এক নারী লিপ্সু পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন সাবেক এসপি বাবুল আক্তার। ২০ বছরের চাকরি জীবনে যেখানেই চাকরি করেছেন সেখানেই জড়িয়েছেন নারী কেলেংকারিতে। এসব জানতেন স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। জানতো দুই পরিবারের লোকজনও। বাবুলের অসৎ চরিত্র থেকে ফিরিয়ে আনতে অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু নারী লিপ্সু বাবুলকে কোনো ভাবেই নিবৃত্ত করা যায় নি। এ নিয়ে সংসারে অশান্তি লেগেই থাকতো। দুই সন্তানের দিকে তাকিয়ে সবকিছু সহ্য করেছেন মিতু। কিন্তু তাতেও তার শেষ রক্ষা হলো না। পরিকল্পিত ভাবে ঠাণ্ডা মাথায় ভাড়াটে খুনি দিয়ে তাকে খুন করা হলো। আর এর মধ্যে দিয়ে বাবুলের ভয়ঙ্কর চরিত্রের প্রকাশ পেলো।
বুধবার মিতুর বাবা তার মেয়েকে হত্যার জন্য বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরর পর পিবিআই বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার জাহানের আদালতে শুনানি শেষে এ আদেশ দিয়েছেন। একই সময় আদালত রিমান্ডের প্রতিবেদন ১০ দিনের মধ্যে দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।’
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় সড়কে খুন হন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু। খুনিরা গুলি করার পাশাপাশি ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করে। ঘটনার সময় বাবুল আক্তার ঢাকায় ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তার নিজে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন। ওই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার তথ্য পায়। এরপর গত ১০ মে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে নেয় পিবিআই।
অন্যদিকে, বুধবার দুপুরে মিতু হত্যা মামলায় বাবুলের দায়ের করা হত্যা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পিবিআই। এরপর দুপুর ১টার দিকে পাঁচলাইশ থানায় হাজির হয়ে বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করেন মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন। মামলায় বাবুল আক্তারসহ আট জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলা দায়েরের পর বাদী মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘মামলায় বাবুলের বিরুদ্ধে হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযোগ আনা হয়। এ মামলায় আট জনকে আসামি করা হয়েছে। অপর আসামিদের সঙ্গে সমন্বয় করে সে তার স্ত্রীকে হত্যা করে। কক্সবাজার থাকা অবস্থায় ২০১৩ সাল থেকে অন্য নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে বাবুল। এটি নিয়ে পারিবারিক কলহ দেখা দেয়। ওই ঘটনার জের ধরেই সে মিতুকে হত্যা করে।’ তিনি বলেন, ‘একজন এনজিও কর্মীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। ওই নারী মিতুকে মোবাইলে এসএমএস দিয়ে হত্যার হুমকি দেয়। বাবুল আক্তারের অন্তরঙ্গ ছবি পাঠিয়ে বাবুলের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা জানায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে পারিবারিক কলহ শুরু হয়।’ এতদিন পর কেন মামলা করলেন জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘একটি ঘটনায় দুটি মামলা হয় না। আসামি ছাড়াও মামলা হতে পারে। আইও তদন্ত করে আসামি বের করবে। আর যেহেতু প্রথম মামলাটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তাই আমি মামলাটি দায়ের করেছি। না হলে সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশকে মামলাটি করতে হতো। যেহেতু পুলিশ করেনি, তাই আমি মামলাটি দায়ের করেছি। আগের মামলায় কয়েকজন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো এই মামলায় যোগ হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে তার (বাবুল) সঙ্গে আমাদের কোনও যোগাযোগ নেই। শুনেছি সে একটা বিয়ে করেছে।’ মামলার বাকি আসামিরা হলেন—কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসা, এহতেশামুল হক ভোলা, মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, খায়রুল ইসলাম ওরফে কালু, সাইফুল ইসলাম সিকদার ওরফে শাকু ও শাহজাহান মিয়া। বাবুল ছাড়া এই সাত আসামি আগের দায়ের করা মামলারও আসামি ছিলেন। এর আগে বেলা ১১টার দিকে ঢাকায় পিবিআই সদর দফতরে এক প্রেস ব্রিফিং এ সংস্থাটির ডিআইজি বনজ কুমার সাংবাদিকদের জানান, বাবুল আক্তার বর্তমানে চট্টগ্রামের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হেফাজতে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাবুল আক্তারের করা মিতু হত্যার মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে আমাদের সামনে কিছু প্রশ্ন এসেছে। সেগুলোর সমাধান খুঁজতে গিয়ে মামলা অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। তাই বাবুল আক্তারের মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় মিতুর বাবা একটি মামলা করবেন, সেই মামলায় প্রধান আসামি হবেন বাবুল আক্তার। এই মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হবে।’ মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাবুল আক্তার খ্যাতিমান পুলিশ অফিসার ছিলেন। প্রায় পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে। এই হত্যা মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি। এই মামলাটি আমরা তদন্ত করছি। হাইকোর্টেও এই মামলা নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। তখন এই মামলাটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সেই সময় মামলার বাদী হয়েছিলেন মাহমুদা খানমের স্বামী বাবুল আক্তার। সেই মামলায় দুজন আসামি আনোয়ার ও ওয়াসিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সেখানে বাবুল আক্তারের কোনও সম্পৃক্ততা আসেনি। দেড় বছর ধরে কোভিড-১৯-এর কারণে তদন্তে কিছুটা বিলম্ব হয়। মামলাটি নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে, দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা যাবে না। তাই মামলাটি নিষ্পত্তি করতে কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে। সেই প্রশ্নগুলো সমাধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
আরও যা জানা যায়:
২০১৩ সালে কক্সবাজারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকাকালে ভিনদেশি এক এনজিও কর্মীর সঙ্গে পরকিয়ায় জড়িয়ে পড়েন বাবুল আক্তার। বিষয়টি তার স্ত্রী মিতুর কান পর্যন্ত পৌঁছে। ২০১৪ সালে বাবুল আক্তার সুদানে জাতিসংঘের মিশনে যান। তখন তার বাসায় দুটি বই উপহার পাঠান ওই নারী। বাংলাদেশে রেখে যাওয়া বাবুলের মোবাইল ফোনেও একাধিক মেসেজও পাঠান তিনি। একটি বইয়ে ওই নারী লিখেছেন- আমাদের ভালো স্মৃতিগুলো অটুট রাখতে তোমার জন্য এই উপহার। আশা করি এই উপহার আমাদের বন্ধনকে চিরস্থায়ী করবে। ভালোবাসি তোমাকে…। ওই নারী বাবুল আক্তারের সঙ্গে কাটানো সময়ের স্মৃতিচারণও করেন। মিতুর বাবা জানান, এসব ঘটনায় বাবুল ও মিতুর পারিবারিক অশান্তি চরমে পৌঁছে। বাবুলের এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করলে তিনি মিতুকে নির্যাতন করেন বলে মিতু মৃত্যুর আগে তাদের জানান।