ঢাকা   রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০   দুপুর ১২:০২ 

সর্বশেষ সংবাদ

চাঞ্চল্যকর শতাধিক খুনের মামলার তদন্তও শেষ হচ্ছে না বিচারও হচ্ছে না

সময় মতো তদন্ত শেষ করতে না পারা, তদন্তকারী কর্মকর্তার ওপর মামলার চাপ, সাক্ষী হাজির করতে না পারা এবং বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে সারাদেশে শতাধিক চাঞ্চল্যকর ও বহুল আলোচিত খুনের মামলার তদন্ত ও বিচারের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অনেক মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করতে না পারায় তদন্ত চলে গেছে ডিপফ্রিজে। কোন কোন মামলার ভাগ্য ঝুলে আছে বিচারপ্রক্রিয়ায়। সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে বিলম্বিত হচ্ছে বিচারপ্রক্রিয়া। ফলে বিনাবিচারে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকছেন আসামিরা। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ ও সাক্ষী হাজিরে গাফিলতির কারণে বিচার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। আইনী ফাঁকফোকর গলিয়ে বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম ঝুলে আছে বছরের পর বছর। র‌্যাব, সিআইডি, ডিবি ও থানা পুলিশ চাঞ্চল্যকর এসব হত্যা মামলার তদন্ত করছে। চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর তদন্ত ও বিচার কার্যক্রমের গতি ফেরতে মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু তারপরও কিছুতেই কিছুই হচ্ছে না। এক অনুসন্ধানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কোন কোন খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) পরিবর্তন করা হয়েছে এক ডজনেরও বেশি বার। অথচ হত্যা রহস্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে না । চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্তেরই যখন এই অবস্থা তখন অন্যান্য খুনের মামলার তদন্ত ও বিচার কার্যক্রমের চিত্র আরও করুণ হাল বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ক্লুলেস খুনের ঘটনাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে বারবার। অনেক খুনের ঘটনার রহস্য উন্মোচনে দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে গেছে। আবার কিছু কিছু চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনার তদন্ত রহস্যের জালে আটকে দেয়া হয়েছে। কোন কোন ঘটনায় খুনীরা এতই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ধূর্ত যে- খুনের ঘটনা এমনভাবে ঘটানো হয়েছে যে, আসলেই ক্লুলেস (সূত্রবিহীন) করে রাখা হয়েছে। এসব ক্লুলেস খুনের ঘটনা তদন্তের এক পর্যায়ে এসে হাল ছেড়ে দিয়েছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ। আবার এমনও হয়েছে যিনি একটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা তদন্ত করছেন তার কাঁধে আরও অনেক মামলার তদন্তের দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে তদন্ত কর্মকর্তা কোনোটারই সঠিকভাবে তদন্ত শেষ করতে পারেন না। একসময় দায়সারাগোছের তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে দেয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রে মামলার তদন্ত চলে যায় ডিপফ্রিজে।
২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ঢাকার লালমাটিয়ার নিজ বাসায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নুরুল ইসলাম ও তার ছেলে তমোহর ইসলাম। কিন্তু এই খুনের ঘটনার রহস্য এখনও উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। মীরহাজিরবাগে ২০০৮ সালের নভেম্বরে পরিবহন ব্যবসায়ী জুয়েল হোসেন ও তার বন্ধু পোশাক ব্যবসায়ী মারুফ হোসেন টুটুল খুন হন। রহস্যজনক এ জোড়া খুনের তদন্তে ১০ বার কর্মকর্তা বদল করা হয়। কিন্তু রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। শুধু তাই নয়, গত কয়েক বছরের মধ্যে সাংবাদিক সাগর-রুনী, জাতীয় সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেলে অজ্ঞাত মহিলা হত্যার রহস্য এখনও উদ্ঘাটিত হয়নি। চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্তে বছরের পর বছর চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু খুন রহস্যের কোন কূলকিনারা করতে তারা পারছে না তারা। এসব হত্যা মামলার তদন্তের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তদারকি করা হচ্ছে। র‌্যাব, সিআইডি, ডিবি ও থানা পুলিশ চাঞ্চল্যকর এসব হত্যা মামলার তদন্ত করছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, যেসব চাঞ্চল্যকর হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- রাজধানীর টিকাটুলির সিক্স মার্ডার, পরিবাগের তুর্কি এ্যাসোসিয়েটস অফিসে রমজান আলী খুন, এ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম বাচ্চু হত্যাকান্ড ঘটনা, মালিবাগে সানরাইজ হোটেলের ভেতর ডিবি ইন্সপেক্টর নুরুল আলম শিকদার ও এসআই আলমগীর হোসেন তালুকদার, পুরান ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার আহম্মদ হোসেন হত্যা, মিরপুরে ব্যবসায়ী আফতাব, প্রিন্স গ্রুপের মালিক কাজী শহিদুল হক, ওয়ার্ড কমিশনার মিস্টার, গুলশানে গৃহবধূ তাসমির হোসেন মুন্নী, পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ী আজগর, খিলগাঁওয়ের ব্যবসায়ী ইসলাম শিকদার, বিজয়নগরে ব্যবসায়ী নজরুল, সবুজবাগে আজিজুল, মিরপুরে আওয়ামী লীগ নেতা সামাদ খান, মিরপুরে মিসুক সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী সান্টু, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মনু, ফকিরাপুলে ব্যবসায়ী সোহেল হোসেন টিটু, তেজগাঁও থানা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান ও মিরপুরের কাপড় ব্যবসায়ী আলী আকবর, জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সংস্থার মহাসচিব ইদ্রিস আলী বেপারি, বাড্ডায় থাই এ্যালুমিনিয়ামের ঠিকাদার আল আমিন, পুরান ঢাকার মহানগর পুস্তক বাঁধাই সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদ, মতিঝিলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কাউসার আলী, ধানমন্ডির জিগাতলায় বিএনপির ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জামান শিবলী, মোহাম্মদপুরে আবাসন কোম্পানি শেলটেকের কর্মকর্তা মাসুদ পারভেজ, রমনার ইঞ্জিনিয়ার এসএম শফিক-উল মওলা, রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র হারিসুল ইসলাম বিপ্লব, ধানমন্ডিতে সাবেক শিক্ষিকা কাজী সুহিন নাহার, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আফতাব আহমাদ,নারায়ণগঞ্জের তানভির মোহাম্মদ ত্বকি হত্যাকাণ্ড প্রমুখ।
সবচেয়ে বেশি আলোচিত চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্ত হিমাগারে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তার মধ্যে রাজধানী ঢাকার রাজাবাজারে মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, গোপীবাগে কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুক, খুলনায় তৈয়েবুর রহমান ও তার ছেলে মনির ও উত্তরায় জঙ্গী সংগঠন থেকে ফিরে আসা ফল ব্যবসায়ী মাসুম হত্যার ঘটনা এবং সাংবাদিক সাগর-রুনী দম্পতির। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীর ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পর মামলা তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তদন্তের ৬২ দিনের মাথায় হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এর পর আদালতের নির্দেশে তদন্ত ভার নেয় র‌্যাব। তারা ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সাগর-রুনীর লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী নিহত দম্পতির শিশুপুত্র মাহী সরওয়ারের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলে র‌্যাব সদস্যরা। এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদ করে শতাধিক ব্যক্তিকে। ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা সাগর-রুনীর রক্তমাখা জামাকাপড়, বঁটি, মোজাসহ কিছু আলামত পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগারে পাঠানো হয়। অভিজ্ঞ ফরেনসিক আলামত সংগ্রহকারীরা ওই ঘর থেকে আরও কিছু আলামত সংগ্রহ করেন ও ডিএনএসহ আলামত পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সাগর-রুনীর লাশ কবর থেকে ওঠানো হয়। এখন শুধু সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকান্ডের বিষয়ে সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। এখন শুধু সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন দাখিলের জন্য উচ্চ আদালতে সময় চেয়ে আবেদন করে র‌্যাব, আর আদালত সময় দিয়ে পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করে দেয়ার এক অনির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করে যাচ্ছে। গত ১০ বছর আগে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকান্ডের তদন্তের অবস্থা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে, রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, চাঞ্চল্যকর হত্যার মধ্যে কয়েকটি মামলা ঝুলে আছে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। পাঁচ বছরেও হত্যাকাণ্ডের মোটিভই উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি এমন মামলাও আছে। তদন্ত চলছে, শিগগরই অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে, এমন কিছু বক্তব্য দিয়েই পুলিশের তদন্ত সংস্থা দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যেসব হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি তার মধ্যে ২০০৭ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র হারিসুল ইসলাম বিপ্লব, ২০০৫ সালে তেজগাঁওয়ে এ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম বাচ্চু, ধানমন্ডিতে সাবেক শিক্ষিকা কাজী সুহিন নাহার ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আফতাব আহমাদ হত্যাকান্ড, রমনার ইঞ্জিনিয়ার এসএম শফিক-উল মওলা হত্যিকাণ্ড। এসব খুনের ঘটনা এখনও অনুদঘাটিত। এসব মামলার ভবিষ্যত নিয়ে সন্দীহান বাদীরা। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, হত্যাকান্ডের মূল আসামিদের বাদ দিয়ে নিরপরাধীদের আসামি করে চার্জশীট দেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগও উঠে এসেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শুধু তদন্তেই নয়, নানা সঙ্কটে বিচারও ধীরগতিতে চলছে । বিচারপ্রক্রিয়া গতিশীল করতে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন উদ্যোগ। তবুও কাজের কাজ হচ্ছে না। দেশের নিম্ন আদালতগুলোয় শত শত চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম আটকে আছে। ফলে বিচারের আগেই দীর্ঘকাল কারাগারে থাকছেন আসামিরা। কেউ কেউ কারাগারে থেকেই মারা গেছেন। বিচারিক আদালতের রায়ের পর অনেকে আবার কনডেম সেলের বদ্ধ ঘরেই কাটাচ্ছেন বছরের পর বছর। উচ্চ আদালতে শুনানির অপেক্ষায় ঝুলছে বছরের পর বছর। বিচার শুরু হলেও তা চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। দুবছর করোনার পাশাপাশি, পুলিশ, প্রসিকিউশনের অদক্ষতা, তদন্তে সময়ক্ষেপণ, সাক্ষী হাজিরে গাফিলতি, সাক্ষীর নিরাপত্তাসহ নানা সমস্যায় মামলার জট বেঁধে আছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থানায় পুলিশের কাছে মামলা দায়ের থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ধাপে দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলা নিস্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে। এছাড়া নির্ধারিত সময়ে তদন্ত শেষ না করতে পারা, বার বার সময় নেয়া, ঠিক সময়ে সাক্ষী হাজির না হওয়া, বাদালত থেকে বার বার তারিখ নেয়া মামলা ঝুলে যাওয়ার বড় কারণ। আইন অনুযায়ী, বিচার বা মামলার তদন্তের একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রে সেটি মানা হয়। সাক্ষীর আদালতে হাজির না হওয়ার ঘটনাই বেশি। ভয়ভীতি ও হুমকির কারণে সাক্ষীরা অনেক সময় আদালতে আসেন না। দেশে সাক্ষী সুরক্ষা আইন নেই। সাক্ষীদের আদালতে আনা-নেয়ার আলাদা কোন ব্যবস্থাও নেই।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, অনেক ফৌজদারি মামলার সাক্ষীকে সময়মতো আদালতে হাজির করতে পারছে না পুলিশ। অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষীর ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে এমসময় আদালতে দায়সারা প্রতিবেদন দাখিল করা হচ্ছে। সাক্ষী আসেন না বেশিরভাগ খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, ধর্ষণসহ হত্যা, অস্ত্র ও ছিনতাই মামলার। ভয়ঙ্কর অপরাধের এসব মামলায় সহজে কেউ আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে চান না। আইন অনুসারে মামলার অভিযোগ গঠনের পর আদালতে সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। সাক্ষ্যগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করবে প্রসিকিউশন। এ দুই পক্ষের কাজের মধ্যে সমন্বয় না থাকার কারণেও সময়মতো সাক্ষ্যগ্রহণ করা যায় না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত