ঢাকা   শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১   রাত ৯:৪৩ 

সর্বশেষ সংবাদ

ডিজিটাল আইন প্রয়োগে দক্ষতার অভাব রয়েছে, শাল্লার ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে মামলা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য : মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার

রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা কখনই সমাজের জন্য ভাল ফল দেয় না। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ধর্মীয় সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক। বঙ্গবন্ধুর লড়াই ছিল অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। কিন্তু তাকে হত্যার পর দেশে আবার সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি শুরু হয়।
বৃহস্পতিবার একাত্তরের ঘাতক দালল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে ‘বাংলাদেশে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির চ্যালেঞ্জ: সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে আলোচকরা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ প্রয়োগে দক্ষতার অভাব রয়েছে।

সুনামগঞ্জের শাল্লায় ঝুমন দাসকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করার বিষয়টি তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে থানা পর্যন্ত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ সম্পর্কে দক্ষতার অভাব রয়েছে।
তিনি বলেন, ঝুমন দাসকে এই আইনে থানায় একটা মামলা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। যা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, বঙ্গবন্ধুর লড়াই ছিল অসাম্প্রদায়িক, ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র কাঠামোর মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্রের আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু জাতির ভিত্তি তৈরি করেছেন ৭২-এর সংবিধানের আলোকে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২১ বছর বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর সকল ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশকে দারিদ্রতা মুক্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু সব জঞ্জাল এখনও পরিষ্কার করতে পারেননি। এখনও তাকে পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে যুদ্ধ করতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, মামুনুল হকদের মতো কিছু লোক যারা সন্ত্রাসী, ধর্মব্যবসায়ী তাদের জন্য এই আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে। এজন্য সংস্কৃতির চর্চাকে বিকশিত করতে হবে। আমাদের রাজনীতির স্রোতে আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতাকে ধরে রাখতে না পারি, তাহলে এখনকার যে অপকর্মগুলো হচ্ছে তা মারাত্মক রূপ ধারণ করবে।
সকলকে একত্রিতভাবে ডিজিটাল অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিই আমাদের সর্বোচ্চ দিকনির্দেশনা এবং এই নির্দেশনার ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।
ওয়েবিনারে সভাপতির বক্তব্যে নির্মূল কমিটি’র সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, বর্তমান বিশ্বকে, সংঘাত, সন্ত্রাস ও গৃহযুদ্ধ থেকে মুক্ত করার পূর্বশর্ত হচ্ছে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের উল্লেখ ধর্মীয় সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক। রাষ্ট্র কর্তৃক সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করা কিংবা বিশেষ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।
তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই হেফাজত-জামায়াতের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করা যায়নি। আমরা সাম্প্রদায়িক বঞ্চনা-বৈষম্য-নির্যাতন বিলোপ করার জন্য ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন এবং ‘জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছি ২০১৪ সাল থেকে।
২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে তা উল্লেখ করা হলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। আমাদের শিক্ষানীতি ও সংস্কৃতি নীতিসহ রাষ্ট্রীয় সকল কার্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন থাকতে হবে।’
নির্মূল কমিটির সহসভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি মৌলবাদীরা শিক্ষাক্ষেত্রে সুকৌশলে সাম্প্রদায়িক ধারা প্রণয়নের চেষ্টা করছে। তারা সর্বত্র ছদ্মবেশে বিচরণ করছে। হেফাজতের আজকের আস্ফালনের পিছনে এসব ছদ্মবেশী সাম্প্রদায়িক শক্তি কাজ করছে। এই সাম্প্রদায়িকতার বিষ ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের ভিতর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত বলেন, হেফাজতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো দূর করার জন্য অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি প্রবর্তন করতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি বৈষম্য দূর করতে হবে এবং জাতীয় বাজেটেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি বৈষম্য দূর করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাদার ড. তপন ডি রোজারিও বলেন, বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিকভাবেই সাম্প্রদায়িকতাকে দূর করতে চেয়েছেন। কারণ রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা কখনই সমাজের জন্য ভাল ফল দেয় না, এটা তিনি দেখেছিলেন। এখন প্রত্যেকটি সরকার ধর্মকে আঁকড়ে ধরে চলার চেষ্টা করছে। ফলে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ উগ্রবাদী দলগুলো অপঘটনা ঘটাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ’৭২-এর সংবিধানে পুরোপুরিভাবে ফিরে যেতে হবে।
সুপ্রিম সংঘ কাউন্সিল অব বাংলাদেশ-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ভদন্ত এস. লোকজিৎ থেরো বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধারা বজায় না থাকলে একটি দেশের মানবতা বিপন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। রাজনীতি ও ধর্মনীতি একে অন্যের সাথে পরিপূরক হয়ে পড়ায় রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘বিধর্মী’ শব্দটি শিশুদের মনে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করছে। এসব দিকে লক্ষ করা প্রয়োজন। সরকারি ব্যয়ে ‘মডেল মসজিদ’ যখন হচ্ছে তখন এর মতো ‘মডেল মন্দির’, ‘মডেল প্যাগোডা’ তৈরি কারা হোক তাতে সমতা সৃষ্টি হবে।’
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শঙ্কর মঠ ও মিশন-এর অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী তপনানন্দ গিরি মহারাজ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ’৭২-এর সংবিধান ফিরিয়ে দেবেন এই অঙ্গীকার থেকেই সরকার গঠন করেছিলেন। কিন্তু তা পুরোপুরি ফিরে আসে নি। প্রত্যেক ধর্মেই আমরা মানবতার কথা দেখতে পাই। সবার কাছে অনুরোধ সত্যকে প্রকাশ করব। সত্যই ধর্ম আর এই সত্যই হচ্ছে মানবতা।’
বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মওলানা জিয়াউল হাসান পবিত্র কোরআন, মদিনার সনদ এবং বঙ্গবন্ধুর ’৭২-এর সংবিধানে পরমতসহিষ্ণুতার কথা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলা হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, ‘নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। সরকারের সেরকম পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী, ধর্মব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী বাবুনগরী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তান্ডব নিয়ে মিথ্যা বক্তব্য দিচ্ছেন। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাই। সরকারের কাছে দাবি করি- অবিলম্বে এই সন্ত্রাসী মিথ্যাবাদী বাবুনগরীর সন্ত্রাসী জঙ্গীবাদী কার্যক্রমের বিচার করতে হবে।’
আন্তধর্মীয় সংলাপের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক সমাজকর্মী কাজী মুকুল বলেন, ‘বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা ও প্রতিনিধিদের নিয়ে এই ধরনের সম্প্রীতির কার্যক্রম নির্মূল কমিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যাবে। নির্মূল কমিটির বৈদেশিক শাখাগুলোকেও সেসব দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য নিরলসভাবে কাজ করতে হবে।’ ওয়েবিনারে লেখক মারুফ রসুলসহ বহির্বিশ্বে নির্মূল কমিটির ১২টি শাখার নেতারা যুক্ত ছিলেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত