ঢাকা   শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১   সকাল ১১:৫১ 

সর্বশেষ সংবাদ

“স্যরি মি. মোশতাক আমি তোমাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সম্বোধন করতে পারলাম না, তুমি অবৈধ” বঙ্গভবনে খুনিদের সামনে গর্জে ওঠে বলেছিলেন অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধ ভাবে ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপতি হয়ে খন্দকার মোশতাক সংসদ ভেঙ্গে দেননি। তাঁর ইচ্ছে ছিল সংসদীয় দলের সভা ডেকে তিনি সংসদ নেতা হবেন, প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করবেন। তাই বঙ্গভবনের সম্মেলন কক্ষে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভা আহ্বান করেন। আওয়ামী লীগের ২৯৩ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে প্রায় ১০০ জনের মত সদস্য সেখানে উপস্থিত হন। বঙ্গভবনের সম্মেলন কক্ষে সভা শুরু হয়। মঞ্চে মোশতাক, আর তার দু পাশে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দাঁড়ানো মেজর ফারুক ও রশিদ। সভা শুরু করে মোশতাক বললেন, তাকে সংসদ নেতা নির্বাচন করার জন্য এবং বাকশাল বিলুপ্ত ঘোষণা করলেন। বলেন দেশ এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় চলবে, এজন্যই তিনি সংসদ বহাল রেখেছেন।
মোশতাকের বক্তব্যের পর পিন পতন নীরবতা। কারো মুখে শব্দ নেই। তার বক্তব্যের জবাব যারা দিতে পারতেন, সেই জাতীয় চার নেতা জেলে। অত্যন্ত ভীতিকর পরিবেশে নিরবতাকে ভঙ্গ করে সদস্যদের মাঝামাঝি জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও কুমিল্লার ব্রাহ্মণ বাড়ীয়া থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক ।
প্রথমেই তিনি বললেন, ‘খন্দকার তোমার দুই পাশের ওদের সরে যেতে বল’। অস্ত্রধারী দুই মেজর হক সাহেবের কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল। পরে মোশতাক ইঙ্গিত দিলে মেজররা রুমের বাইরে চলে যায়। তারপর অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক কোনো ভূমিকা না করে মোশতাককে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন ‘মুজিবকে কেন খুন করেছো?’ স্যরি মি. মোশতাক,আমি তোমাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সম্বোধন করতে পারলাম না, তুমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে অবৈধ । ক্ষোভে গর্জে ওঠলেন সিরাজুল হক। হন হন করে বের হয়ে চলে আসলেন বঙ্গভবন থেকে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনিচক্র যখন উল্লাসে মত্ত সেই বিপদসংকুল সময়ে খুনিদের চোখের ওপর চোখ রেখে গর্জে ওঠতে পেরেছিলেন অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই আইনজীবীর মৃত্যু বার্ষিকী ২৮ অক্টোবর। ২০০২ সালের এই দিনে পরলোকগমন করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সিরাজুল হক ছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সহচর। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি। সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে এমএনএ, ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ও ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কসবা-বুড়িচং নিয়ে গঠিত তৎকালীন কুমিল্লা-৪ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

সিরাজুল হক ১ আগস্ট ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) তৎকালীন কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার পানিয়ারূপ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।  তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহপাঠী ছিলেন। ১৯৫২ সালের  ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।
সিরাজুল হক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহপাঠী। একই সঙ্গে পড়েছেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল মধুর, সিরাজুল হকের ডাক নাম বাচ্চু। বঙ্গবন্ধুর ডাক নাম খোকা। দুজনের মধ্যে সম্বোধন ছিল ডাক নামেই। সিরাজুল হক হাজী মুহাম্মদ মহসিন বৃত্তি পেয়েছিলেন। তা দিয়েই তিনি লেখাপড়া করেছেন।
১৯৭২ সালে ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে গঠিত সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন।
১৯৭৯ সালে দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল এমএজি ওসমানীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে তিনি সক্রিয় ছিলেন। নির্বাচনে জেনারেল ওসমানী হেরে গেলে তিনি দীর্ঘদিন রাজনীতি থেকে নীরব ছিলেন এবং নিজের আইন ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন।
অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক তার বন্ধু সহপাঠী শেখ মুজিবের রক্তের ঋণ শোধ করেছিলেন জীবন সায়াহ্নে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী হিসেবে মামলা পরিচালনা করে। ক্ষুরধার আইনী যুক্তি দিয়ে ২১ বছর পর প্রমাণ করতে পেরেছিলেন অপরাধীদের নৃশংসতা। হয়েছে তাদের মৃত্যুদণ্ড। শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাই নয়, জাতীয় চার নেতা, যারা ছিলেন এডভোকেট সিরাজুল হকের রাজনৈতিক সহচর তাদের হত্যার বিচারের জন্যও আইনী লড়াই নামেন। বিচার হয় জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের।
ব্যক্তিগত জীবনে সিরাজুল হক জাহানারা হককে বিয়ে করেন। তিনিও স্বামী সিরাজুল হকের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কিছুদিন আগে পরলোকগমন করেন জাহানারা হক। তারা ছিলেন দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক জননী । বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক তাঁদের সন্তান। ( তথ্যসূত্র – উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন মাধ্যম)।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত