ঢাকা   শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১   রাত ৮:৫৩ 

সর্বশেষ সংবাদ

অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি ছিল না, ইউনাইটেডে আগুনে পুড়ে ৫ রোগীর মৃত্যু কর্তৃপক্ষের অবহেলায়ঃ ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত রিপোর্ট

রাজধানীর ইউনাইটেড হাসাপাতালে আগুনে পুড়ে ৫ রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় কর্তৃপক্ষের অবহেলাকেই দায়ি করা হলো। ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষ করে বুধবার এই রিপোর্ট দাখিল করে। এতে বলা হয়, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি না থাকা এবং ব্যবহার অনুপযোগী পুরোনা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র( এসি) থেকেই আগুন লাগে । সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ফায়ার সার্ভিসের এই তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর এখন স্পষ্ট হলো কথিত অভিজাত এই হাসপাতালটিতে রোগীদের নিরাপত্তায় কতো অবহেলা আর গাফিলতি ছিল।
গত ২৭ মে বুধবার রাতে গুলশান ২ নম্বরের ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আগুন লাগে। এতে করোনা ইউনিটে থাকা পাঁচজন রোগী আগুনে পুড়ে মারা যান। ওই পাঁচ জনের মধ্যে তিন জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। বাকি দু’জনের করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।
এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি তদন্ত শেষে বুধবার ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। মহাপরিচালক ওই তদন্ত প্রতিবেদন এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই করোনা ইউনিটে অগ্নিনির্বাপনের সরঞ্জাম ছিল না। ত্রুটিপূর্ণ জেনেও পুরনো শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) যন্ত্র বসানো হয় করোনা ইউনিটে। এসির বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকেই আগুন লাগে।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘ভষ্মীভূত করোনা ইউনিটটি অস্থায়ীভাবে তৈরি করা হয়েছিল। অবকাঠামো পারটেক্স দিয়ে তৈরি, যা অতিমাত্রায় দাহ্য। আগুন যখন লেগেছে তাৎক্ষণিকভাবে একসঙ্গে পুরোটায় লেগে যায়। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা নিজের প্রাণ বাঁচাতে সবাই বেরিয়ে নিরাপদে চলে যান। আগুন লাগার সময় রোগীদের বাাঁচানোর চেষ্টা করা হয়নি। ফলে আগুন লাগার পর একজন রোগীও বের হতে পারেননি। সেখানে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ অতিদাহ্য অনেক পদার্থ রাখা ছিল।’
তদন্ত কমিটির প্রধান ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত কমিটি মূলত আগুন লাগার কারন, অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থার দুর্বলতার বিষয়কে তদন্তে অগ্রাধিকার দিয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির বিবরণ এবং একইসঙ্গে প্রতিকারের সুপারিশ করা হয়েছে। তারা করোনা ইউনিটে কোনো ধরনের ফায়ার এক্সিট রাখেনি। সেখানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল।’
প্রসঙ্গত আগুনে পুড়ে ৫ জন রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতালের পক্ষ থেকে গুলশান থানায় অপমৃত্যুর মামলা করা হয়। পরবর্তীতে ৩ জুন
অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেন আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ভেরন এ্যান্থনী পলের জামাতা রোনাল্ড মিকি গোমেজ। দন্ডবিধির ৩০৪ (ক) ও ১০৯ ধারায় মামলাটি রেকর্ড করা হয়। মামলায় আসামী করা হয়েছে ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যান, এমডি ,সিইও,পরিচালক, সেদিন দায়িত্বপালনকারি চিকিৎসক নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের।
এর আগে গত ২ জুন এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনাইটেড হাসপাতালে ৫ রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন চায় হাইকোর্ট। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের ভার্চুয়াল কোর্টে দুই আইনজীবীর করা রিটের শুনানি শেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ফায়ারসার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স এবং পুলিশের আইজিকে ১৪ জুনের মধ্যে আলাদাভাবে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

গত ২৭ মে হাসপাতালটির করোনা ইউনিটে অগ্নিকাণ্ডে পাঁচজন রোগীর মৃত্যুতে বেড়িয়ে আসে থলের বেড়াল । এই হাসপাতালটিতে করোনা রোগী ভর্তি করা হতো না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চাপে হাসপাতালের আঙ্গিনায় জোড়াতালি দিয়ে একটা ইউনিট করা হয়েছিল। সেখানেই ভর্তি ছিলেন কয়েকজন করোনাআক্রান্ত রোগী।
অগ্নিকাণ্ডে পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনায় ওই দিনই হাসপাতাল পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত দল হাসপাতালটির অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় নানা অব্যবস্থাপনা আর অসঙ্গতি চিত্র দেখে বিষ্মিত হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামও হাসপাতালটি পরদর্শনে গিয়ে একই দৃশ্য দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ফায়ারসার্ভিসের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধনের নেতৃত্বে ৪ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে সংস্থাটি। কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে হাসপাতালটির অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কথা সাংবাদিকদের জানান। বলেন, হাসপাতালটিতে ১১ টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র পাওয়া গেছে যার মধ্যে ৮ টি যন্ত্রেরই মেয়াদ ছিলো না। এ ছাড়া ফায়ার ফাইটার, ফায়ার ড্রিল এবং ফায়ার টিমও ছিল না। হাসপাতালটিতে আগ্নিনির্বাপনের দায়িত্বে একজন কর্মকর্তা থাকলেও ঘটনার সময় তিনি ছিলেন অনুপস্থিত। ফলে ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকলেও সেটার মুখ খুলে দেয়ার মত কেউ ছিল না। আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন গিয়ে ফায়ার হাইড্রেন্টের মুখ খুলে দেয়।
ফায়ারসার্ভিসের তদন্ত কমিটি জানায়, হাসপাতালের আঙ্গিনায় যেখানে করোনা ইউনিট স্থাপন করা ছিল সেখানে বাতাস চলাচলের কোনো ভেন্টিলেশন ছিলনা, সবগুলো এসি ছিল নেগেটিভ প্রেসারের। এ ছাড়া পুরোটা জুড়ে বৈদ্যুতিক তার এলোমেলো করে রাখা ছিল, আর ছিল প্রচুর পরিমান হ্যান্ড স্যানিটাইজার । ফলে আগুন লাগার সাথে সাথে এসব দাহ্য পদার্থের স্পর্শে তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ারসার্ভিস কর্মকর্তারা এতোবড় হাসাপাতালটির অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত