিদ নাসরিনকে ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ওই দিন বিকেলেই এ কে এম এ আউয়াল ও তাঁর স্ত্রী লায়লা পারভীনকে জামিন দেন। এ ঘটনা দেশবাসীকে স্তম্ভিত করে।
গত ২৭ ডিসেম্বর দেশের জেলা জজদের উদ্দেশে দেওয়া অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আইনজীবীদের কোনো অন্যায় দাবির কাছে মাথা নত করবেন না। বিচারকদের সুশৃঙ্খলভাবে আদালত পরিচালনা করতে হবে।’
বিচারকরা চাকরিবিধি অনুযায়ী গণমাধ্যমে সরাসরি কথা বলতে না পারলেও তাঁদের কয়েকজন একান্ত আলাপে বলেছেন, বিভিন্ন জেলা আইনজীবী সমিতির প্রভাবশালী আইনজীবীদের কেউ কেউ ক্ষমতার দাপট দেখাতে অভ্যস্ত। তাঁদের সিদ্ধান্তের বাইরে আদেশ হলে আদালতেই তাঁরা হৈ-হট্টগোল শুরু করেন। বিচারকরা সিদ্ধান্তে অটল থাকলে দেখা গেছে, দুর্নীতি-অনিয়ম ধরনের অভিযোগ এনে সমিতিগুলো আদালত বর্জনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। কখনও কখনও নামে-বেনামে প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) মিথ্যা বা হয়রানিমূলক অভিযোগ পাঠানো হয়। এমন পরিস্থিতিতে জেলা আদালতে অনেক বিচারক দায়িত্ব পালনে তটস্থ থাকেন।
জানতে চাইলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’-এর মহাসচিব (জেলা ও দায়রা জজ) মো. মজিবুর রহমান বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার একটি ভিডিওতে যা তাঁরা দেখেছেন, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তিনি বলেন, ‘কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তার ভাষা এটা হতে পারে না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো যেত। আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
তবে এ ধরনের ঘটনার জন্য বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতিগত ত্রুটিও দায়ী বলে মনে করেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক। তিনি সমকালকে বলেন, ‘দেশে প্রতিবছর গড়ে ১৫ লাখ মামলা দায়ের হচ্ছে। বিচারকাজ করছেন গড়ে সাড়ে ১ হাজার ৮০০ বিচারক। সেই হিসাবে বিচারকপ্রতি মামলা প্রতিবছর দায়ের হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০। অর্থাৎ, বিচারকরা প্রচণ্ড চাপে থাকেন। অন্যদিকে, গত ১০-১২ বছরে আইনজীবীর সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। ফলে আইনজীবীদের বছরে গড় মামলাও অনেকটা কমেছে।
আবার বার কাউন্সিলও (আইনজীবীদের সনদ প্রদানকারী সরকারি সংস্থা) আইনজীবীদের সনদ দেওয়ার ব্যাপারে মান বজায় রাখতে পারছে না। তুলনামূলক কম দক্ষতাসম্পন্ন আইনজীবীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। ফলে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের ওপর নানাভাবে অহেতুক চাপ তৈরি হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে বিচারকাজ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিফলন ঘটছে বিচারক ও আইনজীবীদের প্রকাশ্যে তির্যক বাদানুবাদের মধ্য দিয়ে।’ তাঁর মতে, জেলা বারের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সার্বক্ষণিক পদ হিসেবে তাঁদের পদে থাকা অবস্থায় আইন পেশা থেকে বিরত থাকা উচিত। এটাই উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশের রেওয়াজ।
গত ২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুকের এজলাসে হট্টগোলের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। পরে সংশ্নিষ্ট বিচারকের পক্ষ থেকে বিষয়টি লিখিত আকারে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনকে জানানো হয়। প্রধান বিচারপতির নির্দেশে অভিযোগের বিষয়টি বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে পাঠান সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর আহমেদ ভূঞা, সম্পাদক (প্রশাসন) মো. আক্কাস আলী ও জুবায়ের ইসলামকে তলবসহ রুল জারি করেন হাইকোর্ট। ১৭ জানুয়ারি তাঁদের আদালতে হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।সূত্র-দৈনিক সমকাল।