লকডাউনে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু রাখতে অসুবিধা কোথায়? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীরা। তারা বলছেন, ভার্চুয়াল কোর্টে বিচারক ও আইনজীবীরা নিজ নিজ বাসা বা চেম্বার থেকে বিচার কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন। স্বাস্থ্য বিধি মেনে দু’একজন স্টাফও রাখতে পারেন। কিন্তু তারপরও লকডাউনে ভার্চুয়াল কোর্টে বিচার কার্যক্রম বন্ধ রাখা হচ্ছে কেনো? লকডাউনে হাইকোর্ট বিভাগে মাত্র তিন প্রকৃতির তিনটি বেঞ্চ ভার্চুয়ালি খোলা রাখা হয়েছে। আর নিম্ন আদালতে একটি করে আদালত খোলা রাখা হয়েছে। এগুলোতে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেও প্রবেশ করতে পারছেন না এমন অভিযোগ বেশিরভাগ আইনজীবীর।
সরকারের দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনার জন্য আইন প্রণয়ন করা। এর ফলে বিচার ব্যবস্থা মামলা জটের কারণে যে স্থবির হয়ে পড়ার আশংকা ছিলো তার কিছুটা্ হলেও উত্তোরণের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু কোর্ট প্রশাসন এই উদ্যোগটি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে নি বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে সরকার ঘোষিত লকডাউনে আদালতের ভার্চুয়াল বিচার কার্যক্রমও বন্ধ থাকছে। এ নিয়ে নানামুখি আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে মামলার ভারে স্থবির হয়ে পড়া বিচার ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের জরুরী সেবার আওতায় আনা দরকার।
করোনা মহামারীতে দেড় বছরেরও বেশীসময় আদালতের স্বাভাবিক বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় মামলার ভয়াবহ জট তৈরি হচ্ছে। বিচার প্রার্থীরা দুর্ভোগে পড়েছেন। আইনজীবীরা পেশাগত আর্থিক অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। বিচারাঙ্গনে এই ত্রিমুখি সংকট দেশের আর সব অঙ্গনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বলাবলি হচ্ছে, করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একবারে বন্ধ হয়ে আছে, আর দ্বিতীয় বন্ধের তালিকায় আছে বিচারাঙ্গন। করোনাকালিন সময়ে হাসপাতাল, পুলিশ, ব্যাংক, সিভিল প্রশাসন, মিডিয়া থেকে শুরু করে বেসরকারি খাতের কার্যক্রমও কমবেশী চললেও স্থবির হয়ে গেছে বিচারালয়।
অথচ করোনা শুরু হওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যে সরকারের আইনমন্ত্রণালয় সশরীরের বিচারকাজের বিকল্প ভার্চুয়াল বিচার কাজ করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করে এক যুগান্তকারী নজির সৃষ্টি করে। এর ফলে আদালতে উপস্থিত না হয়ে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বিচারকাজ করার সুযোগ সৃস্টি হয়। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিচারাঙ্গনের সংশ্লিষ্টরা এই ভার্চুয়াল বিচার পদ্ধতি যথাযথভাবে কাজ লাগাতে পারছেন না। সব আদালত ভার্চুয়ালি চালাতে তারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে সরকার ঘোষিত লকডা্উনে বিচরকার্যক্রমও বন্ধ থাকছে। অথচ ভার্চুয়াল বিচারকার্যক্রম চলতে লকডাউন কোনো বাধা ছিলনা বলে মনে করেন আইন ও বিচারাঙ্গনের সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত গতবছরের মার্চ মাসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সারাদেশে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সবাইকে ঘরে অবস্থান করার নির্দেশনা জারি করে। ফলে দেশের অফিস আদালত করকারখানা ব্যবসা বাণিজ্য সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। চরম সংকটকালীন সময়ে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মামলা জট। কারণ দেশের আদালতগুলোতে এই সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রায় ৪০ লাখ মামলা বিচারাধিন। এর মধ্যে হাইকোর্টেই বিচারাধিন সাড়ে চার লাখ মামলা। আপিল বিভাগে আছে ২০ হাজারের বেশি। বাদবাকি নিম্ন আদালতে। আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রমের মধ্যেই এতো বিপুল সংখ্যক মামলা নিস্পত্তি কেমনে হবে এনিয়ে চিন্তায় চোখে সরষে ফুল দেখেন রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা। এর মধ্যে দিনের পর দিন আদালত বন্ধ থাকায় তা আরো বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই দুশ্চিন্তার আপাতত সমাধান হয়ে আসে ভার্চুয়াল কোর্ট। বিশ্বজুড়ে এই মহামারির মধ্যে পাশের ভারতসহ অনেক দেশের আদালতেই এই পদ্ধতি চালু করে ফেলে। বাংলাদেশ সরকারও বিশেষ করে, আইন মন্ত্রণালয় ত্বরিৎ উদ্যোগ নেয়। ২০২০ সালের ৯ মে আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। (অধ্যাদেশটি ৯ জুলাই আইনে পরিণত হয়)। ফলে অডিও-ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শারীরিক উপস্থিতি ছাড়া ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে বিচারকাজ পরিচালনার সুযোগ তৈরি হয়। অধ্যাদেশের বিধান অনুসারে, আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল কোর্টের জন্য পৃথক প্রাকটিস ডাইরেকশন, আইনজীবীদের জন্য ভার্চুয়াল কোর্টরুম ব্যবহার ম্যানুয়াল, অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালে ভার্চুয়াল শুনানি করতে বিশেষ প্রাকটিস নির্দেশনা প্রকাশ করা হয়। প্রাকটিস ডাইরেকশনসহ ম্যানুয়ালে ব্যবহারিক দিক-নির্দেশনা রয়েছে।
১১ মে (২০২০) থেকে ভার্চুয়াল আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর থেকে হাইকোর্টের পৃথক ১৩টি বেঞ্চে এবং আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্টে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বিচার কার্যক্রম চালু হয়। পরে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আপিল বিভাগের বিচারিক কার্যক্রমও পরিচালনা শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে নিম্ন আদালতেও জামিন ও অতি জরুরী ফৌজদারি মামলার শুনানি ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে হতে থাকে। আইনজীবী ও বিচারপার্থীরা কিছুটা হলেও স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেন।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে লকডাউনের ক্ষেত্রে। করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে গেলে তা ঠেকাতে সরকার দফায় দফায় লকডাউ্ন দিচ্ছে। লকডাউনে সবকিছু বন্ধ রাখা হয়। খোলা থাকে শুধু জরুরী সেবাসমুহ। হাসপাতাল ,আইনশৃংখলা বাহিনী, ব্যাংক,শেয়ার বাজার, বিদ্যুৎ,গ্যাস ,পানি, মিডিয়া এমন কী গার্মেন্টস শিল্পও খোলা রাখা হয়। কিন্তু বিচার ব্যবস্থা যেহেতু জরুরী সেবার আওতার মধ্যে পড়ে না ফলে বিচরালয় বন্ধ থাকে।
এ নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীরা। তারা বলছেন, ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে যদি ঘরে বসেই বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় তা হলে লকডাউনে তা বন্ধ থাকবে কেনো?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুপ্রিমকোর্টের বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, লকডাউন না থাকলেও ভার্চুয়াল পদ্ধতিকেই অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে এবং দেখা যাচ্ছে হাইকোর্ট বিভাগের ৩৫ থেকে ৩৮টি বেঞ্চে বিচার কার্যক্রম চলেছে। যদিও জরুরী মামলাই শুনানি হয় তারপরও আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা কিছুটা হলেও রিলিফ পাচ্ছেন। কিন্তু সরকার লকডাউন ঘোষণা করলেই ভার্চুয়াল কোর্টের সংখ্যা কমিয়ে দেয়া হয়। যেমন জুলাই মাসের প্রায় পুরোটাই লকডাউনে কাটলো এবং ৫ আগষ্ট পর্যন্ত লকডাউন। আর এই লকডাউনে হাইকোর্টে মাত্র ৩টি বেঞ্চে ভার্চুয়াল বিচার কার্যক্রমের জন্য রাখা হয়েছে। এটার কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না আইনজীবীরা। তারা বলছেন ভার্চুয়ালিই যদি হয় তা হলে সবগুলো বেঞ্চ চালু রাখতে সমস্যা কোথায়? একজন আইনজীবী জানান, হাইকোর্টে ৩ টি ভার্চুয়াল কোর্ট চালু রাখা হয়েছে। কিন্তু ৩ টা বেঞ্চ ৩ ধরণের মামলা শুনছে। সারাদিন অপেক্ষা করেও সিরিয়াল পাওয়া যায় না, মামলা শুনানি করা যায় না। একই অবস্থা নিম্ন আদালতের ক্ষেত্রেও। হাইকোর্টের ৩৮টি বেঞ্চ ভার্চুয়ালি পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও লকডাউনের সময় কেনো আগের মতো বেঞ্চ গঠন করা হলো না তার কোনো জবাব পাচ্ছেন না। একই ভাবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলে, চিফ জুডিশিয়াল ও ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট একটি করে চালু রাখারও কোনো যুক্তি আইনজীবীরা খুঁজে পাচ্ছেন না।
আইনজীবীরা বলছেন, ৪০ লাখ মামলা নিস্পত্তি আর মানুষের দুর্ভোগ কমাতে বিচারবিভাগকে জরুরী সেবার আওতায় আনতে হবে। এজন্য দ্রুত দেশের সব আদালত সশরীরে না হলেও ভার্চুয়ালি বিচার কার্যক্রম শুরু করতে হবে। না হলে বিচার বিভাগ ভেঙে পড়বে, ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পড়বে। বিচারের প্রতি যদি মানুষের অনীহা আসে তাহলে দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
উদ্বুত পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং সিনিয়র আইনজীবীদের নিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিশন গঠনেরও কথা বলছেন কোনো কোনো আইনজীবী। এই কমিশন মতামত দেবেন কীভাবে মামলা নিষ্পত্তি করা যায়।
আইনজীবীদের কথা, কোর্ট ম্যানেজমেন্ট যদি চায় তাহলে সশরীরেও কোর্ট চালানো সম্ভব। নিম্ন আদালতে এতো মানুষের ভিড় করার দরকার নেই। নির্দিষ্ট মামলায় আইনজীবীর মাধ্যমে যারা কেবল মামলার আসামি,তারাই হাজিরা দেবেন,এমন বিধান করা যেতে পারে।
সাধারণ আইনজীবীরা বলছেন,আদালত বন্ধ থাকায় তারা আর্থিক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। একই সঙ্গে বিচারপ্রার্থীরাও পড়েছেন দুর্ভোগে। একজন আইনজীবী জানান, তাঁর এক মক্কেল কারাগারে আছেন। জামিনযোগ্য মামলা। আরও ৩ মাস আগেই তার জামিন হয়ে যেতো। কিন্তু আদালতে তিনি আবেদনই করতে পারছেন না। বলেন যদি সবগুলো কোর্ট ভার্চুয়ালি চলতো তা হলে তিনি হয়তো আবেদন করতে পাতেন,শুনানি করতে পারতেন।
একজন আইনজীবী বললেন আরও কঠিন কথা। যদি লকডাউনে পুলিশ আসামী ধরতে পারে, তা হলে আসামির জামিন চাওয়ার জন্য আদালতও খুলে রাখতে হবে।
আইনজীবীরা গণমাধ্যমের লোকদের কাছে তাদের মনের কথা বলতে চান নাম প্রকাশ না করার শর্তে । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে মতামত প্রকাশ করছেন তারা। তাদের মধ্যে ভয়, কোনো কিছু বলে যদি আবার বিচারালয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েন। ইতিমধ্যে ফেসবুকে এ নিয়ে পোস্ট দেয়ায় হাইকোর্টের একজন আইনজীবী আদালত অবমাননার মুখে পড়েছেন। ফলে ভয় ও পেশার আতঙ্কে আইনজীবীরা প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারছেন না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা গুমরে মরছেন। সাধারণ আইনজীবীরা এ জন্য দেশের বিচারাঙ্গন ও সংবিধানের রক্ষক প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। তারা বলছেন, বাস্তবতা বিবেচনায় প্রধানবিচারপতি চাইলেই দেশের সব আদালত ভার্চুয়ালি চালু করার নির্দেশনা দিতে পারেন। তারা এ জন্য আইনমন্ত্রীরও সহায়তা চেয়েছেন।
BAR COUNCIL, SCBA & DBA
হাসপাতাল সহ অন্যান্য সকল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যেমন পুলিশ, ব্যাংক, নিউজপেপার ইত্যাদি সর্ব প্রকার লকডাউনে নিয়মিত খোলা আছে।
একই ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকল আদালত সর্ব অবস্থাতেই খুলে রাখার পক্ষে মতামত সৃস্টিতে কাজ করার লক্ষ্যে SCBA, Bar Council এবং DBA কে আলোচনায় বসার জোরালো আহবান জানাচ্ছি!
১৭ কোটি মানুষের এদেশে কোনো অবস্থাতেই আদালত বন্ধ রাখার পক্ষে আমি না।
আদালতের সঙ্গে জড়িত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এতদিনে টিকা দেওয়া হয় নি কেন?
Court is independent and not under the government. Constitutionally it is beyond the power of the government to declare dispensation of justice as ‘Essential service’