কলঙ্কিত ২ অক্টোবর। ১৯৭৭ সালের এই দিন বিমানবাহিনী থেকে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের জের ধরে পরবর্তি ২ মাসে হাজার হাজার সৈনিককে ফাঁসি, ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়। বিষয়টি নিয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত কেউ টু শব্দটি করতে পারেনি।নানা ভয় ও ভীতির কারণে। লেখক ও গবেষক আনোয়ার কবির এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা ও অনুসন্ধান করেন এবং দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ২ অক্টোবর ১৯৯৬ সালে এ লেখাটি লিখেন। বলা যায় জেনারেল জিয়ার শাসনামলে বিমান বাহিনীতে যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়ছিল তা নিয়ে মিডিয়ায় এটিই প্রথম প্রকাশ। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে ” আইন আদালত” এর জন্য লেখাটি পুনরায় প্রকাশিত হলো। (সম্পাদক)
“গুলিবর্ষণের মধ্যে এগোতে না পেরে ফিরে এলাম ভি.আই.পি লাউঞ্জে। আর সেখান থেকেই দেখলাম এই বীভৎস দৃশ্য। হ্যাঙ্গারের সামনে কিছু জওয়ানের জটলা ছিল। তাদেরই কয়েকজন হ্যাঙ্গারের ভিতর থেকে অস্ত্রের মুখে বের করে নিয়ে এলো বিমান বাহিনীর একদল অফিসারকে। পরনে সবার ইউনিফর্ম, দু’হাত মাথার ওপর তোলা। ভি.আই.পি লাউঞ্জ থেকে কারও চেহারা স্পস্ট দেখা যাচ্ছিল না। শুধু দেখলাম, সবার সামনে যিনি ছিলেন তিনি খোঁড়াচ্ছিলেন। হাঁটতে পারছিলেন না। হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। তবুও অস্ত্রের মুখে এসে হ্যাঙ্গারের সামনে খোলা জায়গায় দাঁড়ালেন এক লাইনে। গুনে দেখলাম ওরা সাতজন। বেশ কয়েকজন জওয়ান অস্ত্র তাক করে দাঁড়াল ওদের সামনে। তখনই বুঝলাম ওরা ফায়ারিং স্কোয়াড, ওরা এই সাতজন অফিসারকে গুলি করে হত্যা করবে। বেশি দেরি করেনি জওয়ানরা। সবার হাতের অস্ত্র একসঙ্গে গর্জে উঠল। ওদের প্রথম শিকার হলেন লাইনের প্রথম অফিসারটি। যিনি খুড়িয়ে হাটছিলেন। দাঁড়াতে পারছিলেন না। পড়ে যাচ্ছিলেন। তারপর একে একে বাকি ছয়জন। গুলি খেয়ে মানুষ ছিটকে পড়ে এ কথাই জেনে এসেছি এতদিন। কিন্তু এদিন স্বচক্ষে দেখলাম, কেউ ছিটকে পড়ল না। ঘাতকদের গুলিবৃষ্টিতে টগবগে স্বাস্থ্যের এই তরুণ অফিসাররা সবাই লুটিয়ে পড়লেন টারমার্কের কংক্রিটে বাঁধানো শক্ত মাটিতে, নিজেদের রক্তের সলিলে।”
২ অক্টোবর ১৯৭৭। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাস্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান। এদিন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে সংঘটিত এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে এভাবেই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেন সিনিয়র সাংবাদিক মনজুর আহমদ। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পরে রাস্ট্রপতি জেনারেল জিয়া ডিজিএফআই প্রধান এয়ার মার্শাল আমিনুল ইসলামকে চাকরি হতে অপসারণ করেন। একইসঙ্গে তিনি ২২ ইস্ট বেঙ্গল, আর্মি ফিল্ড সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন, সিগন্যাল সেন্টার এন্ড স্কুল এবং আর্মি সাপ্লাই এ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়ন বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। জেনারেল মীর শওকত আলীকে যশোরে ৫৫ ডিভিশনের অধিনায়ক এবং জেনারেল মঞ্জুরকে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক হিসেবে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। এছাড়াও সশস্ত্র বাহিনীতে চালানো হয় এক ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী পরবর্তী দু’মাসের মধ্যে এ হত্যাযজ্ঞের শিকার হিসেবে ১১৪৩ জন সৈনিকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়, যার মধ্যে বিমান বাহিনীরই ছিল ৫৬১ জন। বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার এবং রুল ৩১ অনুযায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা হিসেবেই এই হত্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিসহ জেলে ঢোকানো হয় কয়েক’শ সৈনিককে।
এ সময় জেনারেল জিয়া বিদ্রোহী সৈনিকদের বিচার করার জন্য যে স্পেশাল সামরিক আদালত গঠন করেছিলেন তা করেছিলেন মূলত দ্রুত ফাঁসি কার্যকর করার জন্যই। কারণ বাংলাদেশ আর্মি ও এয়ার ফোর্স এ্যাক্ট অনুযায়ী শুধুমাত্র জেনারেল কোর্ট মার্শাল মৃত্যুদন্ড দিতে পারে। সুবিচারের স্বার্থে এ সামরিক আদালত উর্ধতন ও বিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত হতে হবে। তাই এ রকম কোর্ট মার্শালে জজ হিসেবে কমপক্ষে ৫ জন সামরিক অফিসার থাকতে হবে। জজদের মধ্যে একজনকে অন্ততপক্ষে লে. কর্নেল হতে হবে এবং বাকি চারজনের কেউই ক্যাপ্টেনের নিচে হতে পারবে না এবং ক্যাপ্টেন হিসেবে কমিশন প্রাপ্তির পর কমপক্ষে তিন বছর চাকরি অতিবাহিত করতে হবে। অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে। রাস্ট্রপতি জেনারেল জিয়া দেখলেন এই সকল নিয়ম-কানুন দ্রুত মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার উদ্দেশ্য সাধনের পথে বিরাট অন্তরায়। সেজন্য জিয়া একটি মার্শাল ল’ অর্ডার জারি করেন। ঐ অর্ডারে বিশেষ আদালতের নামে এমন কোর্ট সৃস্টি করা হয় যেগুলোতে বিচারের জন্য একজন লেঃ কর্নেলের সঙ্গে হাবিলদার ও নায়েক সুবেদারের মতো সৈনিক আদালতের জজ হন। এক কলমের খোঁচায় জেনারেল জিয়া রাতারাতি দুই ডজনেরও বেশি এই ধরনের কোর্ট সৃষ্টি করলেন। আর এ ধরনের আদালতে ন্যায় বিচারের প্রশ্নই উঠে না। এমন একটি কোর্টের উদাহরণ হলো মার্শাল ল ট্রাইব্যুনাল নং-১৮ ঢাকা। কেস নং-১/১৯৭৭, তাং ৮ই অক্টোবর ১৯৭৭। জজ- ঃ (১) লেঃ কর্নেল কাজী সলিমুদ্দিন মোঃ শাহরিয়ার, (২) সুবেদার মোঃ আবদুল হালিম, (৩) নায়েক সুবেদার আবদুল হাকিম, (৪) হাবিলদার আনোয়ার হোসেন, (৫) হাবিলদার এম এফ আহমদ। অভিযুক্তরা হলেন (১) ৬২৭৪০২৮ নায়েক এনামুল হক, (২) ৬২৮৪৫৪ সিগন্যালার কাজী সাইদ হোসেন, (৩) ৬২১১৮৬ নায়েক আব্দুল মান্নান, (৪) ৬২৮৪৭৩৬ সিগন্যালার এস কে জাবেদ আলী। বিশেষ সামরিক আদালত চারজনের সবাইকে মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করে। পরদিন ৯ অক্টোবর স্বয়ং জেনারেল জিয়া তাদের মৃতুদন্ডাদেশ অনুমোদন করে মন্তব্য করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা না মরে ততক্ষণ পর্যন্ত ওদের গলায় ফাঁসি ঝুলিয়ে রাখো। ১০ অক্টোবর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এ চারজন হতভাগ্য সৈনিককে হত্যা করা হয়। সে সময় ঢাকা জেলে সিকিউরিটি ওয়ার্ডের বন্দী রইস উদ্দীন আরিফ প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এই হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দেন এভাবে- “১৯৭৭ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা বিমান বন্দরে জাপান এয়ারলাইন্স-এর ৭০৭ বোয়িং বিমান হাইজ্যাকের উত্তপ্ত মুহূর্তে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর নিম্নস্তরের অফিসার ও জওয়ানদের মুস্টিমেয় কিছু লোক জেঃ জিয়ার বিরুদ্ধে একটি হঠকারী ক্যু-দেতা করার চেষ্টা চালায়। এই ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুষ্টিমেয় যে কয়জন অফিসার ও জওয়ান জড়িত ছিলেন তাদের সংখ্যা বড় জোর বিশ-পঁচিশ। কিন্তু এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে জেঃ জিয়া অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে যে পদক্ষেপ নিলেন তার ফলে এক রাতের মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হৈ হৈ, রৈ রৈ কান্ড বেঁধে গেল। বিমান বাহিনীর প্রায় তের শ’ অফিসার ও জওয়ানকে একরাতে পাকড়াও করে জেলে পোরা হলো। এমনিতেই আওয়ামী লীগ ও অপরাপর সংগঠনের হাজার হাজার কর্মী দিয়ে জেলখানা ঠাসা। তার ওপর বাড়তি তেরশ’ লোকের আগমণে জেলখানা জুড়ে তুলকালাম কান্ড শুরু হয়ে গেল। একে তো জেল ভর্তি সকল কয়েদী, হাজতী ও রাজবন্দী জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে দারুণ ক্ষ্যাপা। তার মাঝে জিয়া সরকারকে উৎখাতের জন্য সংঘটিত ক্যু-দেতার ‘নায়করা’ জেলখানায় ঢোকার পর সমগ্র জেলখানায় এক মারাত্মক থমথমে ভাব বিরাজ করতে লাগল। হয়ত এ কারণেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গ্রেফতারকৃত সৈনিকদের অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক রাতারাতি দেশের বিভিন্ন কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এর পরের ঘটনা এমন লোমহর্ষক, যা সে সময়ে যাঁরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন, আমি হলপ করে বলতে পারি, তাঁদের সবার কাছেই জেলখানার সে কয়টি বিভীষিকাময় রাতের স্মৃতি জীবনের এক দুঃস্বপ্নের স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে। সেই সব বিভীষিকাময় রাতের লোমহর্ষক ঘটনাবলী খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম বিশেষভাবে আমরা, যারা ছিলাম সিকিউরিটি ওয়ার্ডের বন্দী। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিকিউরিটি ওয়ার্ডের অবস্থানটি হলো কারা কর্তৃপক্ষের অফিসটি যেখানে ঠিক তার পাশেই। এই অফিসটিতে বসেছিল জিয়ার সংক্ষিপ্ত কোর্ট মার্শাল।
বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে অফিসার-সিপাইদের এক সাথে পনেরো বিশজন করে বুকে পিঠে আড়মোড়া দিয়ে বেঁধে বলির পাঁঠার মতো টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসা হচ্ছিল কোর্ট মার্শালের সামনে। তারপর এক তেলেসমাতি কান্ড। রামরাজত্বের বিচার। দুই মিনিটে রায়। ৯ জনের ফাঁসি, ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। আবার এই ফাঁসির হুকুম কার্যকরী করার সময়টি ছিল যেন রায় ঘোষণার সময়ের চেয়েও কম। পারেতো এক মিনিটেই ৯ জনকে একসাথে ঝুলায়। কিন্তু বাস্তবে তা কি আর সম্ভব? প্রথমত যাদের ফাঁসির হুকুম হলো তাদেরকে তো আগে বধ্যভূমিতে নিয়ে যেতে হবে। কোর্ট মার্শাল থেকে বধ্যভূমির দূরত্ব তাও নেহাৎ কম নয়। দেড় দু’শ গজতো হবে। কোর্ট মার্শাল থেকে বধ্যভূমিতে যাওয়ার পথটি ছিল আমাদের ওয়ার্ডের ঠিক পাশেই। তার জন্যই এ লোমহর্ষক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হতে পেরেছিলাম আমরা। একপাল ছাগলকে জবাই করার জন্য যেমন করে কসাইখানায় নিয়ে যাওয়া হয় এদেরকেও সেভাবে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্চে বধ্যভূমিতে। কিন্তু তফাতটি হচ্ছে- এরা অবুঝ জানোয়ার নয়, এরা মানুষ। এদের ফাঁসির হুকুম নিজেদের চোখের সামনেই ঘোষিত হয়েছে এবং দড়িতে ঝুলানোর জন্য তাদেরকে সে মুহূর্তে জোর করে টেনে নেয়া হচ্ছে বধ্যভূমিতে।”
প্রহসনমূলক এ বিচার ছাড়াও অনেক সৈনিক এবং অফিসারকে সরাসরি ফায়ারিং স্কোয়াড গঠন করে মারা হয়। এ ফায়ারিং স্কোয়াডের স্থান ছিল পুরনো বিমান বন্দর ও আশপাশের কিছু এলাকা। সে সময়ে এ সকল এলাকায় বসবাসকারী কিছু লোকের কাছ থেকে জানা যায, এ ঘটনার পরে প্রায রাতেই তারা ঐসকল হতভাগ্য সৈনিক ও অফিসারদের আর্তচিৎকারে ঘুমাতে পারতেন না। ফাঁসি দেয়া, ফায়ারিং স্কোয়াডে মারা কোন সৈনিক, অফিসার-কারও লাশই আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফেরত দেয়া হয়নি। একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, এ সকল হতভাগ্য সৈনিক এবং অফিসারের লাশ হেলিকপ্টারে করে সদ্য আবিস্কৃত (তৎকালীন সময়ে) জনমানবহীন “নিঝুম দ্বীপ”-এ নিয়ে সাগরে ফেলে দেয়া হয়। আবার কিছু লাশ সেনানিবাসগুলোর ভিতরেও পুঁতে ফেলা হয়।
“বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ইতিহাস”-শীর্ষক পুস্তকে এ অভ্যুত্থানের নিম্নোক্ত বিবরণ ছাপা হয়-
“২৮ সেপ্টেম্বর বিমানবাহিনী দিবসে পুরনো বিমানবন্দরের নিকটস্থ বিমানবাহিনী মেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। সামরিক বাহিনীর সকল পদস্থ কর্মকর্তাও এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। ২৭ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ.জি.মাহমুদকে এক চিঠিতে জানান, তারপক্ষে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা সম্ভব না। আগেরদিন ২৬ সেপ্টেম্বর একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় স্কোয়াড্রন লিডার ইসলামসহ আরও ২ জন মারা যায়। জাপানি রেড আর্মির ৫ সদস্য “হিদাকা কমান্ডো ইউনিটের” সদস্যরা ১৫৬ জন যাত্রীসহ জাপান এয়ারলাইন্সের একটি ডিসি-৮ বিমান ব্যাংককের পথে ঢাকা ত্যাগ করার পরই ঢাকায় অবতরণে বাধ্য করে। ঢাকায় এ নিয়ে ব্যাপক শোরগোল। বিমানবাহিনী প্রধান এজি মাহমুদকে বিমান ছিনতাইকারীদের সাথে আলোচনার দায়িত্ব দেয়া হয়। এই অবস্থায় বিমানবাহিনী দিবসের অনুষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। অনুষ্ঠান স্থগিত হওয়ায় তথাকথিত ২৮ সেপ্টেম্বরের ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এসময় বগুড়া সেনানিবাসের একটি রেজিমেন্টের সেনারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এতে দু’জন প্রাণ হারান। পরদিন পহেলা অক্টোবর ঢাকা সেনানিবাসেও উত্তেজনা দেখা দেয়। একটি ব্যাটালিয়নের কিছু বিপথগামী সৈন্য বিদ্রোহের উদ্যোগ নেয়। তাতে কতিপয় বিমানসেনাও যোগ দেয়। পহেলা অক্টোবর দিবাগত রাতে সেনা ও বিমানবাহিনীর সেনারা ২৫টি ট্রাক ও জীপ নিয়ে সেন্ট্রাল অর্ডন্যান্স ডিপোতে হানা দেয়। ২ অক্টোবর সকালে সাতটি ট্রাকে সেনা ও বিমানসেনারা রেডিও ষ্টেশন দখল করে এবং সেখানে তারা সিপাহী বিপ্লবে যোগ দেয়ার জন্য সর্বস্তরের মানুষকে আহ্বান জানান। একজন বিমানসেনা (সার্জেন্ট আফসার) নিজেকে নেতা ঘোষণা দিয়ে বেতারে বক্তৃতা দেন। দেশবাসী এই বক্তৃতা শোনার আগেই নবম ডিভিশন হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে সাভার ট্রান্সমিশন কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ইতোমধ্যে বিদ্রোহ নৃশংস রূপ নেয়। বিদ্রোহীরা বিমানবন্দর হ্যাঙ্গারের সামনে বিমানবাহিনীর দু’জন অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। বিমানবাহিনী প্রধানের সামনেই গ্রুপ ক্যাপ্টেন রাস মাসুদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিমানবাহিনী প্রধান কোনভাবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সেখানে গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনসার উদ্দিন চৌধুরী, উইং কমান্ডার আনোয়ার শেখ, স্কোয়াড্রন লিডার এ মতিন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শওকত জাহান চৌধুরী, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সালাহউদ্দিন, ফ্লাইং অফিসার আখতারুজ্জামান, পাইলট অফিসার এম এইচ আনসার, পাইলট অফিসার নজরুল ইসলাম ও পাইলট অফিসার শরিফুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহীদের গুলিতে স্কোয়াড্রন লিডার সিরাজুল হকের ১৬ বছরের তরুণ ছেলেও নির্মমভাবে মারা যায়।” এই পুস্তিকায় ঘটনার বিবরণে আরও বলা হয়েছে- এই বিদ্রোহ বেশি দূর আগাতে পারেনি। কারণ বিদ্রোহের নায়করা অন্যান্য ইউনিট হতে সৈন্যদের দলে টানতে সক্ষম হয়নি। অবিলম্বে দেশপ্রেমিক অনুগত সৈন্যদের সহায়তায় বিদ্রোহ দমন করা হয়। কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করার অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন ধারণা করা হয়েছিল যে, জাপানী বিমান হাইজ্যাকের সঙ্গে বিমানবাহিনীর এই বিদ্রোহের যোগসূত্র ছিল।
বিদ্রোহের অপরাধে সরকার অপরাধীদের প্রতি কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সরকার নির্দেশিত বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার এবং পরবর্তীকালে রুল ৩১ অনুযায়ী যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয় তাতে মোট ৫৬১ জন বিমানসেনাকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। যা এই ক্ষুদ্র বিমানবাহিনীর জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। এই বিচারে বেশ কিছুসংখ্যক এমওডিসিও বিভিন্ন দন্ডে দন্ডিত হয়। এদিনের ঘটনা সারা দেশের সশস্ত্র বাহিনী ও বিমানবাহিনীর জন্য “কালো দিন” ছিল বলে পুস্তিকায় উল্লেখ করা হয়। অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগে ফাঁসি হওয়া অনেক পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় যে, ফাঁসি হওয়া অনেকেই ঘটনার সময়ে ছুটিতে বাসায় অবস্থান করছিলেন। পরবর্তীতে তাদেরকে জড়ানো হয়। ফাঁসি দেয়া কোন ব্যাক্তিরই আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফাঁসির বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি। সম্ভবত ফাঁসি হওয়া একজন বিমান সৈনিক করপোরেল (corporal) আবদুল ওয়াদুদ B/D 440094 B.A.F Base Kurmitola -এর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, “অভ্যুত্থানের তিন হতে চার মাস পরে অফিস থেকে লোকজন এসে জনাব ওয়াদুদের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র দিয়ে যায় এবং বলে যায়, অভ্যুত্থানের পর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।” পরিবারের লোকজন অফিশিয়াল সহকর্মী, সহ-অবস্থানকারী ও বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে জানতে পারে যে, অভ্যুত্থানের পর প্রায় প্রতিদিন রাতেই বিমানবাহিনীর মেস থেকে বিমানসেনা এবং অফিসারদেরকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। তারা আর ফিরে আসত না। এ রকমই এক রাতে হামলা চালানো হলে মেসের সকলে বাতি নিভিয়ে খাটের নিচে যেয়ে লুকিয়ে পড়ে। শরীর অসুস্থ থাকায় খাটের ওপর সৈনিক ওয়াদুদ শুয়ে থাকেন। শায়িত অবস্থা থেকেই তাকে তুলে চোখ বেঁধে নেয়া হয়। তিনি আর ফিরে আসেননি। তারা আজও তার খোঁজ পাননি। এভাবেই ফাঁসির প্রায় সকল অফিসার, সৈনিক নিখোঁজ হয়ে যায় এবং আর ফিরে আসেনি। এদের আত্মীয়-স্বজন আজও এদের খবর পায়নি। তারা তাদের লাশ দেখাতো পরের ব্যাপার, তাদের মৃত্যু সংবাদটিও সরাসরি নিশ্চিত হতে পারেনি। অথচ এরা ছিল দেশমাতৃকার এক একজন গর্বিত সৈনিক। এ ঘটনার পরে প্রাণের ভয়ে শত শত বিমান সৈনিক এবং কিছুসংখ্যক বিমান অফিসারও বিমানবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন। বিমানবাহিনীর একজন সাবেক প্রধান থেকে জানা যায়, তিনি বিমানবাহিনীর প্রধান থাকা অবস্থায় এ সকল হতভাগ্য সৈনিক, অফিসারের নামের তালিকা তৈরি করান। এদের নামের তালিকা তৈরি করলেও তিনি পরিবারগুলোকে তাদের মৃত্যুর সংবাদ জানাতে পারেননি। আর এভাবেই চাপা পড়ে যায় এত মৃত্যু এবং লাশের খবর। ব্রিটিশ সাংবাদিক এন্থনি ম্যাসকারেনহাসের “এ লিগেসি অব ব্ল্যাড” বইয়ে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় এ মৃত্যুর খবর। এত মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হলেও এন্থনি ম্যাসকারেনহাস তার বইতে এই সকল মৃত্যু, মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা, মৃত্যুস্থান সম্পর্কে কিছুই জানাননি। পরবর্তীতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাস লিখতে গিয়ে বিমানবাহিনী হতে প্রকাশিত “বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাস”-শীর্ষক পুস্তকে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এদিনকে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য একটি “কালো দিন’” হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে জনগণ সর্বদা সঠিক ইতিহাস আশা করে। আশা করে পূর্বে বিভিন্ন সময়ে হঠাৎ করে রাজনৈতিক কারণে গায়েব হয়ে যাওয়া স্বল্প পরিচিত, সকল দলের নেতা-নেত্রীদের খবর জানতে। দেশে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কারণেই জনগণ এবং নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যাক্তির পরিবারবর্গের এ সরকারের কাছে এই আশা। তারা প্রত্যাশা করে সরকার কিছু করতে না পারুক অন্ততপক্ষে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে হলেও স্বল্প পরিচিত ও নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এই সকল ব্যাক্তির রহস্য উদঘাটন করবে। তেমনিভাবে ’৭৭ সালে সশস্ত্র বাহিনী হতে হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যাক্তিদের পরিবারবর্গও দীর্ঘ ১৯ বছর পর হলেও তাদের নিখোঁজ ব্যাক্তিদের খবর জানতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচিত এসরকার কি তাদের সেই আশা পূরণ করবে? না, পূর্ববর্তী সরকারগুলোর মতোই ধামাচাপা দিয়ে রাখবে ব্যাপারটি? এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে সরকার নিশ্চয়ই গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সমর্থন ও সহযোগিতা পাবে। আর এটি করা হলে এই সকল অফিসার ও সৈনিকের আত্মীয়-স্বজন বিদ্রোহের সঙ্গে ঐ হতভাগ্যদের জড়িত থাকা বা না থাকার সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে। এতে করে কাটবে তাদের মনের কুয়াশা। প্রয়োজনে তারা আইনের আশ্রয়ও নিতে পারবে। বর্তমান সরকার কি এ সৎ উদ্যোগটুকু নেবে? উদঘাটন করবে কি সশস্ত্র বাহিনীতে এ গণহত্যার কারণসমূহ? নাকি পূর্ববর্তী সরকারগুলোর মতোই কুয়াশাচ্ছন্নই রাখবে পুরো ব্যাপারটি?
তথ্যসূত্র
১.আন্ডার গ্রাউন্ড জীবন- রইসউদ্দীন আরিফ
২.এ লিগেসি অব ব্ল্যাড- এন্থনি ম্যাসকারেনহাস
৩.বর্ষপূর্তি সংখ্যা ’৯৩ -দৈনিক বাংলা