কুয়াকাটায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রাখাইনদের দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করে প্রভাবশালীদের স্থাপনা নির্মাণ করার বিষয়টির সত্যতা জানতে চেয়েছে আদালত। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশের পর কলাপাড়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শোভন শাহরিয়ার স্বত:প্রণোদিত বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। মঙ্গলবার দেয়া এক আদেশে, আগামী ৪০ কার্যদিবসের মধ্যে বিষয়টি সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন বিচারক।
আদালত বলেন, রাখাইন সম্প্রদায়ের দেবোত্তর সম্পত্তি স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় আবাসন ব্যবসায়ীর লোকজন জাল কাগজ তৈরি করে দখল করে সেমিপাকা ভবন নির্মাণ করছেন। এটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ।
(দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ চলছে)।
এ বিষয়ে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তিন দফা নির্দেশনাও দিয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে—গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ওই জমি রাখাইনদের দেবোত্তর সম্পত্তির অংশ কি না, ওই জমিতে সেমিপাকা ভবন নির্মাণাধীন কি না এবং জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র তৈরির বিষয়ে রাখাইনদের মন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এমং তালুকদারের অভিযোগ সত্য কি না, তার সবিস্তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
রাখাইনদের দেবোত্তর সম্পত্তি বেহাত:
সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়,পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রাখাইনদের দেবোত্তর সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। পুরোনো বৌদ্ধমন্দির, মন্দিরের মঠ ও ঠাকুরবাড়ির দেবোত্তর সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় এক আবাসন ব্যবসায়ীর লোকজন এই দখলদারির সঙ্গে জড়িত। ইতিমধ্যে দখলদাররা দেবোত্তর সম্পত্তিতে প্রাচীর ও পাকা স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেছে।
রাখাইনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুয়াকাটায় ৯৯ শতাংশ জমির ওপর প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো এই সম্পত্তিতে একসময় কুয়াকাটা শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার ছিল। এখানে ২০ ফুট লম্বা শায়িত বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। পাশেই রয়েছে রাখাইন সম্প্রদায়ের মহাশ্মশান। মন্দিরটির চারদিকের জমি দখল করে নেওয়া হচ্ছে। মাঝখানে মন্দিরের মঠগুলো কালের সাক্ষী হয়ে এখনো কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। কুয়াকাটায় নবনির্মিত পৌর ভবনের পাশেই সেখানকার রাখাইন সম্প্রদায়ের এই দেবোত্তর সম্পত্তি। ২০ জুলাই গিয়ে দেখা যায়, বালু ফেলে এর মধ্যে ২০ শতাংশ জায়গা ভরাট করে ফেলা হয়েছে। সেখানে সেমি পাকা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান এই জমি স্থানীয় কয়েকজনের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার জন্য বায়না দলিল করেছে। এই বায়না দলিলের কথা বলে প্রতিষ্ঠানটি সেখানে স্থাপনা তুলছে। এ সম্পর্কে ওই আবাসন প্রতিষ্ঠানের কুয়াকাটা প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর মৃধা বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান রাখাইনদের সম্পত্তি দখল করেনি। রাখাইনদের সম্পত্তির খতিয়ান এবং তাঁদের জমির খতিয়ান ভিন্ন। রাখাইনদের দেবালয় দখলের প্রশ্নই ওঠে না।
জাহাঙ্গীর মৃধা আরও বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে জমি কিনে এবং বায়না করে স্থাপনা তুলছে। যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, তাই সম্পত্তির কাগজপত্র উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দিয়েছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় বাসিন্দা ইলিয়াস হোসেনসহ কয়েকজনের কাছ থেকে জমি কিনে বায়না দলিল করা হয়েছে। এ সম্পর্কে ইলিয়াস হোসেন বলেন, তাঁরা রাখাইনদের কাছ থেকে এই সম্পত্তি ক্রয়সূত্রে মালিক হয়েছেন। তাঁদের নামে বিএস জরিপ হয়েছে।
এ সম্পর্কে রাখাইন অধিকার আন্দোলনের নেত্রী কুয়াকাটা কেরানিপাড়ার বাসিন্দা লুমা মগনী বলেন, যাঁরা ওই জমির মালিকানা দাবি করছেন, কাগজে তাঁদের জমির মালিকানা দাবির ভিত্তি নেই। জালিয়াতির মাধ্যমে বিএস জরিপে তাঁরা এই জমির মালিক বনে গেছেন।
রাখাইনদের মন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এমং তালুকদার অভিযোগ করেন, পুরোনো বৌদ্ধমন্দির ও ঠাকুরবাড়ির দেবোত্তর সম্পত্তি জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে পেশিশক্তির জোরে দখল করে নেওয়া হচ্ছে। এতে সহায়তা করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
কুয়াকাটার সঙ্গে রাখাইনদের ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িত এবং তাঁদের জীবনধারা, সংস্কৃতি কুয়াকাটাকে সমৃদ্ধ করেছে বলে মনে করেন স্থানীয় পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হাওলাদার। তিনি বলেন, রাখাইন সম্প্রদায়ের দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষায় প্রশাসনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
এ ব্যাপারে কলাপাড়ার ইউএনও আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক বলেন, রাখাইনদের দেবালয়ের জমি চিহ্নিত হওয়ার আগপর্যন্ত সেখানে সব কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উভয় পক্ষকে সম্পত্তির কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে। কাগজ পরীক্ষা করে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।