১৯৭৬ সালে বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে গোপন বিচার করে রায় ঘোষণার ৩ দিনের মধ্যে ফাঁসি দেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল এম এ তাহের বীর উত্তমকে। সামরিক আদালতে কোনো আইনজীবীর সহায়তা পাননি কর্নেল তাহের। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতেও যেতে দেয়া হয়নি। মনে হয়েছিল, জেনারেল জিয়াউর রহমান তার জীবন রক্ষাকারী কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড দেবেন এটা আগেই মনস্থির করে রেখেছিলেন । দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন ২১ জুলাই(১৯৭৬) ভোর রাতে তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।
সামরিক আদালতে কর্নেল তাহেরের এই বিচারকে ৩৫ বছর পর অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। তাহেরের বিচারের ৩৪ বছর পর তাঁর পরিবারের পক্ষে দায়ের করা রিট আবেদনের শুনানি শেষে ২০১১ সালে দেয়া হাইকোর্টের রায়ে তাহেরকে শহীদের মর্যাদা, তাহেরসহ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান, সামরিক আদালতে বিচারের ঘটনা এবং এর প্রেক্ষাপট খতিয়ে দেখার জন্য সরকারকে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। রায়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ঠাণ্ডা মাথার খুনী উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন। ফলে বিচার ছিল একটি প্রহসন মাত্র।
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১১ সালের ২২ মার্চ এ রায় দিয়েছিলেন।
রায় ঘোষণার ১০ বছর পার হয়ে গেলেও এই রায় অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর হয় নি। সবচেয়ে বড় বিষয় কর্নেল তাহেরের বিচারসহ সেসময় সামরিক আদালতে বিচারের ঘটনা খতিয়ে দেখার জন্য একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছিলো রায়ে। কিন্তু ১০ বছরেও তা করা সম্ভব হয় নি।
হাইকোর্টের রায়ে তাহেরের মৃত্যুদণ্ড ‘ঠান্ডা মাথার খুন’ বলে চিত্রিত করতে সরকারের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিল। এ ছাড়া দণ্ডিত ব্যক্তিদের তালিকা থেকে রিট আবেদনকারীদের নাম মুছে ফেলারও নির্দেশ দেয়া হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড একটি হত্যাকাণ্ড। কারণ, ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানে মনস্থির করেন। যেহেতু জেনারেল জিয়া জীবিত নেই, আইন অনুযায়ী তাঁর বিচার সম্ভব নয়। এর পরও সরকারের উচিত হবে এই হত্যার জন্য দায়ী কেউ জীবিত থাকলে, তাঁকে খুঁজে বের করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা। কর্নেল তাহেরকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের গৌরব উল্লেখ করে আদালত বলেন, তাঁর হত্যাকাণ্ড দেশের ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। কর্নেল তাহেরের ফাঁসিকে ‘নিরঙ্কুশ খুন’ বলে অভিহিত করেছেন আদালত। রায়ে বলা হয়, যে অপরাধের জন্য তাহেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, সেই অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান ছিল না। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান ছিল। তথাকথিত বিচারকে কোনো অবস্থাতেই বিচার বলে বিবেচনা করা যায় না। বিচারকেরা যে রায় দিয়েছেন, তা ছিল নেহাতই প্রভুদের কণ্ঠস্বর।
রায়ে বলা হয়, এখানে আসামিদের আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ। এমনকি সাক্ষীদের জেরা করারও সুযোগ দেওয়া হয়নি।
রায়ে আদালত আরও বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, তা-ও শোনানো হয়নি। তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হয়নি, তাঁরা দোষ স্বীকার করেন কি না। তাঁদের সাফাই সাক্ষীরও সুযোগ দেওয়া হয়নি। আত্মীয়-পরিজন ও আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা ও কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি এফআইআর ও অভিযোগপত্রের কপি। ফৌজদারি মামলায় যেসব প্রক্রিয়ার অনুসরণ করার কথা ছিল, তার কোনোটাই অনুসরণ করা হয়নি।
কর্নেল তাহেরের গোপন বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে পঁয়ত্রিশ বছর পর চারটি রিট মামলা করা হয়েছিল। রিট মামলাগুলো করেছিলেন কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের এবং তার ভাই ড. আনোয়ার হোসেনসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা। তাদের পাশাপাশি জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুসহ পাঁচজন রিট মামলা করেছিলেন, তাদেরও ওই সামরিক আদালতে বিচারে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছিল।
সবগুলোর রিটের ওপর একসঙ্গে শুনানি হয়। চূড়ান্ত শুনানিতে আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ড.এম জহির, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, আক্তার ইমাম, এ এফ এম মেসবাউদ্দিন, আবদুল মতিন খসরু, জেড আই খান পান্না ও এম আই ফারুকীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে বক্তব্য শুনেন। রিট আবেদনকারিদের পক্ষে শুনানি করেন ড.শাহদীন মালিক।
রিটের শুনানিকালে মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ, ঘটনার সময় ঢাকার জেলা প্রশাসক এম এম শওকত আলী, কর্মরত জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মহিবুল হক, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় উপস্থিত তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার ফজলুর রহমানও আদালতে বক্তব্য দেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল নূরুল ইসলাম। তাহেরের সঙ্গে সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি কয়েকজনও আদালতে বক্তব্য দেন।
শুনানি শেষে ২০১১ সালের ২২ মার্চ আদালত রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তাহেরের গোপন বিচার অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়, তাহেরসহ অন্যদের বিচার ছিল লোক দেখানো ও প্রহসনের নাটক। এটা কোনো বিচার হয়নি। তাই বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন, বিচার-প্রক্রিয়া ও সাজা ছিল অবৈধ। বিচার ও সাজা বাতিল করা হলো। আদালত অভিমতে বলেন, ওই বিচার প্রথম থেকেই অবৈধ, আর পুরো বিচারটি ছিল একটি বিয়োগান্ত নাটক ও বানানো বিচার।
বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়, তাহেরের তথাকথিত বিচার ও ফাঁসি দেওয়ার ঘটনা ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড। ওই বিচার ও হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী ছিলেন জিয়াউর রহমান। একই সঙ্গে তাহেরকে শহীদের মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি কথিত ওই সামরিক আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ঘটনার বর্ণনা করে রায়ে বলা হয়, ১৯৭৬ সালের ১৪ জুন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৭ জুলাই তাহেরকে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। এরপর ২১ জুলাই তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কিন্তু তাহেরকে যে আইনে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, সেই আইনে ওই সময় মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান ছিল না। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর ’৭৬-এর ৩১ জুলাই মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়। তাই আইনগতভাবে ওই দণ্ড ছিল অবৈধ। তথাকথিত ওই আদালতের বিচারক আবদুল আলী ও অন্যরা বলেছেন, বিচারের সময় তাঁদের সামনে কোনো কাগজ বা নথিপত্র ছিল না। এ ছাড়া আসামিরা জানতেন না যে তাঁদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ। তাঁদের পক্ষে বক্তব্য দিতে কোনো আইনজীবীও দেওয়া হয়নি। এসব বিবেচনায় ট্রাইব্যুনাল ও এর কার্যক্রম ছিল অবৈধ। তথাকথিত ওই বিচার সংবিধানের ২৭, ২৯, ৩০, ৩২, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ ও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার পরিপন্থী।
জিয়া জড়িত: রায়ে লিফশুলজ ও অন্যদের বক্তব্য তুলে ধরে বলা হয়, জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ এসেছে, যদিও বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা এ মামলার বিচার্য বিষয় নয়। ওই সময় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে। সঠিক ইতিহাস ও সত্যের খাতিরে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এটা খতিয়ে দেখতে পূর্ণাঙ্গ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে তা যাচাই করতে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হলো। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আইনজ্ঞ, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং অবসরপ্রাপ্ত বেসামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তার সমন্বয়ে ওই কমিটি গঠন করতে বলা হয়।
তথ্য পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর জিয়াউর রহমানের কর্মকাণ্ডে স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থানের প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের জয় বাংলা স্লোগান মুছে ফেলেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের স্থান রেসকোর্স ময়দানকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পরিণত করেন এবং সেখানে শিশুপার্ক স্থাপন করেন।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দেন জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতাবিরোধী কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমানকে দেন মন্ত্রীর পদ। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সেনা কর্মকর্তাদের উচ্চপদে আসীন করেন তিনি।
তাহেরকে শহীদের মর্যাদা: ইতিহাস ও বিভিন্ন নথিপত্র থেকে ওই প্রহসনের বিচার এবং দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত তাহেরসহ অন্যদের নাম বাদ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত বলেছেন, তাহেরসহ অন্যরা সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের ক্ষোভের শিকার ছিলেন বলেই মৃত্যুবরণ ও কারাবরণ করেছিলেন। তাঁরা জিয়ার স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠায় পাশে না থেকে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাহেরকে দেশদ্রোহের অভিযোগ মুছে দিয়ে মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে চিহ্নিত করে শহীদের মর্যাদা দিতে নির্দেশ দেওয়া হলো। কথিত বিচারের মুখোমুখি হাসানুল হক ইনু, মাহমুদুর রহমান মান্না, মেজর জিয়াউদ্দিনসহ অন্যদের দেশপ্রেমিক হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার কথাও রায়ে বলা হয়।
আর্থিক ক্ষতিপূরণ বিবেচনা: রায়ে আদালত তাহেরের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত বলেন, ওই সময় সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা অনেকেই সেনা কর্মকর্তা এবং সরকারি চাকরিতে ছিলেন। কিন্তু গোপন বিচারের কারণে তাঁদের সাজা হয় এবং অনেকে চাকরিচ্যুত হন। যাঁদের সাজা হয়েছিল, তাঁদের পেনশনসহ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে বলা হয়েছিল।