ঢাকা   শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১   দুপুর ১২:৫৮ 

সর্বশেষ সংবাদ

ধর্ষণ ,অনাচার বনাম মনুষ্যত্ব

নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমেই ভয়ানক আকার ধারণ করছে। প্রতিদিনই খুন ধর্ষণ নির্যাতন নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন নারী। বাংলাদেশ যেনো এক অভিশপ্ত জনপদে পরিণত হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে নারীর অধিকার, মর্যাদা কেমন? বাংলাদেশী সাংবাদিক মাহবুবুল আলম উচ্চশিক্ষার্থে রয়েছেন জার্মানি। সেখানকার বাস্তবতা তুলে ধরেছেন তিনি। *****

ডিসেম্বর;২০১৯। অষ্ট‌্রিয়া থেকে জার্মানিতে ফিরছি। গভীর রাত আনুমানিক ২টা। চেক-রিপাব্লিকের রাজধানী প্রাগ। পারহা নামক এক জায়গায় ট্রানজিট। গন্তব্য আমার বাসস্থান ড্রেজডেন শহর। ৬ ঘন্টার দীর্ঘ ট্রানজিট । ভাবলাম যাত্রীদের বিশ্রামাগারে ঝিমিয়ে কাটিয়ে দেবো। প্রাগ আমার কাছে নতুন শহর, রাতে লোকজন কম, আমি ইউরোপে নতুন ,তখনও ইনকাম তেমন করি না । ইউরো সমান একশ টাকার চিন্তা মাথা থেকে যায় না। ইউরোপে, এক এক দেশে এক এক ভাষা। কারে কি বলবো। সহজে ইংরেজী বলতে চায়না কেউ। পরে এসব চিন্তায় আর ছয় ঘন্টার জন্য আর হোটেলে খুঁজিনি। সবাই আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। ৩ টার দিকে দেখলাম মাইকে ঘোষণা আসল বিশ্রামাগার বন্ধ থাকবে ৫.৩০ পর্যন্ত। শীতের রাত ঠান্ডায় জমে যাওয়া অবস্থা। সবশেষ, আমি আর এক সুন্দরী তরুণী।অনেক কিছু বোঝালাম সিকিউরিটিরে কিছুই বুঝতে চাইলনা । কী আর করা, পাশের ট্রাম ষ্টেশন সারারাত খোলা থাকে। মাটির নিচে কিন্তু খুব ঠান্ডা। তার পরও উপায় নাই ওখানে গিয়ে বসলাম। জনমানব শুণ্য প্রাগের ওই ষ্টেশনে নিজেরে খুব অসহায় লাগছিলো। হঠাৎ ওই তরুণীর প্রবেশ।আরেকজন মানুষের উপস্থিতিতে কিছুটা উষ্ণতা বোধ করলাম। মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঘন্টা খানেক কাটিয়ে দিলাম। কোনো কথা নাই। অনেকক্ষণ পর ভাঙ্গা জার্মান ভাষায় জিজ্ঞেস করলাম -Wohin gehst du(তুমি কই যাবা) ?বলল বার্লিন। জর্জিয়ান ওই তরুণী বার্লিনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ভিয়েনা থেকে ফিরছে।আর ভাবছিলাম এত গভীর রাতে কী নিরাপদ বোধ করছে এই মেয়ে। আর আমার অভাগা দেশের কথা চিন্তা করলাম।এমন করে রাত তিনটায় এই মেয়ে একা কমলাপুর ষ্টেশনে থাকলে। বদমাইশ লোকজন ছাড়াও চরিত্রবান পুলিশ ভাইদের অনেকে তারে নিয়া টানাটানি করত বা ওরে চরিত্রহীন বানানোর চেষ্টা করত…। পরে আমরা একই ফ্লিক্সবাসে জার্মানি ফিরেছি।

সম্প্রতি আমি এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। কেউ কাউকে তেমন চিনি না। নতুন কলিগ। দুই দিনের পরিচয়। লাইপজিশের এক গ্রাম থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ,ছয় ঘন্টার লং ড্রাইভ। ও ড্রাইভ করছিলl একা ওই মেয়ে আর আমি গভীর রাতে গিয়ে পৌঁছেছি অন্য আরেক রাজ্যে। চলার পথে সন্ধ্যায় জার্মানির অজানা এক গহীন বনে পথ হারিয়েছি। একই হোটেলে থেকেছি। তবে একবারের জন্যও আমার ওর আমার প্রতি খারাপ চিন্তা জাগেনি। আবার কেউ হয়ত কাউকে চিনি না এমন অনেকের সাথে রাতে একই রুমে পাশাপাশি থেকেছি। বিষয়টা হচ্ছে তাদের আমি মানুষ, ভেবেছি মেয়ে নয়।

আমাজনে কাজ করেছি মাস দেড়েক । ওখানেও রাতে অনেক মেয়েকে নিশ্চিন্তে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেখেছি। রাতে এখানকার মেয়েরা গাড়ী চালায় ,পার্টি করে সব কিছু করে নিরাপদে নির্বিঘ্নে। আমার মনে হয় বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে পড়তে আসা একা অবিবাহিত অনেক- মেয়ে নিজেকে এখানে দেশের চেয়ে নিরাপদ ও স্বাধীন মনে করে।ষ্টুডেন্ট হল গুলোতে পাশাপাশি রুমে অনেক ছেলে মেয়ে টয়লেট,বাথরুম,ডাইনিং, কিচেন সবকিছু শেয়ার করে একে অন্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে। আর বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বউ নিয়ে ক্যাম্পাসে বেড়াতে এলে- ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। করবে না কেন? বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছি অনেক শিক্ষক মেয়েদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালায় নাম্বার বেশী দেবার টোপ দিয়ে। ওদের আদর্শ অনুসরণকারী ছাত্ররা আর কী করবে।দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্ষণের অভিযুক্ত অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে উত্তাল আন্দোলনের পরও -শিক্ষক আছেন,পদোন্নতি পাচ্ছেন। কারণ ওরা কোন বিবেচনায় শিক্ষক হয়েছে তা সবার জানা।

সবশেষ,
জার্মান এক কোম্পানিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। ওখানে ইন্টারভিউ এর পর চাকরি কনফার্ম করে ‌ম্যানেজার আপা একটা ব্যাগ গিফট করলেন। হলে এসে দেখলাম, একটা লাইটার, একটা কফি মগ ,আর একটা ছোট প্যাকেট– জার্মান আপা যখন ওটা ব্যাগে দিলেন আমি ভাবছিলাম চকলেট মনে হয়। পরে দেখি এটা একটা কনডম। এর মানে এখানে যৌনতাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হয়। লজ্জার কিছু নেই। আমাদের দেশে ৮৫ পার্সেন্টের বেশী মুসলমান। ধর্মে অবাধ যৌনতা নিষিদ্ধ। মেয়েদের ছিলা কলা, তেঁতুল,রসগোল্লা নামে কাঠমোল্লারা ডাকে। অন্যধর্মের যাজকরাও কম যাননা। সবাই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এদের হাত থেকে রেহাই পায়না বাচ্চা ছেলে থেকে শিশু কন্যারাও।
আসলে, ধর্ম চর্চা কিংবা ওয়াজ নসিহতে মেয়েদের নিয়ে রসের গল্প বন্ধ করে সামাজিক মূল্যবোধ, মেয়ে মানুষকে -মানুষ হিসেবে সম্মান করার জন্য সামাজিক বিপ্লব দরকার।শুদ্ধাচার দরকার।সব ক্ষেত্রে। কারণ ইউরোপের বেশীর ভাগ দেশ বিশেষ করে জার্মানির ৫০ ভাগ মানুষের কোন ধর্ম নেই। তবে ধর্মহীনরা এখানে বকধার্মিকদের চেয়ে শতভাগ নিষ্ঠা আর সততা নিয়ে জীবন যাপন করে। এখানে মুসলমানসহ সব ধর্মের মানুষ বিপুল স্বাধীন । মনুষ্যত্বের মুক্তি কিংবা মনুষ্যত্বের উন্নতি ঘটলে ধর্মীয় জীবনে এমনিতেই শান্তি আসবে এজন্য উল্টা -পাল্টা ওয়াজ নসিহতের দরকার নেই।
দেশে অনেকেই মনে করে ইউরোপে মন যা চায় যা ইচ্ছে তাই করা যায়। আসলে তা নয়। এখানে খারাপ মানুষ নেই ধর্ষণ হয়না তেমনটা না। তবে অনেক কম। এখানে নারী পুরুষ আলাদা না সবাই মানুষ। আইনের শাসন আছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো সবাই সবাই কে সম্মান করে। সুযোগ থাকলেও কারো সম্মতি ছাড়া জোর করে কিছু করা অন্যায় । এটা ওরা ছোট কাল থেকেই শিখেছে। আর আমাদের দেশে মাদ্রাসা,স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়,মিডিয়া হাউস,কর্পোরেট হাউস, সরকারি প্রতিষ্ঠান,পাহাড় ,সমতল ,গীর্জা ,মন্দির ,প্যাগোডা সবজায়গায় নারীর অসম্মান, মানুষের অসম্মান নিয়মিত ঘটনা। মানুষ মানুষ হয়ে উঠুক তাইলেই অনাচার কমবে।

মাহবুবুল আলম, ড্রেসডেন,জার্মানি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত