ঢাকা   শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১   সকাল ১০:৩৬ 

সর্বশেষ সংবাদ

২১ আগস্টের গ্রনেড হামলায় যেভাবে ফাঁসানো হয় জজ মিয়াকে : ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে আইনি নোটিশ

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় বিনা অপরাধে চার বছর কারাভোগ করা মো. জালাল ওরফে জজ মিয়া তাঁর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে উল্লেখ করে তাঁকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেনে।
জজ মিয়ার পক্ষে বৃহস্পতিবার রেজিস্ট্রি ডাকযোগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ হুমায়ন কবির ও মোহাম্মদ কাউছার এই আইনি নোটিশ পাঠান।স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ ১১ ব্যক্তি বরাবর এই আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
যাঁদের কাছে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে, তাঁদের মধ্যে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফজ্জামান বাবর, পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক খোদা বকশ চৌধুরী, সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশীদ, মুন্সী আতিকুর রহমান ও সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমিন রয়েছেন।
নোটিশে বেআইনিভাবে জজ মিয়াকে কারাবাসে রাখার জন্য লুৎফজ্জামান বাবর, খোদা বকশ চৌধুরী, আবদুর রশীদ, মুন্সী আতিকুর রহমান, রুহুল আমিন বা অন্য কোনো কর্মকর্তা বা ব্যক্তির দায় আছে কি না, তা নিরূপণে তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে।
জজ মিয়ার মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ায় লুৎফজ্জামান বাবর, খোদা বকশ চৌধুরী, আবদুর রশীদ, মুন্সী আতিকুর রহমান, রুহুল আমিন বা অন্য কোনো ব্যক্তি দায়ী হলে তাঁদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে নোটিশে। নোটিশ গ্রহণের ১৫ দিনের মধ্যে এসব বিষয়ে পদক্ষেপ জানাতে বলা হয়েছে। তা না হলে রিট দায়েরসহ প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে। নোটিশে বলা হয়, ২০০৪ সালের এই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ২০০৫ সালের জুনে জজ মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ মামলায় তাঁকে জজ মিয়া সাজিয়ে কারাগারে রাখা হয়। ২০০৯ সালের জুনে তিনি মুক্তি পান। কোনো দোষ ছাড়াই তাঁকে প্রায় চার বছর কারাগারে রাখা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে দলের নেতা-কর্মীসহ ২২ জন নিহত হন। আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ কয়েক শ নেতা-কর্মী।
শুরু থেকেই এ গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা হয়। প্রথমে শৈবাল সাহা পার্থ, পরে আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেসুর রহমানকে ফাঁসাতে না পেরে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে ধরে আনা হয় মো. জালালকে। তাঁকে দীর্ঘদিন রিমান্ডে রেখে ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে একটি সাজানো জবানবন্দি আদায় করা হয়।
যে ভাবে ফাঁসানো হয় জজ মিয়াকে :

জজ মিয়া। নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অসহায় এক রহস্য-যুবকের মুখ। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা যতটা আলোচিত; এর পর থেকে ততটাই আলোচিত এই ‘জজ মিয়া’ নামটি। গ্রেনেড হামলার হোতাদের আড়াল করতে আষাঢ়ে গল্পের ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হয়েছিল নিরীহ এই তরুণকে।
সে সময়ের তরুণ জজ মিয়া যৌবন পেরিয়ে এখন প্রৌঢ়ত্বে। ১৮ বছর পরও সেই দুঃসহ স্মৃতির ঘা তার মনে এখনো দগদগে। মুক্ত জীবনেও তাকে তাড়া করে ফেরে অজানা এক আতঙ্ক-আবার না পড়তে হয় সেই ঘাতকদের কবলে! এসব আশঙ্কা থেকেই পাল্টে ফেলেছেন নিজের নামও।
এখন তিনি ‘জালাল’ নামে পরিচিত। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম মো. জালাল আহমেদ। ড্রাইভিং লাইসেন্সেও ব্যবহার করেছেন এই নাম। ‘জজ মিয়া’ নামটি শুনলে নিজেই এখনো ভয়ে আঁতকে ওঠেন।
জজ মিয়া জানতেন না, কী ছিল তার অপরাধ। তবু রিমান্ডে নিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে নির্যাতন আর ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তাকে বাধ্য করা হয়েছিল সাজানো গল্পের ‘নায়ক’ হতে। ভয়াবহ এই হামলার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে। ২০০৫ সালে গ্রেপ্তার করা হয় জজ মিয়াকে। দুবছর আগে গণমাধ্যমে এক সাক্ষাতকার দেন জজ মিয়া। তাতে তিনি বলেন, গ্রেনেড হামলার কয়েক মাস পর তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তাকে গ্রেফতার করে মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে নিয়ে আসে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। কার্যালয়ে এনে ক্রসফায়ার করে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে সাজানো জবানবন্দি দিতে বলা হয় তাকে। তার সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলার হুমকি দেয় তৎকালীন সিআইডির কর্মকর্তারা। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবন বাঁচাতে সাজানো সাক্ষ্য দিতে রাজি হন তিনি। সিআইডির এক কর্মকর্তা তাকে একটি কাগজে জবানবন্দি লিখে দেন।
সেদিনের সেই গ্রেফতার ও রিমান্ডের রোমহর্ষক বর্ণনার শুরুতেই জজ মিয়া বলেন, ‘আমাকে নিয়ে তারা যে নাটক করেছে, এই নাটক যেন আর কারো সঙ্গে তারা না করে। আমার মতো কোনো ফ্যামিলি যেন এভাবে ঝরে না যায়। দোষ না করেও আমি আসামি হয়েছি। জীবন তছনছ হয়ে গেছে। এখন আমার একটাই চাওয়া- ওই ঘটনার যেন সঠিক বিচার হয়।’
জজ মিয়া বলেন, ‘গ্রেনেড হামলার দিন আমি নোয়াখালীর সেনবাগে বীরকোট গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। বাবুল চাচার চায়ের দোকানে বসে টিভি দেখে গ্রেনেড হামলার ঘটনা জানছি। এ নিয়ে আমরা স্থানীয় বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে তর্কবিতর্কও করছি। সন্ধ্যার পর বাজারে প্রতিবাদ মিছিলও করেছি। মিছিলে আমার সঙ্গে স্কুলের শিক্ষক, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও স্থানীয় অনেক লোক ছিল। সেই আমিই নাকি বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলা করেছি!’ জজ মিয়া বলেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার পরের বছর ২০০৫ সালের ৯ জুন সেনবাগ থানার কবির দারোগা আমাকে গ্রামের বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট করল। বলল, ঢাকায় আমার নামে মামলা আছে। এরপর আমাকে লকাপে ঢুকিয়ে রাখে। তিন চার ঘণ্টা পর ঢাকা থেকে সিআইডির অফিসাররা সেনবাগ থানায় যান। তখন অফিসাররা কবির দারোগাকে জিজ্ঞাস করলেন জজ মিয়া কোথায়? পরে লকআপ থেকে আমাকে বের করল। এরপর সিআইডি অফিসার উপস্থিত পুলিশের উদ্দেশে বললেন, আমি সিআইডির কর্মকর্তা আবদুর রশিদ। আপনারা সবাই রুমের বাইরে চলে যান। এরপর গামছা দিয়ে আমার চোখ বেঁধে আমাকে মারধর শুরু করল। বলল, তুই এত বড় একটা হামলা করে দেশে এসে বসে রইছস! মনে করছস তোকে ধরতে পারব না? এরপর আমাকে চোখ বেঁধে তারা থানা থেকে গাড়িতে করে ঢাকায় নিয়ে এলো।
আসার পথে প্রায় এক ঘণ্টা পর এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় আমাকে নামিয়ে বলল আমরা যেটা বলি, তুই সেটা স্বীকার করিস, আর না হলে তোর নামে চার-পাঁচটা মার্ডার কেস দেখিয়ে তোকে শীর্ষ সন্ত্রাসী বানিয়ে ক্রসফায়ারে দিয়ে দেব। আমি বললাম, স্যার আমি কী বলব, আমি কী জানি? তারা বলল, আমরা যেমনে বলব, সেভাবেই তোর শুনতে হবে। এ কথা বলে আবার আমাকে গাড়িতে ওঠায়। ঢাকায় এনে যখন আমার চোখ খুলল, তখন দেখি আমি একটা রুমের ভেতর আছি। আমি কোথায় আছি, আমি বলতে পারি না। আমার সামনে সাদা পোশাকধারী কয়েকজন অস্ত্র নিয়ে বসে আছে। আমি তখন রীতিমতো আতঙ্কে। এই বুঝি আমাকে মেরে ফেলে। পরে সিআইডি অফিসাররা বললেন, যেভাবে ঘটনা হয়েছে, তা তোকে শিকার করতে হবে। আমি বললাম স্যার, আমি যা জানি না, তা কীভাবে স্বীকার করব। তারা বললেন, আমরা যেভাবে বলব, সেভাবেই তোকে বলতে হবে। আমি বললাম, না স্যার। আমি যেটা জানি না, সেটা স্বীকারোক্তি দেব না।

এরপর দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে আমাকে ফ্যানে ঝুলিয়ে পায়ের তলায় পিটিয়েছে। আমার ডান হাতের হাড় ফাটিয়ে দিয়েছে। রিমান্ডে তারা ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছে। বলেছে, তাদের কথামতো যদি আমি স্বীকারোক্তি দিই, তাহলে বেঁচে থাকব। তা ছাড়া যত দিন আমি জেলে থাকব, তত দিন আমার পরিবারের ভরণপোষণ দেবে সিআইডি। ৩০ দিন নির্যাতনের পর তাদের কথায় রাজি হলাম। তারা আমাকে ঘটনাস্থলের ভিডিও দেখাল। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ছবি দেখিয়ে নাম মুখস্থ করাল।
জজ মিয়া বলেন, রিমান্ডে থাকার সময় বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমান নিয়মিত এসে আমার সঙ্গে দেখা করে ক্রসফায়ারের ভয় দেখাতেন এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা আমিই করেছি- এমন কথা বলতেন।
তিনি বলেন, সিআইডির কর্মকর্তারা বলতেন, এ ঘটনার সুরাহা করতে ওপর থেকে যথেষ্ট চাপ আছে, সে স্বীকার না করলে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হবে। এরপর আদালতে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করাল। আমি ভয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দায় স্বীকার করে তাদের শেখানো গল্প বলে যাই। আমি যে পয়েন্টটা ভুলে যেতাম, বলতে পারতাম না, ওইগুলো তারা আমাকে বলে দিত। জবানবন্দিতে আমি বলি, পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড়ভাইদের নির্দেশে আমি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নিই। বড়ভাইয়েরা হচ্ছেন সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ ও মুকুল। জজ মিয়া বলেন, আমি এসব সন্ত্রাসীকে কোনো দিন দেখিওনি। তিনি বলেন, আমি যে চাপে পড়ে স্বীকারোক্তি দিচ্ছি, তা বলার সুযোগও ছিল না। পাশেই সিআইডি কর্মকর্তারা বসা ছিলেন।
জজ মিয়া জানান, কারাগারে থাকার সময় সেনবাগ থানার দারোগা কবির হোসেনের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে মায়ের সঙ্গে সিআইডির কর্মকর্তা রুহুল আমিনের কথা হতো। সিআইডির ওই তিন কর্মকর্তা তাদের কথা অনুযায়ী জবানবন্দি দেয়ার প্রতিদানস্বরূপ তার মাকে তিন থেকে চার হাজার টাকা করে দিত।

এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৬ সালের আগস্টে এই নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস করে দেন জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন। জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলার রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথা ফাঁস করে দিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জজ মিয়াকে গ্রেফতারের পর থেকেই তার পরিবারকে মাসে মাসে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছে সিআইডি।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ মামলা তদন্তের নতুন করে উদ্যোগ নেয়া হয়। তদন্তে উঠে আসে, বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর সহযোগিতায় গোপন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) জঙ্গিরা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত