রাজধানীর কলাবাগান থানা এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রীন লাইফ হাসপাতালের এক নারী চিকিৎসকের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সোমবার কলাবাগানের ৫০/১ ফার্স্ট লেনের নিজ বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহতের চিকিৎসকের নাম কাজী সাবিরা রহমান লিপি (৪৭)। তিনি গ্রীন লাইফ হাসপাতালের রেডিওলোজি বিভাগের চিকিৎসক ছিলেন। কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক রব্বানী বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, মরদেহ উদ্ধারের পর ওই বাড়িতে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ও মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ উপস্থিত হয়েছেন। তারা ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, চিকিৎসকের পিঠে দুটি ও গলায় একটি ধারাল অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনজনকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
ডিবি পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আজিমুল হক ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিহত সাবিরার গলায় ধারাল অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। পিঠেও দুটি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে এই ঘটনাকে আত্মহত্যা মনে হচ্ছে না।’
ডিসি আজিমুল আরও বলেন, ‘ডা. সাবিরা কলাবাগানের ৫০/১ ফার্স্ট লেনের বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। তিনি ফ্ল্যাটের দুটি রুম দুই তরুণীকে সাবলেট হিসেবে ভাড়া দেন। সকালে সাবলেটে থাকা এক তরুণী হাঁটতে বের হয়েছিলেন। হেঁটে আসার পর তিনি বাসায় ফিরে দেখেন চিকিৎসক সাবিরার রুম বন্ধ। রুমের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। পরে তিনি দারোয়ানকে ডেকে চাবি এনে রুমের তালা খুলে দেখতে পান চিকিৎসক সাবিরা ফ্লোরে পড়ে আছেন।’ পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা তদন্ত করছি। আশা করছি দ্রুত রহস্য উদঘাটন হবে।’
স্বজনেরা জানিয়েছেন, সাবিরা চট্টগ্রামের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএসটিসি) থেকে এমবিবিএস পাস করেন। তাঁর প্রথম স্বামী ২০০৩ সালে দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর ২০০৫ সালে বর্তমান স্বামী শামসুদ্দিন আহমদের সঙ্গে বিয়ে হয়। সাবেক এই ব্যাংকারের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি আলাদা থাকছিলেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে কলাবাগানের এ বাসায় ওঠেন তিনি। পাশেই তাঁর মা–বাবার বাসা। সাবিরার ২১ বছর বয়সী ছেলে নানা-নানির সঙ্গে থাকেন। আর ১৩ বছরের মেয়ে কখনো তাঁর সঙ্গে, কখনো নানা-নানির সঙ্গে থাকে। রোববার রাতে সাবিরা বাসায় নিজের কক্ষে একাই ছিলেন।
সাবিরার ফ্ল্যাটে তিনটি কক্ষ। একটি কক্ষে তিনি থাকতেন। বাকি দুটি কক্ষে দুই তরুণী থাকতেন। তাঁর ঠিক পাশের কক্ষে থাকা কানিজ ফাতেমা মডেলিং করেন। আরেকটি কক্ষে যে তরুণী থাকেন, তিনি ঈদের পর বাড়ি থেকে ফেরেননি। ওই তরুণী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়েন। পুলিশের কাছে সাবিরার বাসার সাবলেট থাকা তরুণী দাবি করেছেন, সকাল ছয়টায় তিনি হাঁটতে বেরিয়ে যান। তখন সাবিরার কক্ষের দরজা বন্ধ ছিল। সাড়ে নয়টায় ফিরে এসে তিনি ওই কক্ষ থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখেন। তখন তিনি দারোয়ানকে ডেকে আনেন। দারোয়ান ডেকে আনেন আরেক নারীকে। এরপর মিস্ত্রি ডেকে এনে দরজার তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন তাঁরা। তখন কক্ষটিতে আগুন দেখতে পেয়ে ফায়ার সার্ভিসে ফোন দেন। ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভানোর পর সাবিরার দেহ বিছানার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে। আগুন নিভিয়ে একটি চাদর দিয়ে দেহটি তারা ঢেকে যায়। এরপর কানিজ ফাতেমা কলাবাগান থানা–পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ এসে সাবিরার লাশ উল্টে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায়।
সিআইডির পরিদর্শক শেখ রাসেল কবির ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, সাবিরার গলার বাঁ পাশের নিচে দুটি গভীর কাটা রয়েছে। এতে তাঁর শ্বাসনালি কেটে গেছে। দুটি কাটা চিহ্ন রয়েছে পিঠের দিকে। আগুনে সাবিরার শরীরের পিঠের দিক পুড়ে গেছে। মারার পর তাঁকে পুড়িয়ে ফেলার একটা চেষ্টা ছিল। এটা ‘ক্লিয়ার মার্ডার’। মধ্যরাতে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনাটি অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগুন লাগার কোনো উৎস তাঁরা পাননি।
দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সাবিরা সবার ছোট। তাঁর এক ভাইয়ের স্ত্রী সুমনা হক ঘটনাস্থলে জানান,রোববার বিকেলে সাবিরা তাঁর মায়ের বাসায় গিয়েছিলেন। মেয়ের জন্য রান্নাবান্না করে সন্ধ্যায় তিনি বেরিয়ে আসেন। কাউকে তিনি অস্বাভাবিক কিছু বলেননি।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আজিমুল হক বলেন, ‘সবাই ভেবেছিলেন সাবিরা আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। পরে ডিবি পুলিশ এসে তাঁর শরীরে আঘাতের চিহ্ন পায়। আমরা তদন্ত করছি। চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আশা করছি, দ্রুত রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারব।