ঢাকা   শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১   দুপুর ২:২৬ 

সর্বশেষ সংবাদ

রেলওয়ের ৮০ ভাগ ইঞ্জিনের আয়ুশেষ, ৬৫ বছরের পুরোনো ইঞ্জিন দিয়ে গতি পাচ্ছে না ট্রেন, বিপর্যয়ের আশঙ্কা

রেলের ৮০ ভাগ ইঞ্জিনেরই আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। মেকানিক্যাল কোড অনুযায়ী রেলের একটি ইঞ্জিনের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ বছর। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ের বেশিরভাগ ইঞ্জিনের বয়স ৬০ থেকে ৬৬ বছর। এসব ইঞ্জিন দিয়ে ঠেলিয়ে ধাক্কিয়ে চলছে রেল। এতে করে রেল চলাচলের যেমন গতি পাচ্ছে না তেমনি এসব ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। ফলে রেলকে লোকসানি প্রতিষ্ঠান থেকে টেনে তোলা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন রেল সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন ৬৫ বছরের পুরোনো ইঞ্জিন দিয়ে কাঙ্খিত সেবা পাওয়া যাবে না।
রেল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী বর্তমান সরকারের আমলে অন্তত ৪শ অত্যাধুনিক যাত্রীবাহী কোচ আমদানি করা হয়েছে, যেগুলো ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতিতে চালানো সম্ভব ছিল। অথচ কেবল নতুন ইঞ্জিনের অভাবে অত্যাধুনিক এসব কোচ দিয়ে দ্রুতগতিতে ট্রেন চালানো যাচ্ছে না। পুরোনো ইঞ্জিন দিয়ে নতুন অত্যাধুনিক কোচের ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটারের বেশী গতি তোলা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন রেল চালকরা। এতে অত্যাধুনিক কোচগুলোও নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রেলসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৬৫ বছর আগে ১৯৫৩ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের বহরে জিএমবি-১২ মডেলের ৪০টি ইঞ্জিন আসে। এর পর ৬৬ বছর ধরে এসব ইঞ্জিন এখনো দেশের রেলপথে চলছে। নিয়ম অনুযায়ি এসব ইঞ্জিনের মেয়াদ ১৯৭৩ সালেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এর পর থেকে জোড়াতালি দিয়ে চলছে। সূত্রটি জানিয়েছে ২৭৩টি ইঞ্জিনের মধ্যে ১৯৫টিই মেয়াদোত্তীর্ণ। মেয়াদ আছে মাত্র ৭৮ টি ইঞ্জিনের। অনুসন্ধানে জানা যায়, রেলকে গতিশীল করতে সরকার ৩২৩ কোটি টাকা খরচ করে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১০টি ইঞ্জিন কিনলেও এগুলো কেনায় গুরুতর অনিয়ম হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিন না দিয়ে নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহ করেছে দক্ষিণকোরিয়ার হুন্দাই কোম্পানী। এর সঙ্গে রেলওয়ের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত।এ নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রমাণ পেয়েছে, লোকোমোটিভগুলোর দরপত্রের কারিগরি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান (ক্যাপিটাল কম্পোনেন্ট) ইঞ্জিন, অলটারনেটর ও ট্রাকশন মোটর সংযোজিত হয়নি। এছাড়া লোড বক্স টেস্টিং প্ল্যান্টের আওতায় ১১ ধরনের যন্ত্রাংশ সরবরাহের চুক্তি থাকলেও তা দেয়া হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, রেলওয়ের একটি অসাধু চক্রের অদৃশ্য সহযোগিতায় চুক্তি ভঙ্গ করে ইঞ্জিনগুলো দেশে আনা হয়েছে। এসব ইঞ্জিন ব্যবহারের জন্য রেলের ভেতর থেকেই আপত্তি ওঠে। আবার আরেকটি গ্রুপ, সংযোজন-বিয়োজন করে ইঞ্জিনগুলো কাজে লাগানো যায় কিনা এ প্রস্তাব দেয় এবং শেষ পর্যন্ত তারাই জয়ী হয়। নিম্নমানের ইঞ্জিনগুলোই চালানো শুরু করেছে রেলকর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক- এডিবি’র অর্থায়নে প্রায় ৩২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি রেল ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনার জন্য ২০১৮ সালের ১৭ মে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চুক্তি অনুযায়ী ১০টি মিটার গেজ ইঞ্জিন সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তির পর অগ্রিম পরিশোধ করা হয় ২৫ শতাংশ অর্থ। ইঞ্জিনগুলো দেশে আনার পর ৬৫ শতাংশ এবং গুণগত মান যাচাই শেষে বাকি ১০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের কথা। কিন্তু দেশে আসার পর ইঞ্জিনগুলো নিম্নমানের বলে ধরা পড়ে। এ অবস্থায় সাবেক প্রকল্প পরিচালক নূর আহমেদ হোসেন চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ অর্থ আটকে দেন। ওই অর্থ ছাড় না দেওয়ার জন্য সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ও এডিবিকে চিঠি দেন। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রেলওয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ লিখিতভাবেও উপস্থাপন করেন তিনি। কিন্তু এসব অভিযোগ নিস্পত্তি না করেই ত্রুটিযুক্ত ইঞ্জিন দিয়ে রেল চলাচলের কার্যক্রম শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। এ খাতে বড় ধরণের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ হলেও কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেল কর্তৃপক্ষ ‘বৈদ্যুতিক’, ‘বুলেট’সহ বিভিন্ন দ্রুতগতির ট্রেন চালুর ‘মহাপরিকল্পনা’ গ্রহণ করলেও বাস্তবতা হচ্ছে, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনের কারণে ট্রেনচলাচলে অচলাবস্থায় পড়ছে। গন্তব্যে পৌঁছতে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণের পাশাপাশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। হঠাৎ ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাচ্ছে,লাইনচ্যুত হচ্ছে ট্রেন। যদিও করোনাভাইরাসের কারণে গত দেড়বছর ধরে লকডাউনের কারণে রেল চলাচল অনেক ক্ষেত্রেই বন্ধ থাকছে। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রেল চলাচলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১০টি ইঞ্জিন কেনায় গুরুতর আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন রেলের সাধারণ কর্মচারীরা। একই সঙ্গে দ্রুত মান সম্পন্ন ইঞ্জিন আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি রেলে বিরাজমান দুর্নীতি রোধ করে ‘প্রায় অচল’ রেলে গতিসঞ্চারে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সচল হবে না রেল, এমনটাই মনে করছেন তারা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত