অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন ও দণ্ডবিধি আইনের মামলায় গ্রেপ্তার প্রথম আলোর প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের জামিন শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী রোববার এ বিষয়ে আদেশ দেবেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চার দিন আগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা রোজিনা ইসলাম কেন জামিন পাবেন, তাঁর স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন আইনজীবীরা। অন্যদিকে কেন জামিন দেওয়া যায় না সে কথা আদালতে বলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৯৭ ধারা তুলে ধরে রোজিনার আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, রোজিনা একজন নারী। তিনি অসুস্থ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি নিয়ে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন করার কারণে ষড়যন্ত্র করে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। গত ৫০ বছরে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে কোনো সাংবাদিকের নামে মামলা হয়নি। সচিবালয় আইনগত কোনো গোপন স্থান নয়। রোজিনার বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তির কোনো অভিযোগ নেই। আবার থানায় করা এজাহার আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ রয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ মামলার এজাহারে কী ধরনের তথ্য চুরি হয়েছে, তাঁর কোনো বর্ণনা নেই। আইন অনুযায়ী জব্দ তালিকাও হয়নি।
রোজিনা ইসলামের আইনজীবীরা বলছেন, দণ্ডবিধি ও অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের যে ধারায় রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেসব ধারা জামিন যোগ্য। জামিনযোগ্য ধারার অপরাধে আসামি জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন।
অবশ্য রোজিনা ইসলামের জামিনের বিরোধিতা করে বক্তব্য তুলে ধরেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। তাঁদের যুক্তি, রোজিনা ইসলাম অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ভঙ্গ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নথি চুরি করেছেন। আর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেই ভিডিওতে রোজিনা ইসলাম অপরাধ করার কথা স্বীকারও করেছেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে সেই ভিডিও আদালতে উপস্থাপন করা হবে। আগামী সপ্তাহে জামিন বিষয়ে আদেশের জন্য দিন রাখা হোক।
অবশ্য আদালত আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের ঘণ্টাব্যাপী ভার্চুয়াল শুনানি গ্রহণ করে আগামী রোববার জামিন আবেদনের ওপর আদেশ দেবেন বলে জানান।
রোজিনা নারী এবং অসুস্থ
রোজিনা ইসলামের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী আদালতে বলেন, ‘সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম একজন নারী এবং অসুস্থ এই বিষয়টি ইতিমধ্যে রেকর্ডে এসেছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী, জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে যারা প্রিভিলেজ পারসন তাদের মধ্যে নারী আছেন। তিনি অসুস্থ।
জামিন যোগ্য
রোজিনা ইসলামের আইনজীবীরা আদালতের কাছে দাবি করেছেন, দণ্ডবিধির যে দুটি ধারায় (৩৭৯ ও ৪১১) এবং অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারায় রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এসব ধারা জামিনযোগ্য। জামিনযোগ্য ধারার অপরাধের মামলার আসামির জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর আইনজীবী ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬ ধারা এবং এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন।
আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, রোজিনার বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ধারার অপরাধ হচ্ছে গুপ্তচর বৃত্তি। তবে রোজিনার বিরুদ্ধে ৩ ধারার কোনো অভিযোগ নেই।
গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ ছাড়া অন্যান্য কোনো অপরাধ যদি থাকে, সেই অপরাধ আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য। স্বাভাবিকভাবে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬ ধারা অনুযায়ী, রোজিনা ইসলামের নামে জামিনযোগ্য ধারার মামলা হওয়ায় তিনি জামিন পাওয়ার অধিকারী। সাম্প্রতিক কালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের প্রচারিত রায়েও আমরা দেখেছি, উচ্চ আদালত বলেছেন, জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন দেওয়া ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অন্য কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং যেহেতু এটি জামিনযোগ্য অপরাধ, তাই তিনি জামিনে মুক্তি পাওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন।
এহসানুল হক সমাজী আরও বলেন, জামিনযোগ্য ধারার মামলায় জামিন পাওয়া কোনো দয়া নয়। রোজিনা ইসলামের প্রতি কোনো অনুকম্পাও নয়। তাঁর প্রতি কোনো সহানুভূতি নয়।
সচিবালয় নিষিদ্ধ স্থান নয়, মামলা সাজানো
রোজিনা ইসলামের জামিন শুনানিতে তাঁর আইনজীবীরা বারবারই বলেছেন, সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম গত সোমবার পেশাগত দায়িত্বপালনের জন্য সচিবালয়ে যান। ষড়যন্ত্র করে তাঁকে টানা পাঁচ ঘণ্টা সেখানে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনও করা হয়। পরে মন্ত্রণালয়ের নথি চুরির কল্পিত অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। মামলার ঘটনার সময় এবং আলামত জব্দ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আইন মেনে যথাযথভাবে জব্দ তালিকা হয়নি।
রোজিনা ইসলামের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, ‘মামলার ঘটনার সময় দুপুর ২ টা ৫৫ মিনিট। অথচ জব্দ তালিকা তৈরি হয়েছে ৭ টা ২০ মিনিট। এজাহারের আগেই যে জব্দ তালিকা তৈরি হয়েছে, সেই তালিকা এই এজাহারের নেই। এই এজাহারের মধ্যে জব্দ তালিকার রেফারেন্স নেই। তাহলে এই জব্দ তালিকা, আদৌ কোনো সময়ে, কোন স্থানে, কার কাছ থেকে কি ডকুমেন্টস তৈরি হয়েছে, তার সু-স্পষ্ট তথ্য নেই। জব্দ তালিকাটাই একটা তর্কিত বিষয়। কোনো মামলার জব্দ তালিকা করতে গেলে, ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৩ ধারা অনুযায়ী, জব্দ তালিকা প্রস্তুত করতে হয়। আইন অনুসরণ না করে জব্দ তালিকা করা হয়েছে। এ মামলার সমস্ত ডকুমেন্টস সো কলড ডকুমেন্টস। এটা হচ্ছে একটা কল্পকাহিনী। এই হচ্ছে সৃজিত কাহিনি।’
অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী, সচিবালয় কোনো গোপনস্থান নয়
আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ধারাটি কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। এই মামলার যেখানে ঘটনাস্থল, সেটা কিন্তু নিষিদ্ধ এলাকা নয়। রাষ্ট্রপক্ষের কাছে কী এমন তথ্য আছে, যে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ঘটনাস্থল (মামলার ঘটনাস্থল) নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করেছেন সরকার। নিষিদ্ধ স্থান ঘোষণার পর সেই গেজেট উন্মুক্ত স্থানে টাঙ্গিয়ে নোটিশ দিতে হবে। রোজিনা ইসলামের সচিবালয়ে আমার যাওয়ার আইনগত অধিকার আছে।
কারণ প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের (পিআইডি) কার্ড আছে। তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি সচিবালয়ে গিয়েছিলেন। রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে কল্প-কাহিনি বানানো হয়েছে? কারণ রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
আদালতে ভিডিও’র কথা বলছে রাষ্ট্রপক্ষ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরির তথ্য তুলে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের জামিনের বিরোধিতা করে যুক্তি তুলে ধরেন রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) হেমায়েত উদ্দিন খান। রাষ্ট্রপক্ষের এই সরকারি কৌঁসুলি বলেন, আসামিপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে যে ধারায় মামলা করা হয়েছে, সেটি জামিনযোগ্য। বাস্তবে এসব ধারা মোটেও জামিনযোগ্য নয়। রোজিনা ইসলাম গোপন নথি চুরি করেছেন। আর সম্প্রতি রোজিনা ইসলামের একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
হেমায়েত উদ্দিন খান বলেন, কোনো সাংবাদিক যদি অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য অপর কোনো শত্রুপক্ষের সঙ্গে আঁতাত করে, কোনো ন্যক্কারজনক কাজ করেন, তাহলে সেই আসামি কিন্তু ৪৯৭ এর সুবিধা পেতে পারেন না। আসামি আটক হওয়ার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সমস্ত কথা কিন্তু তিনি স্বীকার করেছেন। তিনি যেসব কাজ করেছেন, সেগুলো তিনি স্বীকার করেছেন। এই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হবে।
অবশ্য রোজিনার আইনজীবীরা বলছেন, সাক্ষ্য আইনের ২৪ ও ২৫ ধারা অনুযায়ী, পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি, মুচলেকার সাক্ষ্যগত কোনো মূল্য নেই।