ঢাকা   শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১   বিকাল ৪:৪৩ 

সর্বশেষ সংবাদ

টেংরাটিলায় গ্যাস কূপ বিস্ফোরণে দায়ী নাইকো, ৮ হাজার কেটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে

সুনামগঞ্জের ছাতকে টেংরাটিলা গ্যাস অনুসন্ধান কূপ খননের সময় ২০০৫ সালে দুবার বিস্ফোরণের ঘটনায় কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকোকে দায়ী করে বিশ্ব ব্যাংকের আন্তর্জাতিক সালিশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউটের (ইকসিড) ট্রাইব্যুনাল থেকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দেওয়া ওই সিদ্ধান্তের ফলে নাইকোকে এখন টেংরাটিলা দুর্ঘটনার জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্সকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এ ক্ষতিপূরণের পরিমান ৮ হাজার কোটি টাকা হতে পারে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ রোববার একটি ভার্চুয়াল সংবাদ ব্রিফিংয়ে মামলার রায়ের খবর প্রকাশ করেন।

ইকসিডে এই সালিশি মামলায় বাংলাদেশের পক্ষের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার মইনুদ্দিন বলেন, “ওই বিস্ফোরণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়েছে সে বিষয়টি রিকগনাইজ করেছে ট্রাইব্যুনাল। এই ক্ষতির জন্য নাইকোকে দায়ী করেছে, তাদেরকে এর ক্ষতিপূরণ বাংলাদেশকে দিতে বলেছে।”

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের একটি ক্ষতিপূরণের দাবি ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেছে। তবে ট্রাইব্যুনাল ওই ক্ষতির সঙ্গে পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতির দিকটি যোগ করতে বলেছে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ব্রিফিংয়ে বলেন, “গত ১০ বছরে অনেক ডেটা হারিয়ে গিয়েছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করব আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নির্ভরযোগ্যভাবে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি ও পরিবেশগত ক্ষতি নিরূপণ করতে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের যে ক্ষতি হয়েছে তাও যুক্ত করা হবে।”
চলমান কভিড-১৯ মহামারী কেটে গেলে ক্ষতি নিরূপণের জন্য আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
ছাতকের টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়নে ২০০৩ সালে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে চুক্তি করে রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী কোম্পানি বাপেক্স। নাইকো সেখানে অনুসন্ধান কূপ খনন করার সময় ২০০৫ সালের জানুয়ারি ও জুন মাসে দুই দফা বিস্ফোরণ ঘটে।
সেই ঘটনায় গ্যাস মজুদ পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিরাট এলাকায় সম্পদের ক্ষতি হয়। সেজন্য নাইকোর কাছে ৭৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে পেট্রোবাংলা।
২০১০ সালের মে মাসে নাইকো পরিচালিত ফেনী গ্যাসক্ষেত্রটি বন্ধ হয়ে গেলে টেংরাটিলার জরিমানা আদায় না হওয়ায় নাইকোর গ্যাস বিল বাবদ পাওনা দুই কোটি ৭০ লাখ ডলার আটকে দেয় পেট্রোবাংলা। টেংরাটিলায় নাইকোর সম্পদও বাজেয়াপ্ত করে রাখা হয়েছে।
এরপর নাইকো ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সালিসি প্রতিষ্ঠান ইকসিডে দুটি মামলা করে। একটি গ্যাসের বকেয়া বিল আদায় সংক্রান্ত, অন্যটি টেংরাটিলা বিস্ফোরণে ক্ষতিপূরণ দাবির মামলার বৈধতা নিয়ে।
এর মধ্যে ক্ষতিপূরণ দাবির বিরুদ্ধে নাইকোর আবেদন ২০১৩ সালের অগাস্টে খারিজ করে দেয় ইকসিড। পরের বছর আরেক সিদ্ধান্তে এই সালিশি ট্রাইব্যুনাল জানায়, টেংরাটিলায় বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে ফায়সালার আগে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাওনা অর্থ নাইকো পাবে না।
নাইকো এরপর এ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুললে ২০১৯ সালে তাও খারিজ হয়ে যায়। এক বছরের মাথায় টেংরাটিলার বিস্ফোরণের জন্য নাইকোকে দায়ী করে বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিল ইকসিড।
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, “ওই গ্যাস ক্ষেত্রের কার্যক্রমে নাইকোর অনেক ত্রুটি ছিল, তারা আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে কাজ করেনি। যেভাবে পেট্রোবাংলা বা বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে সে চুক্তি তারা ভঙ্গ করেছে। ট্রাইব্যুনাল এই কথাগুলো স্পষ্ট বলেছে।”
তিনি জানান, এর আগে গ্যাসের ক্ষতি বাবদ ১১৮ মিলিয়ন এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি বাবদ ৮৯৬ মিলিয়ন ডলারের একটি হিসাব ট্রাইব্যুনালে দেওয়া হয়েছিল। এর সঙ্গে এখন পরিবেশগত ক্ষতি ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতির হিসাব যোগ করা হবে।
“২০০৫ সালে ওই বিস্ফোরণের পর এখন পর্যন্ত সেখানে গ্যাস বের হচ্ছে। সুতরাং এখানে রাষ্ট্রীয় বা পেট্রোবাংলার ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। আন্তর্জাতিক এক্সপার্টরা সেটা যাচাই-বাছাই করে বের করবেন।”
আর ব্যারিস্টার মইন বলেন, “আগামী ছয় মাসের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। এর এক বছরের মধ্যে আমরা চূড়ান্ত রায় পাব।”
কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকো ইতোমধ্যে দেউলিয়া হয়ে গেছে। তাহলে ক্ষতিপূরণের টাকা সরকার কীভাবে আদায় করবে তা জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা।
উত্তরে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশের ৯ নম্বর ব্লকে নাইকোর যে শেয়ার ছিল বাংলাদেশ তার পুরোপুরি মালিকানা নিয়ে নেবে। এছাড়া ফেনী গ্যাস ফিল্ডে বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্যাসের বিল বাবদ নাইকো যে ৩০ মিলিয়ন ডলার দাবি করছে সেটারও নিষ্পত্তি হবে। এর বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তাদের যে সম্পদ আছে সেখান থেকে আমরা এ টাকা আদায় করার চেষ্টা করব।”
আইনজীবী মইন বলেন, ফেনী ক্ষেত্রের গ্যাসের বিল বাবদ নাইকোর দাবির পরিমাণ তিন কোটি ডলারের মত।
“আর ট্রাইব্যুনালের রায়ে বাংলাদেশের ইতোমধ্যে অন্তত এক বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য হয়েছে যা আরো বাড়বে। ফলে নাইকোকে আর কোনো টাকা বাংলাদেশের দিতে হবে না।
টেংরাটিলায় বিস্ফোরণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে তখনকার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেনকে নাইকো একটি এসইউভি গাড়ি ঘুষ দেয় বলে তখন সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
কানাডার একটি আদালতেও নাইকোর কর্মকর্তারা ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলে প্রতিষ্ঠানটিকে ৯৫ লাখ ডলার জরিমানা করা হয়।
বাংলাদেশের ৯ নম্বর ব্লকে নাইকোর ২৮০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের মালিকানা রয়েছে বলে জানানো হয় সংবাদ ব্রিফিংয়ে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত