নার্সদের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলতে নির্দেশ দিয়েছেন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। গত ১৫ এপ্রিল এ নির্দেশ জারি করা হয়।
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে খাবার সঙ্কটসহ নানাবিধ সমস্যার কথা গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন একজন নার্স। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো। এই নার্সের অপরাধ তিনি সত্য বলেছিলেন। এ জন্য তাদের সবার মুখ বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। মনে হয় এই নার্সের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।
নোয়াখালি জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক আবু তাহেরকে শোকজ করেছে তার উর্ধতন কতৃর্পক্ষ। কারণ ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে তিনি বলেছিলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রুগিদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের চিকিৎসকদের পিপিই,মাস্ক কোনো কিছুই নেই। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি, স্বাস্থ্য সচিব প্রতিদিন বলে আসছেন পর্যাপ্ত পিপিই মাস্ক সব চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে শুধু নোয়াখালীর এই চিকিৎসকই নন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অনেক হাসপাতালেই পিপিই পাওয়া যায় নি। অনেক চিকিৎসকই এমন অভিযোগ করেছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলা গোপালগঞ্জের একটি হাসপাতালের চিকিৎসক জানিয়েছেন, তারা পিপিই মাস্ক কিছুই পাননি।
পিপিই পেয়ে থাকলে চিকিৎসকরা মিথ্যা বলবেন কেনো? চিকিৎসা নিয়ে তো অবহেলার কথা বলা হচ্ছে না। যে রোগের ওষুধই আবিস্কার হয় নি তার আবার চিকিৎসা হবে কেমনে? আনুষাঙ্গিক অন্যান্য উপসর্গের চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে। কিন্তু যে রোগটা ভয়ংকর ছুঁয়াচে সেটা জানার পরও পর্যাপ্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ছাড়া একজন চিকিৎসক রোগি দেখবেন কেনো? একজন নার্স সেবা দিবেন কেনো? তার কী জীবনের মায়া নেই?
কিন্তু এ সত্য বলতে পারছেন না চিকিৎসকরা।বললেই গর্দান নেমে আসছে, তাকে শোকজ করা হচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে। নোয়াখালীর চিকিৎসক আবু তাহেরের অপরাধ তিনি সত্য বলেছিলেন।
আমরা ভুলে যাইনি মিটফোর্ড হাসপাতালের সেই পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোর্শেদ রশিদের কথা। ২১ মার্চ যিনি নোটিশ দিয়ে জানিয়েছিলেন, সম্পদের স্বল্পতার কারণে পর্যাপ্ত মাস্ক না থাকায় চিকিৎসকরা যেনো নিজ নিজ উদ্যোগে তা সংগ্রহ করেন। এ নোটিশ প্রকাশ হলে হৈচৈ পড়ে যায়। কারণ একদিন আগেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি এমন কি মন্ত্রীও জানিয়েছিলেন, করোনা মোকাবেলায় সরকারের ব্যাপক প্রস্তুতির কথা আর পিপিই মাস্কের কোনো সংকটও নেই। কিন্তু মিটফোর্ডের পরিচালক যখন থলের বেড়াল বের করে দিলেন তখন গেলো গেলো রব ওঠলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে।
এ ঘটনায়ও ক্ষিপ্ত হন মন্ত্রণালয়ের বড় সাহেবরা। দুদিন পরেই মিটফোর্ডের সেই পরিচালককেও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এখানেও তার অপরাধ তিনি সত্য বলেছিলেন।
১৮ এপ্রিল বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপে বলা হয়েছে কোভিট -১৯ রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের ২৫ শতাংশ এবং নার্সদের ৬০ শতাংশ পিপিই পাননি। আর যারা পেয়েছেন সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন এবং মানদণ্ড অনুযায়ী এগুলো তৈরী হয় নি।
মানদণ্ড অনুযায়ী যে হয় নি তার প্রমাণও মিলছে। অনেক হাসপাতালের চিকিৎসকরা সেগুলো পরতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আইনশৃংখলা বাহিনী রাজধানীতেই অভিযান চালিয়ে ভেজাল মাস্ক,পিপিই উদ্ধার করেছে, কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। গণমাধ্যমে খবর এসেছে প্রভাশালী একটা সিন্ডিকেট এই ভেজাল এ নিম্নমানের পিপিই,মাস্ক তৈরির সঙ্গে জড়িত। এরা দেশের কারখানাতেই এন -৯৫ মাস্ক তৈরী করে ভুয়া আমদানি দেখিয়ে সরবারাহ করেছে। আশ্রয় নিয়েছে ভয়াবহ জালিয়াতির। প্যাকেটের গায়ে লেখা এন-৯৫ আর প্যাকেট খুলে পাওয়া যায় সার্জিক্যাল মাস্ক। মুগদা জেনারেল হাসপাতালে এসব মাস্ক পাওয়ার পর হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি এ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালককে চিঠি দিয়ে এর কারণ জানতে চান। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহিদ উল্লাহ জানান, এসব সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক। প্যাকেটের গায়ে ভুল করে এন-৯৫ লেখা হয়েছিল।
কি বিপজ্জনক কথা ! প্যাকেটের গায়ে সিল মারা একটা আর ভেতরে আরেকটা। কতোবড় জালিয়াতি।
এটা কী সাধারণ ভুল? যেখানে চিকিৎসকের জীবন মরণ প্রশ্ন। ডায়রিয়ার রোগীকে ক্যান্সারের ওষুধ খাইয়ে দিলে সেটা কী ভুল স্বীকার করলেই হয়ে যাবে? কারা এমন ভুল করলো? কেনো করলো? তা কী জানার অধিকার নেই দেশের নাগরিক হিসেবে?
কিন্তু না, তা না করে উল্টো হুমকি দেয়া হচ্ছে, এ নিয়ে লেখালেখি করলে ডিজিটাল আইনে মামলার করা হবে । তার মানে সত্য বলা যাবে না? প্রশ্ন তোলা যাবে না?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে জীবন বাঁচাতেও সত্য বলা যাবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরের সব কাজকে সঠিক বলতে হবে,সমর্থন দিয়ে যেতে হবে। অথচ স্তরে স্তরে তাদের ব্যর্থতা। তাদের কথা ও কাজে মিল নেই। এই ব্যর্থতার মাশুল পুরো জাতিকে দিতে হবে।
যেমন দিচ্ছে চীন আর চীনের কারণে ধুকছে বিশ্ববাসী। চীন যদি শুরুতেই মিথ্যার আশ্রয় না নিতো,লুকোচুরি না করতো তা হলে করোনাভাইরাস সারাবিশ্বে ছড়াতো না।
করোনা ভাইরাসের শুরুতেই গত ডিসেম্বরে চীনের উহানের একজন চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং এই ভাইরাসের কথা বলায় তাকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হয়। পরে তার মৃত্যু হয়। চীনের সাংবাদিক, চিকিৎসকরা এই ভাইরাস, মহামারী নিয়ে কোনো কথা বললে তার উপর নির্যাতন নেমে আসতো। অথচ চীন যদি শুরুতে তথ্য গোপন না করতো, তা হলে বিশ্ববাসীর আজ এ পরিণতি হতো না।
আমরাও কী চীনের পথ অনুসরণ করছি?