১. জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড
আমাদের ফৌজদারী আদালত ফৌজদারী কার্যবিধি দ্বারা তৈরি। দণ্ডবিধি আছে– এখানে অপরাধের সংজ্ঞা ও অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান আছে। কিছু বিশেষ আইন আছে, বিশেষ অপরাধের জন্য বিশেষ শাস্তি ও বিচারের বিশেষ প্রক্রিয়া নির্দেশ করে এই আইনগুলো।আছে সাক্ষ্য আইনও– ঘটনা প্রমাণে সাক্ষ্য দেওয়া ও সাক্ষ্য উপস্থাপনের ও গ্রহণের প্রক্রিয়া নির্ধারণের জন্য। অপরাধ সংঘটিত হলে বিচার করার জন্য আইনের কোন অভাব আমাদের নাই। অভাব শুধু কোন কোন ক্ষেত্রে বিচারের বা ন্যায় বিচারের। আইন নিজস্ব গতিতে না চলে, চলে চালকের গতিতে- The whole system is more or less designed for this in the colonial era. কলোনিস্টরা গেলো, কিন্তু সেই আইন ও সিস্টেম থেকেই গেল।
ফৌজদারী অপরাধ সংঘটিত হলে তার বিচারের জন্য যেমন অসংখ্য আইন আছে, সেই আইন আবার বিচারের জন্য অসংখ্য ধাপও তৈরি করেছে। শুরু হয় অভিযোগ দাখিল দিয়ে, তারপর তদন্ত, শুনানি পার করে রায়– দোষী বা নির্দোষ। ফৌজদারী মামলার বিচারে দোষী সাব্যস্ত করতে হলে অপরাধ beyond reasonable doubt প্রমাণ করতে হয়। এ beyond reasonable doubt প্রমাণের একটা বড় বিষয় হলো ঘটনার তদন্ত। মামলা আদালতে বিচারে গড়ানোর আগেই তার গতিপথ ও ফলাফল অনেকটা নির্ধারণ করে দিতে পারে এ তদন্ত। এ কারণে ফৌজদারী অপরাধে তদন্ত যাতে ভালো করে হয় সেজন্য অনেক দেশেই তদন্তের জন্য স্বাধীন সংস্থা আছে। আমাদের দেশে পুলিশই তদন্ত করে। আর অভিযুক্তের রিমান্ড হলো তদন্তের প্রধান হাতিয়ার। সে হাতিয়ারে মাঝে মাঝেই হাতি হয়ে যায় ঘোড়া, আর “লুকিং ফর শত্রুজ” হয়ে যায় জজ মিয়া। এটা যেন তদন্ত সংস্থা নয়, হাতি ঘোড়া আর জজ মিয়া উৎপাদনের কারখানা। আমাদের স্বাধীন বিচার বিভাগ এ কারখানার কাছে বড় অসহায়। এত প্রতিভার দেশে শিল্পে বাংলাদেশ কেন এত পিছিয়ে সেটাই মাঝে মাঝে বোধগম্য হয় না!
ফৌজদারী মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া আছে পাবলিক প্রসিকিউটার বা সরকারী উকিলের উপর। মামলার কৌঁসুলি চাইলে পুলিশি তদন্তকে টেক্কা দিতে পারে। কিন্তু টেক্কা দিতে হলে তো ঘটে মাল থাকতে হবে! কে না জানে সরকারী উকিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যোগ্যতার মাপকাঠিতে হয় না, তারা নিয়োগ পান তাদের খুঁটির জোরে। কাজেই সে খুঁটি নড়লে তারা নড়েন। নইলে তারা বসেই জাবর কাটেন। তদন্ত আর প্রসিকিউশন দুইকেই প্রভাবশালীরা প্রভাবিত করতে পারবেন এমন সুযোগ আছে। হয় কিনা জানি না তবে উপসর্গ তো দেখি। আমরা দেখেছি কোন কোন মামলার তদন্ত শুরু হয় ঠিকই কিন্তু শেষ হয় না কখনো। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকেও কোন তাড়া থাকে না। মামলায় তারিখের পর তারিখ পরে, কিন্তু মামলা বিচারে আর উঠে না। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার স্বাধীন বিচারকরা অসহায় ভাবে লিখে যান: দেখিলাম, শুনিলাম; দরখাস্ত মঞ্জুর করিলাম। The court dances to the music of the criminal justice apparatus. The essence of criminal justice is the speed of the investigation and the trial. বলা হয়,জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড। কিন্তু সেই দেরি করেও যদি শেষ পর্যন্ত যদি জাস্টিস হতো তাহলেও তো হতো। শুধু দেরি-ই হয়, জাস্টিস আর হয় না। সাগর–রুনির মামলার তদন্ত শেষ হয় না, তনুর মামলার বিচার শুরু হয় না।
সম্প্রতি আরও একটা অনুসঙ্গ যোগ হয়েছে। সোস্যাল মিডিয়া। ছোট বড় সব ঘটনাতেই সোস্যাল মিডিয়া সরব। সেখানে আছে পক্ষ, বিপক্ষ আর নিরপেক্ষ। সেখানে মামলার তদন্ত, শুনানী ও রায় সবই হয়ে যায় তীব্র গতিতে। আমি এতে খারাপ কিছু দেখি না। বিচার ব্যবস্থার উপর দ্রুত ও ন্যায় বিচার করার জন্য একটা চাপ তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের বিচার ব্যবস্থা এ চাপ নেওয়ার জন্য কতটা প্রস্তুত তা আমার জানা নাই। তবে সিম্পটম দেখে মনে হয় তারা খুব বেশি প্রস্তুত না। তার উপর আছে ডিজিটাল আইনের খড়া আর আদালত অবমাননার জ্বালা। বিচার মানে সেখানে দুই পক্ষ। বাদী আর বিবাদী। তৃতীয় পক্ষ হলো আমার মত আম পাবলিক। সোস্যাল মিডিয়ার আর আদালতের বিচারে এখানেই পার্থক্য। বিচার ব্যবস্থা মানলে বিবাদীকে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত নির্দোষ মানতে হয়। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের দেশে বিবাদী প্রভাবশালী হলে আরো বড় সুবিধা নিয়ে শুরু করে। সোস্যাল মিডিয়ায় অনেক সময় ভিকটিমের বিরুদ্ধে ন্যারাটিভ তৈরি করা হয়। ক্রিমিনাল জাস্টিস অ্যাপারেটাসগুলো তাতে সহযোগিতাই করে। আইনের ফাঁক-ফোকর প্রভাবশালীদের পক্ষেই কাজ করে। তদন্ত অনন্তকালেও শেষ হয় না, তদন্ত হলেও জজ মিয়ারা আবিষ্কার হয়ে যায়। বিচারের বাণী নিভৃতেই কাঁদতে থাকে।
২. জাস্টিস স্যুড বি সিন টু বি ডান
ঘটনা খুবই সামান্য। একটা মটর সাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট। উইটওয়ার্থ সাহেবের একটা মটর সাইকেল আছে, সেই মটর সাইকেলের পাশে আরেকটা আসন জুড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। তিনি রোমান্টিক মানুষ, তার একমাত্র স্ত্রীকে সে পার্শ্ব গাড়িতে বসিয়ে হাওয়া খেতে বেড়িয়েছেন। কিন্তু বিধি বাম। ম্যাকার্থি নামক আরেক ভদ্রলোকেরও একটা মটর সাইকেল আছে এবং সেই একই সময়ে তার সাইকেল খানা নিয়ে রাস্তায় বেরোনোর শখ হলো। সেখানে কোন সমস্যা ছিল না, কিন্তু পড়বি তো পর মালীর ঘাড়েই। ম্যাকার্থি সাহেব তার তার মটর সাইকেল উঠিয়ে দিলেন উইটওয়ার্থ সাহেবের গাড়ির উপর। বেশি কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। উইটওয়ার্থ সাহেব ও তার স্ত্রী সামান্য আহত হয়েছেন। কিন্তু যেহেতু স্ত্রী স্বয়ং পার্শ্বে উপবিষ্ট, এত সহজে তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না! মান সম্মান বলে কথা। দিলেন ক্ষতি পূরণের মামলা ঠুকে। সাক্ষ্য প্রমাণ বিচার বিশ্লেষণ বিবেচনা করে জজ সাহেবরা ম্যাকার্থিকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিলেন ১০ পাউন্ড জরিমানা। কিন্তু ম্যাকার্থিও কম যান না, বললেন ১০ পাউন্ড কোন সমস্যা না, তবে এখানে একটা কিন্তু আছে। বিচার এখানে ন্যায্য হয়নি। ঘটনা ঠিক হলেও বিচারের প্রক্রিয়াটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে। তিনি আপিল করলেন। তার যুক্তি হলো উইটওয়ার্থ সাহেব তার মামলা পরিচালনা করার জন্য যে ল ফার্মটিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন সাসেক্সের নিম্ন আদালতের ল ক্লার্ক সেই ফার্মের একজন অংশীদার। ঘটনা সেখানেই শেষ না, মামলার যেদিন শুনানি হয়, সেইদিন ক্লার্ক বাবুটি ছুটিতে ছিলেন।বদলি হিসেবে তার ছোটভাই ডেপুটি ক্লার্কের দায়িত্ব পালন করেন। ঘটনাক্রমে সেই ছোট ভাইটিও ছিলেন উক্ত ল ফার্মের একজন অংশীদার। ঘটনা এখানে শেষ হলেও ম্যাকার্থির খুব একটা আপত্তির কোন কারণ ছিল না। মামলার শুনানি শেষ, জজ সাহেবরা খাশ কামরায় চলে গেলেন। সেখানে তারা সাক্ষ্য প্রমাণ, বিচার বিশ্লেষণ ও বিবেচনা করে মামলার রায় ঠিক করবেন। কিন্তু ক্লার্ক সাহেবও জজদের পিছনে পিছনে খাশ কামরায় ঢুকলেন। ম্যাকার্থি সাহেবের আপত্তি ওখানেই। তার কথা হলো ল ক্লার্ক বাদীর মামলার উকিলের ল ফার্মের অংশীদার, তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। কাজেই এখানে ন্যায় বিচার বিঘ্নিত হয়েছে।
মামলা যখন আপিল শুনানিতে তখন সাসেক্সের জজ সাহেবরা এভিডেভিট দিয়ে বলেছেন, ল ক্লার্ক খাশ কামরায় থাকলেও তিনি কোন আলোচনায় অংশ নেননি, কাজেই মামলার রায় কোনওভাবেই তিনি প্রভাবিত করেননি। আপিল বিভাগ এভিডেভিট গ্রহণ করেছেন।তা সত্ত্বেও আপিল বিভাগ ম্যাকার্থির আপিল গ্রহণ করে নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে দিলেন। সেই আপিল মামলার একজন বিচারক ছিলেন লর্ড হিউয়ার্ট। তিনি রায়ে বললেন, ল ক্লার্ক আসলেই মামলার রায়ে কোন প্রভাব বিস্তার করেছিলেন কিনা সেটা এখানে মুখ্য বিবেচ্য নয়। মূল বিবেচ্য হলো, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাধারণের কাছে কী মনে হয়েছে সেটা। আদালতে ল ক্লার্ক যদি মামলার রায়ে প্রভাবিত নাও করে থাকেন, সেটা তো কেউ দেখেন নি। মানুষ দেখেছে তিনি খাশ কামরায় ঢুকেছেন। তিনি যেহেতু আলোচনার সময় খাশ কামরায় উপস্থিত ছিলেন কাজেই একটা সন্দেহ থেকেই যায়। তিনি বলেন: “nothing is to be done which creates even a suspicion that there has been a improper interference with the cause of justice”. ১৯২৪ সালের এ মামলায় লর্ড হিউয়ার্ট আরও একটি কালজয়ী উক্তি করেন। আইন আদালত বিচার নিয়ে যারা সামান্য ঘাটাঘাটি করেন তাদের সবারই জানা। ন্যায় বিচারের জগতে ১০ পাউন্ডের মামলার সেই উক্তিটি এখন একটা স্বত:সিদ্ধে পরিণত হয়েছে: “Justice should not only be done, but should manifestly and undoubtedly be seen to be done.” Rex v. Sussex Justices, [1924] 1 KB 256
আমাদের দেশের আইন ও বিচারে অবশ্য এ ম্যাক্সিমের তেমন কোন গুরুত্ব বা প্রয়োগ নাই। আমরা বীরের জাতি, সাহসী মানুষ। লুকোছাপার কোনও কারণ নাই। আমরা যা করি নীল আকাশের নিচেই করি। মটর সাইকেল এক্সিডেন্ট হলে আবার আদালতে যেতে হবে কেন, হাত থাকতে আবার আদালত কেন! তাও আবার যদি বউ সাথে থাকে। আমারে চিনিস, আমার দাদা দারোগা।। কোন রকমে মামলা যদি পুলিশ বা আদালতে গড়ায়, ক্ষমতার খেলা বেশ প্রকাশ্যই দেখা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা দেখি মামলার আগেই আসামী গ্রেপ্তার কিন্তু কোন কোন মামলায় আসামীকে টেলিভিশনে দেখা গেলেও পুলিশ খুঁজে পায় না। অনেক মামলার সরাসরি বা পোটেন্সিয়াল আসামীদের প্লেন ভাড়া করে সবার নাকের ডগার উপর দিয়ে হাওয়া খেতে বিদেশ চলে যেতে দেখা যায়। বিদেশ না গেলেও আমরা তাদের এখানে সদর্পে পুলিশের নাকের ডগার উপর ঘুরে বেড়াতে দেখতাম। ওই যে আমরা বীরের জাতি, সাহসী মানুষ। আমরা কিছু লুকিয়ে করি না। আকাম কিংবা শুকাম, সব কিছুই আমরা ঘোষণা দিয়েই করি। যেখানে জাস্টিস-এর কথাই আসে না, তার আবার দেখিয়ে বা না দেখিয়ে করার কি আছে। লর্ড হিউয়ার্টের কথা বলা এখানে কিছু সময় নষ্ট করা মাত্র।
৩. ভিকটিমের তথ্য প্রকাশে বিধি নিষেধ
রুদ্ধদ্বার বিচারে অভিযুক্ত ব্যক্তির উপর অবিচার, নিপীড়ণ, অত্যাচার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পাবলিকের চোখে যাই হোক না কেন, ফৌজদারী আইনে অভিযুক্ত যতক্ষণ পর্যন্ত দোষী প্রমানিত না হন, ততক্ষণ তিনি নির্দোষ হিসেবে বিবেচিত হন। কাজেই তাকে দোষী বিবেচনা করা যাবে না।কিছুদিন আগে ডেরেক শোভেনের বিচার দেখেছি টেলিভিশনে। বিচার শুরুর আগেই যে অকাট্য প্রমাণ তার বিরুদ্ধে ছিল, তাতে সে দোষী সাব্যস্ত না হলেই আমার ধারণা ডিফেন্সের আইনজীবীও অবাক হতেন। কিন্তু তাকে দেখলাম বেশ স্যুট কোট পরে আদালতে চেয়ারে বসে আছেন। বিচারের রায়ে যখন দোষী সাব্যস্ত হলেন, তখন পুলিশ তাকে হাত কড়া পরিয়ে নিয়ে গেল। আইনে যাই থাকুক, আমাদের দেশে এসব ক্ষেত্রে দুই ধরনের ব্যবস্থা দৃশ্যমান। কারও জন্য জামাই আদর বরাদ্দ আর কারও কারও কপালে জোটে গরু চোরের ট্রিটমেন্ট। বিষয়টা নির্ভর করে কার কতো টাকা আছে, সমাজে কার কী রকম দাম, কে কোন রাজনীতি করে তার উপর।
সে যাই হোক। আইন-বিচার-অপরাধ-শাস্তি ইত্যাদি নিয়ে যারা ঘাটাঘাটি করেন, তারা স্টার চেম্বার বা স্প্যানিশ ইনকুইজিশন এর কথা শুনে থাকবেন। স্টার চেম্বার ব্যবহার করা হতো রাজনৈতিক ত্যাদড়দের বিরুদ্ধে, অধিষ্ঠিত ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে গেলে ক্ষমতাশালীদের বিচারের জন্যই স্টার চেম্বার বিখ্যাত ছিল। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নির্মূলের জন্য স্টার চেম্বার। আর ধর্ম বাঁচানোর জন্য স্প্যানিশ ইনকুইজিশন, যারা মূলত অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্মের বিরোধিতা করতো তাদের শায়েস্তা করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। তবে প্রক্রিয়াগত দিক থেকে এবং আসল উদ্দেশ্য বিবেচনায় এই দুইয়ের মধ্যে বেশ মিল আছে। দুটোতেই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা মূল উদ্দেশ্য আর বিচার ছিলো অনেকটা গোপনীয়। পাবলিকের কোন স্থান ছিল না এ বিচারালয়ে। অত্যাচার, নির্যাতন করে স্বীকারাক্তি আদালত করা হতো, অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা জানতেনই কেন তাদের বিচার হচ্ছে। কিন্তু বিচার হতো এবং সাজাও হতো। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছিল না। উন্মুক্ত বিচার বা পাব্লিক ট্রায়াল এর ধারণা এ রুদ্ধদ্বার বা গোপন বিচারের ভয়াবহতার কারনেই আসে, মূলত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের হাত থেকে অভিযুক্তদের বাঁচানোর জন্য। বিচারালয় যেন অত্যাচারের হাতিয়ার না হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তি যাতে বিচারের নামে কোন রকম নির্যাতনের শিকার না হন তা নিশ্চিত করার জন্য পাবলিক ট্রায়াল আবিষ্কার করা হয় যা আজকের যুগে প্রায় সব ফৌজদারী আদালতের পূর্বশর্ত।
উন্মুক্ত বিচার মূলত অভিযুক্তের উপর অন্যায় রোধ করার জন্য। আমাদের দেশে পরিষ্কার আইন আছে। আমাদের সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে যেমন বলা আছে: “ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইবুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী হইবেন।” তবে যারা অপরাধের ভিকটিম তাদেরও যে মামলায় স্বার্থ থাকতে পারে, ফৌজদারী অপরাধ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ সেই দোহাই দিয়ে তা আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। কাজেই ভিকটিম বা সাক্ষী সুরক্ষার তেমন কোন ব্যবস্থা আমাদের আইনগুলোতে চোখে পড়ে না। প্রকাশ্য বিচারে অভিযুক্তের যেমন লাভ আছে, বাদীর বা ভিকটিমের তেমন ক্ষতিও হতে পারে। বাদীর ক্ষতির দিকগুলোও বিবেচনায় নেওয়া দরকার। সেই বিবেচনা থেকেই মনে হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ২০(৬) ধারা অনুযায়ী একই আইনের ৯ ধারার মামলায় (ধর্ষণ, ধর্ষণ জনিত কারণে মৃত্যু) কোন পক্ষ আবেদন করলে বা ট্রাইবুনাল স্বীয় বিবেচনায় যথার্থ মনে করলে রুদ্ধদ্বার বিচার অনুষ্ঠান করতে পারবে এ বিধান করা হয়েছে। একই রকম বিধান আছে শিশু আইন, ২০১৩– তে। আইনের ২৩ ধারা অনুযায়ী শুধু অনুমতি প্রাপ্ত ব্যক্তিরাই আদালতে উপস্থিত থাকতে পারবেন।
রুদ্ধ বা খোলা যে দ্বারেই বিচার করা হোক না কেন বিচারক ও আইনজীবীসহ সবাই জানেন, নারী ও শিশু ট্রাইবুনালে বিচারে কী হয়। আমার অভিজ্ঞতা হয়েছিল কিছুদিন এ নাটক দেখার। জেলা শহরে অনেক ভাল আইনজীবী আছেন। ভালো আইনজীবীর খরচও ভালো, সবাই তাদের পোষাতে পারেন না। তবে আমার অভিজ্ঞতায় জেলা শহরের বেশির ভাগ আইনজীবীই আইনের ধার ধারেন না। আদালতের এজলাস তাদের কাছে কলতলা। আইন কানুন ভুলে গিয়ে ট্রাইবুনালের কল তলায় ভিকটিমের চরিত্র হনেনর কাজে নেমে যান তারা। সে যে ভাষা এবং কাহিনী! ভিকটিম যদি ভাগ্যগুণে বেঁচে যান এবং কোর্টে উপস্থিত থাকেন, তাহলে তার বেঁচে থাকার শখ মিটে যাবে। ধর্ষণের মামলার ঘটনার যে অনুপুঙ্খ বর্ণনা উকিল সাহেবরা হাজির করেন, তাতে ধর্ষণ বিষয়ে তাদের জ্ঞানের গভীরতার তারিফ করতে হয়। ভাবখানা এমন যে ভিকটিমের চরিত্রে একটু কালিমা লিপ্ত করতে পারলেই মামলা জেতা যাবে। আইন কিন্তু সেকথা বলে না। আইন অপরাধের সংজ্ঞা দিয়েছে, তার শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করেছে এবং বিচার প্রক্রিয়ার কথা বলে দিয়েছে। ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা নাই- যৌনকর্মীকে ধর্ষণ করলে সেটা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে না। একজন চোরকে খুন করলে সেটা মার্ডার কেইস হবে না। আইন খুব সোজা, খুন খুনই, ধর্ষণ ধর্ষণই। ভিকটিম আল্লার ওলি বা চোর যাই হোক তাতে কিছু আসে যায় না। অভিযুক্তের বিচারে তাতে কোন প্রভাব পড়বে না।
তবে এ সমাজকে তো আমরা জানি। আর ভিকটিম যদি নারী হন এবং যৌন নিপীড়ণ বা নিগ্রহের এর স্বীকার হন, তাহলে অভিযুক্তের বিচারের চেয়ে ভিকটিমকে নিয়েই আমাদের আগ্রহ থাকে বেশি। তিনি কি মাছ দিয়ে ভাত খান, তিনি চা-তে কত চামচ চিনি খান- সবই আমাদের জানা দরকার। আমার নিজের পরিবারে আমি কী শিখলাম তা বেমালুম ভুলে গিয়ে ওই ভিকটিম নারীটির পরিবার তাকে কোন নৈতিকতা শেখালো না এ দু:খে অনেকে প্রায় আত্মহত্যা করে ফেলেন।
কাজেই অন্য অপরাধের ক্ষেত্রে না হলেও যৌন নিপীড়ণ ও নিগ্রহের ক্ষেত্রে ভিকটিমের আইডেন্টিটি প্রকাশে সতর্ক হওয়া দরকার এবং কিছু বিধি নিষেধ থাকা দরকার। আমাদের আইনে কিছু বিধানও আছে। যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১৪ ধারায় এই আইনের অধীন কোন অপরাধের শিকার হলে সেই নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য পরিবেশন এমনভাবে করতে হবে যাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায় । শিশু আইনেও অনুরূপ বিধান আছে।
এখন প্রশ্ন হলো- ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ বিচারের জন্য কতটা প্রয়োজন এবং ভিকটিমের পরিচয় না প্রকাশ না করা প্রকাশ্য বিচারের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক কিনা। এ আলোচনায় যেসব কথাবার্তা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ফৌজদারী বিচার প্রক্রিয়ায় মূল আলোচ্য হলো সংঘটিত অপরাধ এবং বিচারে অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হয় নাকি নির্দোষ প্রমাণিত হয় সেটা। এখানে ভিকটিমের নাম, পরিচয়, কোথায় থাকেন, কি খান, কখন ঘুমান সেটা খুব একটা কাজে আসে না। বিচারের জন্য যতটা প্রয়োজন সেটা মূলত আদালতে প্রকাশ্য বিচারে যারা উপস্থিত থাকেন তারা জেনে যান। কাজেই প্রকাশ্য বিচারের নিয়মের সাথে, ভিকটিমের ব্যক্তিগত কথ্য গোপন রাখার সাথে তেমন কোন বিরোধ থাকার কথা নয়। কাজেই আমাদের দেশে ভিকটিমের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশের যে ব্যাপক আগ্রহ তা বিচারে কারও কাজে আসে না। সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংবাদ মাধ্যমের আগ্রহ মেটানোর জন্য। যত বেশি ব্যক্তিগত তথ্য, খবরের তত বেশি কাটতি। আর একটা বিষয় হলো ভিকটিমের ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশে বিধি নিষেধ সংবাদপত্রের তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতার সাথে সাংঘর্ষিক হয় কিনা। আমেরিকায় অনেক অঙ্গরাজ্যে তথ্য প্রকাশে বাঁধা দিয়ে আইন রয়েছে আবার কোন কোন মামলায় নিম্ন আদালত মামলা চলাকালীন ভিকটিমের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশে বাঁধা দিয়ে আদেশ দিয়েছেন। তবে উচ্চ আদালত বলেছেন এসব আইন বা আদেশ সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে দেওয়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী। তবে প্রাকটিস হচ্ছে বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম নিজে থেকেই যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণ মামলায় ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশে বিরত থাকে। আমাদের দেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আইন আছে, উচ্চ আদালতেরও কোন বিরুদ্ধ মত নাই, তারপরেও খুঁটিয়ে খুটিয়ে ভিকটিমের তথ্য প্রকাশ হয়। অনেক বড় বড় সংবাদ মাধ্যমেও হয়। (বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সৌজন্যে)।
*আমিনুল সজল
পুরো নাম আমিনুল ইসলাম সজল! বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশুনা করে কিছুদিন বাংলাদেশ বিচার বিভাগে কাজ করেছেন! পরবর্তীতে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ ল থেকে এল এল এম করেছেন। বর্তমানে দেশের বাইরে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেন! ছাত্র জীবনে ডেইলি স্টার এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন।