কানাডা’র বাংলাদেশী বেগমপাড়া একটি মিথ, এটি সুনির্দিষ্ট কোনো জায়গা নয়, আরও অনেক দেশেই রয়েছে এমন বেগম পাড়া। বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক, আমলা তাদের দুর্নীতির টাকা নির্বিঘ্নে পাচার করে কানাডা অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে বাড়ি গাড়ি কিনে স্ত্রী সন্তানদের রেখেছেন। দেশে লুট করা টাকা দিয়ে বিদেশের মাটিতে ভোগবিলাস করছেন। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোমের পর গত কয়েকবছর ধরে আলোচনায় এসেছে কানাডার বেগমপাড়ার খবর। সরকারিভাবেও এই বেগমপাড়ার দু্র্নীতিবাজদের কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন তারা অনুসন্ধান করে দেখেছেন, বিদেশে টাকাপাচারকারিদের মধ্যে রাজনীতিবিদদের চেয়েও সরকারি আমলাদের সংখ্যা বেশী। অর্থাৎ দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা পাচার করছেন সরকারি আমলারা বেশী। বেগমপাড়ার বিষয়টি এখন দুর্নীতির এক জ্বলন্ত উদাহরণ। দেশের দুর্নীতি দমন কমিশন,দুদক এসব বেগমপাড়ায় বসবাসকারিদের তালিকা চেয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর হয়েছে । কিন্তু আদৌ সেই তালিকা পাওয়া যাবে কি না, অনুসন্ধান হবে কি না, এ নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন সন্দেহ। তবে আশার কথা হলো দেশের এই লুটেরা, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন প্রবাসী অভিবাসীরা। যারা জীবিকার অন্বেষণে বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও সচ্ছলতার মুখ দেখতে পারেন না, অথচ দেশের এক শ্রেণির আমলা, রাজনৈতিক নেতা কোটি কোটি টাকা পাচার করে তাদের স্ত্রী সন্তানদের সেখানে বিলাসিতার মধ্যে রেখে দেশে নির্বিঘ্নে রাজনীতি, চাকরি করে যাচ্ছেন।
কানাডার বেগমপাড়া আসলে কি? কারা সেখানকার বাসিন্দা? এ নিয়ে লিখেছেন
সাবেক ছাত্রনেতা, লেখক, গবেষক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট ডঃ মঞ্জুরে খোদা। পড়ুন বিস্তারিত।
বেগমপাড়া কি?
বাংলাদেশের অসৎ-দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিকদের পরিবার কানাডার যে সব স্থানে বাসা-বাড়ী কিনে বসবাস করে সেসব স্থানকে কানাডার বাঙালিরা ‘বেগমপাড়া’ বলে অভিহিত করে। কানাডায় আসলে সুনির্দিষ্টভাবে ‘বেগমপাড়া’ বলে কোন জায়গা নেই। ‘বেগমপাড়া’ হচ্ছে বাংলাদেশের লুটেরা-দুর্নীতিবাজদের দ্বিতীয় আবাস ভূমির প্রতিকী নাম। বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে তাদের পরিবার এখানে আয়েশী, নিরাপদ ও বিলাসবহুল জীবনযাপন করে।
ছবি- বিবিসি বাংলা
কিভাবে এলো বেগমপাড়ার ধারণা?
অন্টারিও’র একটি ব্যয়বহুল ও অভিজাত ছোট শহর মিসেসাওগা। কানাডার বিখ্যাত লেক অন্টারিওর তীর ঘেসে টরন্টো শহরের পাশে এটি অবস্থিত। এই শহরের একটি বড় কন্ডোমিনিয়ামে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা বহু অভিবাসী পরিবার বসবাস করতো। এই সব পরিবারের কর্তারা কাজকর্ম করেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। আর স্বামীদের অনুপস্থিতিতে স্ত্রীদের নিঃসঙ্গ এবং কঠিন জীবন সংগ্রাম নিয়ে ভারতীয় পরিচালক রশ্মি লাম্বা একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন, যে তথ্যচিত্রের নাম ছিল ‘বেগমপুরা’। সেই ‘বেগমপুরা’ থেকেই বেগমপাড়া’র নামটি এসেছে।
বেগমপুরা থেকে বেগমপাড়া হলেও কাহিনী বিপরীত!
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে উচ্চবেতনে কাজ করা ভারত-পাকিস্তানের নাগরিকরা জীবনের এক সময় পরিবার নিয়ে অভিবাসী হয়ে কানাডায় চলে আসেন। কিন্তু কানাডায় এসে তারা তাদের পেশাগত যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পেয়ে কানাডায় পরিবার রেখে ফের মধ্যপ্রাচ্যেই চলে যান। সেখান থেকে অধিক আয়ের অংশ তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য পাঠান। আর তাদের স্ত্রীরা’ স্বামীর অনুপস্থিতিতে একাই কঠিন সংগ্রাম ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদের সন্তান ও পরিবারকে সামলিয়েছেন। তার মানে বেগমপুরার কাহিনী ছিল অনেক সংগ্রামের ও চ্যালেঞ্জের।
আর বাংলাদেশের কথিত বেগমপাড়ার কাহিনী তার বিপরীত। বাংলাদেশের বেগমদের সাহেবরা দেশে চাকরি, ব্যবস্যা-বাণিজ্য, রাজনীতি করে দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে তাদের অর্জিত অবৈধ আয় কানাডায় পাচার করে তাদের বেগমদের কাছে পাঠায়। আর তাদের বেগমরা-সন্তানরা এখানে অভিজাত এলাকার দামী বাসা-বাড়ী-গাড়ীতে বিলাশবহুল আয়েশি জীবনযাপন করেন।
সেই প্রতিকী বেগমপাড়াগুলো কোথায়?
বেগমপাড়া বলে বাস্তবে কানাডায় কোন পাড়া, মহল্লা, এলাকা না থাকলেও এখানে এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে এ সব অসৎ-দুর্নীতিবাজ বাংলাদেশীরা বসতি গেড়েছেন। কোথায় সে সব? সাধারণত যে সব এলাকায় বাংলাদেশীদের আনাগোনা নেই, স্থানীয় প্রবাসী পেশাজীবীরা বসবাস করেন না, সে সব এলাকাকেই তারা বেছে নিয়েছেন বসবাসের জন্য। এবং সে সব এলাকাতেই বাসা-বাড়ী, এপার্টমেন্ট কিনে বসবাস করছেন। যে স্থানগুলোকে এখানকার অভিজাত এলাকা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
জানা যায়, টরন্টোর বেলভিউ এলাকায় বিলাসবহুল হাইরাইজ কন্ডোমিনিয়াম, টরন্টোর প্রাণকেন্দ্র সিএন টাওয়ারের আশেপাশে, টরন্টোর পাশের শহর রিচমন্ড হিল, মিসেসাওগা এবং মার্কহামের অভিজাত এলাকায় তারা বাস করে। অন্টারিও এলাকায় এমন প্রায় দুই শতাধিক বেগমপাড়ার সন্ধানের কথা শোনা যায়। এছাড়া আরো অনেকে কানাডার অভিবাসী হয়ে বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়েছেন।
কি করেন এই বেগমরা?
অভিজাত এলাকার এসব বেগমদের এখানে কোন কাজ-কর্ম করেন না, কিন্তু তারা দুই-চার-পাঁচ মিলিয়ন ডলারের বাড়ীর মালিক। তারা এখানে থাকেন কিন্তু তাদের জ্ঞাত আয়ের সাথে দৃশ্যমান জীবনযাপনের কোনো মিল নেই। কানাডায় থাকা সাধারণ প্রবাসীদের পক্ষে সহজে এমন বাড়ী কেনা সম্ভব না। তাদের এরকম একটা বাড়ী কিনতে অনেক মেহনত করতে হয়। স্বামী-স্ত্রী ভাল চাকরি-ব্যবসা করে তবেই চিন্তা করতে পারেন এমন বাড়ীর কথা। যে কারণে কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীদের সহজেই ধারণা হয়, তাদের এ সম্পদ তারা এখানকার আয় দিয়ে করেননি। বাংলাদেশ থেকে তারা অসৎ উপায়ে আয় করে অবৈধভাবে নিয়ে এসেছেন।
কেন বেগমপাড়া এত আলোচিত?
কানাডাই একমাত্র দেশ যেখানে দেশপ্রেমিক প্রবাসীরা লুটেরাদের বিরুদ্ধে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। যে সংবাদ দেশের সকল মিডিয়াতে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়। যে আন্দোলন দেশ-বিদেশের বাঙালিদের দ্বারা ব্যাপক প্রশংসিত হয়। মানুষের মধ্যে অনেক উৎসাহের সৃষ্টি করে। অন্যান্য দেশের প্রবাসীরা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন তাদের ওখানেও এমন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য। বিশেষত কানাডা ছাড়া যে সব দেশে লুটেরারা অর্থ পাচার করেন। সেটা হলে লুটেরা বিরোধী এ আন্দোলন হয়তো একটি বৈশ্বিক আন্দোলন হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিশ্বব্যাপী করোনার ভয়ঙ্কর আক্রমন সে সম্ভবনাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। কিন্তু লুটেরা বিরোধী আন্দোলনের আলাপ-সংগ্রাম থেমে নেই।
কানাডায় বেগমপাড়া ও লুটেরা বিরোধী আন্দোলন ছিল বেগমপাড়া শব্দের ব্যাপক প্রচার ও আলোচনার বিষয়। এই আন্দোলনের আগে ও পড়ে কানাডার বেগমপাড়া নিয়ে মিডিয়াতে অনেক সংবাদ, প্রতিবেদন আলাপ-আলোচনা হয় যা এখন চলমান। যে আলোচনা দেশ-বিদেশে এক বিশাল মিথ ও কিংবদন্তির সৃষ্টি করে।
বেগমপাড়া কি শুধু কানাডাতেই আছে?
না বেগমপাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে? বেগমপাড়ার মিথ বিবেচনায় দুনিয়ার অনেক দেশেই বেগমপাড়া বিদ্যমান। যে সব দেশে লুটেরারা দেশ থেকে অর্থসম্পদ লুট করে নিয়ে তাদের দ্বিতীয় বিলাসী ও নিরাপদ আবাস গড়ে তুলেছেন, সেখানেই এই বেগমপাড়া বর্তমান। সে হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেইম্যান আইল্যান্ডস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসএ বেগমপাড়া আছে। এ তথ্য বাংলাদেশ সরকার ও জিএফআই এর।
(ডঃ মঞ্জুরে খোদা, লেখক, গবেষক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট)
————————————————————–
তথ্যসূত্রঃ কানাডায় বাংলাদেশের অর্থপাচারকারী বিত্তশালীদের বেগমপাড়া আসলে কোথায়? মোয়াজ্জেম হোসেন, বিবিসি বাংলা।