বিদেশে অর্থ পাচারকারী এমন ৮০ সরকারি কর্মকর্তাকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন, দুদক। কানাডার বেগমপাড়াসহ অস্ট্রেলিয়া,মালয়েশিয়া,সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারকারী এসব আমলাদের তথ্য আগামী ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টকে জানাবে সংস্থাটি। পাশাপাশি কিছু ব্যবসায়ির নামও রয়েছে তালিকায়, যারা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে গ্রিণ সিগন্যাল পাওয়ার পরই জোরেশোরে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।
অর্থ পাচারকারীদের সব ধরনের তথ্য চেয়ে হাইকোর্টের আদেশের জবাব তৈরি করতে গত সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেছে দুদক এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
বৈঠকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিন্যানসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট ও এনবিআরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, সবাই একসঙ্গে বসে ঠিক করা হয়েছে সবার বক্তব্যগুলো আমাদের দিলে, আমরা এটা এফিডেভিট করে আদালতে জমা দেবো । তথ্য যা আছে সেটাই দেওয়া হবে। সবাই আদালতের আদেশ মোতাবেক জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
গত ২২ নভেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এক আদেশে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের সব ধরনের তথ্য চেয়ে রুল জারি করেন। ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব, দুদক চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট
কর্তৃপক্ষের প্রতি রুলের জবাব দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, টাকা পাচার সংক্রান্ত দুদক যা করেছে তার এ টু জেড তথ্য উপাত্ত আদালতে দাখিল করা হবে। সে বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মহোদয়কে অবহিত করা হয়েছে।
বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের নিয়ে ১৯ এবং ২১ নভেম্বর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ওই রুল দিয়েছিলো হাইকোর্ট।
এর আগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)র এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, রাজনীতিবিদেরা নন, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকুরেরা। ’ গোপনে কানাডার টরেন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশিদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে, কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়, সেটিতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাদের ছেলে-মেয়েরা সেখানে থাকে। ’পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমার কাছে ২৮টি কেস এসেছে এবং এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন চারজন। এছাড়া কিছু আছেন আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী। আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করছি। পাচারে শুধু কানাডা নয়, মালয়েশিয়াতেও একই অবস্থা। তবে তথ্য পাওয়া খুব কঠিন। বিভিন্ন মিডিয়ায় যে তথ্য বের হয়, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, আসলে সংখ্যাটি তত নয়। ’পাচারের দায় বিদেশি সরকারও এড়াতে পারে না উল্লেখ করে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘যেমন সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে টাকা রাখলেন, সেই তথ্য আমাদের দেয় না। তারা ট্রান্সপারেন্সির কথা বলে, কিন্তু যদি বলি কার কার টাকা আছে, সেই তথ্য দাও, তখন তারা দেয় না। এটি একটি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। ’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এসব বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হলে হাইকোর্টের নজরে আসে বিষয়টি। আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। রুলে টাকা পাচারকারী সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
চার সপ্তাহের মধ্যে দুদক চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিনানসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট, এনবিআর চেয়ারম্যান এবং ঢাকা জেলা প্রশাসককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
এ রুল বিবেচনায় থাকা অবস্থায় বিদেশে টাকা পাচারকারীদের নাম-ঠিকানাসহ সব ধরনের তথ্য (মামলাসহ, কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা) প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে দুদক চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিনানসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট, এনবিআর চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
টাকা পাচারকারি আমলা ব্যবসায়ি ঃ
কানাডার বেগমপাড়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর টনক নড়ে দুদকের। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে গ্রিণ সিগন্যাল পাওয়ার পর মাঠে নামে দুদকের একটি চৌকস দল। একজন পরিচালকের নেতৃত্বে এই দলটি অনুসন্ধান শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে বিদেশে অর্থ পাচারকারী এমন ৮০ সরকারি কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হয়। এদের বেশিরভাগই প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। যাদের অনেকেই চলে গেছেন অবসরে। এসব কর্মকর্তা বিদেশে বিপুল সম্পদ পাচার করেছেন। তাদের স্ত্রী সন্তানরাও সেখানে থাকেন। দেশেও রয়েছে তাদের বিপুল সহায় সম্পদ। সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রয়েছেন কিছু ব্যবসায়ি, রয়েছেন মিডিয়া ব্যবসায়িও। এরা বিপুল পরিমাণ ব্যাংক লোন নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছিন। দুদকের জালে এদেরও আটক করার চেষ্টা চলছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে সবকিছুই স্পষ্ট হবে ১৭ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে কি জবাব দাখিল করা হয় তার ওপর।