গত ১২ বছরে ছয় লাখ সাত হাজার ৮’শ ৮০ জন অসহায় মানুষকে বিনামূল্য আইনি সহায়তা প্রদান করেছে সরকারি আইনগত সহায়তা সংস্থা। যার মধ্যে ৬৪টি জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির মাধ্যমে ২,৮৯,৯৬৮ জনকে সরকারি খরচে মামলা দায়ের ও আইনজীবী নিয়োগসহ প্রাসঙ্গিক সকল খরচ নির্বাহ করতে সহায়তা করেছে। সহায়তাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১,৪৬,৪১১ জন নারী ও ১,৪২,৪১৫ জন পুরুষ এবং ১১৪২ জন শিশু। সংস্থাটি ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত মোট ৪৭,১২৮টি বিরোধ মোকদ্দমার মধ্যে ৪১,০০২টি বিকল্প পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করেছে এবং উপকারভোগীদের সাতান্ন কোটি নয় লাখ পনেরো হাজার দুইশত আটষট্টি টাকা আদায় করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে ১৩৩৪ টি মোকদ্দমা বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
আইনমন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। মন্ত্রণালয়ের এই যুগান্তকারী উদ্যোগ অসহায় দরিদ্র বিচারপ্রার্থিদের মধ্যে আশার আলো সঞ্চার করেছে।
তবে আইন মন্ত্রণালয়ের এই ভালো উদ্যোগটি প্রচারের আভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে পারছে না। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ অনেকেই জানেনা সরকারের এই সহায়তার কথা। এমন বাস্তবতা নিয়েই আজ দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ। করোনাভাইরাসের কারণে সীমিত পরিসরে উদযাপিত হবে দিবসটি।
এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে “বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে নিশ্চিত করেছে শেখ হাসিনার সরকার।”
আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী জনগণকে আইনগত সহায়তা প্রদান করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ প্রণয়ন করেন এবং জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। কিন্তু ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর এ আইনের বাস্তবায়ন কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যায়। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনরায় সরকার গঠন করলে আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রম সক্রিয়করণের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০১৪ সালে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আনিসুল হক দায়িত্ব গ্রহণের পরেই সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রমকে আরও জনবান্ধব ও সম্প্রসারিত করার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন । তাঁর দিক-নির্দেশনায় সুপ্রীম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস, চৌকি আদালত বিশেষ কমিটি, শ্রম আদালত বিশেষ কমিটি, উপজেলা ও ইউনিয়ন লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন ও সক্রিয়করণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসগুলোতে একজন করে সিনিয়র সহকারী জজ/সহকারী জজ পদমর্যাদার বিচারককে লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মামলা জট কমানোর লক্ষ্যে লিগ্যাল এইড অফিসগুলোকে ‘এডিআর কর্নার’ বা ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কেন্দ্রস্থল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৬ সালে সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রমকে ডিজিটাইজেশন করা হয়। এ ব্যবস্থাপনার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় জাতীয় হেল্পলাইন কলসেন্টার ১৬৪৩০।সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় লিগ্যাল এইড সেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে চালু করা হয় লিগ্যাল এইড অনলাইন কার্যক্রম।
তৃণমূল পর্যায়ে সরকারের জনকল্যাণমূলক আইনি সেবার বার্তা পৌঁছে দেয়া ও সরকারি আইনি সেবার বিষয়ে অধিকতর জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১৩ সালের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৮ এপ্রিলকে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং প্রতি বছর দেশব্যাপী রেলি, লিগ্যাল এইড মেলা, রক্তদান কর্মসূচি, পথনাটক, সভা-সেমিনার আয়োজনের মধ্য দিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালন করা হয়। করোনাভাইরাসজনিত রোগ কোভিড ১৯ এর প্রাদুর্ভাবের কারণে এ বছর সীমিত পরিসরে দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে।দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী এবং আইন ও বিচার বিভাগের সচিব বাণী দিয়েছেন। দরিদ্র, অসহায় ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষকে আইনি সহায়তা প্রদানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়, এবং দিবসের গুরুত্ব তুলে ধরতে দেশের বিভিন্ন জেলায় সীমিত পরিসরে স্ব স্ব কর্মসূচি পালিত হয়।
এদিকে এ দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা তাদের আইনি সহায়তা কার্যক্রমের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছে।
আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রম : সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ থেকে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত সংস্থাটি সর্বমোট ৬,০৭,৮৮০ (ছয় লক্ষ সাত হাজার আটশত আশি) জনকে সরকারি আইনি সেবা প্রদান করেছে; যার মধ্যে ৬৪টি জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির মাধ্যমে ২,৮৯,৯৬৮ জনকে সরকারি খরচে মামলা দায়ের ও আইনজীবী নিয়োগসহ প্রাসঙ্গিক সকল ব্যয় নির্বাহ করতে সহায়তা করেছে। সহায়তাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১,৪৬,৪১১ জন নারী ও ১,৪২,৪১৫ জন পুরুষ এবং ১১৪২ জন শিশু।
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কার্যক্রম: সংস্থাটি জুলাই ২০১৫ হতে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত সর্বমোট প্রাপ্ত ৪৭,১২৮টি বিরোধ/মোকদ্দমার (প্রি-কেইস+পোষ্ট কেইস) মধ্যে ৪১,০০২টি বিরোধ/মোকদ্দমা বিকল্প পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করে উপকারভোগীদের ৫৭,০৯,১৫,২৬৮/- (সাতান্ন কোটি নয় লক্ষ পনেরো হাজার দুইশত আটষট্টি) টাকা আদায় করে দিতে সক্ষম হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ১৩৩৪ টি মোকদ্দমা বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
লিগ্যাল এইড মামলা নিষ্পত্তি : ২০০৯ থেকে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত পারিবারিক, দেওয়ানি, ফৌজদারিসহ সর্বমোট ১,৩৭,৬৫৪ (এক লক্ষ সাঁইত্রিশ হাজার ছয়শত চুয়ান্ন) টি লিগ্যাল এইডের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তিকৃত মামলার মধ্যে দেওয়ানি ১৮,৬৭২ টি, ফৌজদারি ৮৯,৩৯৯ টি, পারিবারিক ২৮,৬৮৭ টি এবং অন্যান্য ৮৯৬ টি। তাছাড়া ২০০৯ থেকে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত সুপ্রীম কোর্টে ২০৪৬ টি মামলায় সরকারি খরচে আইনি সহায়তা দেয়া হয়েছে এবং ১৯,৭৩৭ জনকে আইনি পরামর্শ দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর সুপ্রীম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
শ্রমিক আইনগত সহায়তা সেল : দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শ্রমিকদের আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংস্থা ২০১৩ সালে ঢাকার শ্রম আদালতে ও ২০১৬ সালে চট্টগ্রামস্থ শ্রম আদালতে শ্রমিক আইন সহায়তা সেল স্থাপন করেছে। এ দু’টি সেলের মাধ্যমে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৪,৯৫৫ জনকে আইনি পরামর্শ প্রদান, ৩৩৭০ টি মামলা দায়ের, ৩০০ টি মামলা নিষ্পত্তি, ২৫৮ জনকে চাকুরিতে পুনর্বহাল এবং ৭১ টি সাময়িক বরখাস্তের আদেশ বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া ১১৭৭ টি বিরোধ বিকল্প পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪,৭৮,৯৯,২৩৭/- (চার কোটি আটাত্তর লক্ষ নিরানব্বই হাজার দুইশত সাঁইত্রিশ) টাকা আদায় করা হয়েছে।
কারাবন্দিদের আইনগত সহায়তা : জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা ২০১২ সাল থেকে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত কারাগারে আটকে থাকা ৮৫,৭৫১ জন অসহায় কারাবন্দিকে সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকালে আইনি সেবা কার্যক্রম: করোনাভাইরাসের এ প্রাদুর্ভাবকালে আইন ও বিচার বিভাগের অধীন জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা সাধারণ মানুষের জন্য আইনগত পরামর্শ কার্যক্রম আরো জোরদার করেছে। এ উদ্দেশ্যে ১২ ই এপ্রিল ২০২০ তারিখে জাতীয় হেল্পলাইন ১৬৪৩০ টোলফ্রি নম্বরটি ৮ ঘন্টার পরিবর্তে ২৪ ঘন্টার জন্য চালু করা হয়েছে। ফলে যে কোন সময়ে অসহায় শ্রমিকরা ফোন করে তাদের আইনগত সমস্যা জানাচ্ছে এবং শ্রম আইন অনুসারে তাদের আইনগত অধিকার কি সে বিষয়ে জানতে পারছে। পারিবারিক সহিংসতা বা যে কোনো আইনি বিষয়ে সাধারণ মানুষ ১৬৪৩০ হেল্পলাইন নম্বরের সহায়তা নিচ্ছে। সারাদেশের লিগ্যাল এইড অফিসারদের এ সেবার সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। জরুরি আইনি সেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী লিগ্যাল এইড অফিসারদের কাছে কল ট্রান্সফার করা হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকালে মার্চ ২০২০ থেকে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত এ সংস্থার মাধ্যমে ৫৪,৩০৩ জনকে আইনি পরামর্শ প্রদান, ২৩,১৬৯ জনকে আইনগত সহায়তা প্রদান এবং ১৩,৩৫৪টি মামলা বিকল্প বিরোধ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। একই সময়ে সংস্থাটি ক্ষতিগ্রস্ত বিচারপ্রার্থিদের ২৪,৩২,৩৯,৯৮০ (চব্বিশ কোটি বত্রিশ লক্ষ উনচল্লিশ হাজার নয়শত আশি) টাকা আদায় করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্যভাবে ৯,৬৪৫ টি মামলা নিষ্পত্তি করেছে। করোনাকালীন সংস্থা অনলাইনে আবেদন গ্রহণের মাধ্যমে কারাবন্দিসহ অসহায় বিচারপ্রার্থীদের জন্য প্যানেল আইনজীবী নিয়োগসহ সকল কার্যক্রম সম্পাদন করেছে। এছাড়াও অনলাইন মেডিয়েশনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের এ বৈশ্বিক বিপর্যয়ের সময়ে ৭,৩৬০ জন কারাগারে আটককৃত ব্যক্তিকে আইনগত সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
করোনাকালে জাতীয় হেল্প লাইনের মাধ্যমে আইনি সেবা কার্যক্রম: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার অসহায়, দরিদ্র ও নির্যাতিত সকল শ্রেণীর মানুষের বিচারে প্রবেশাধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে সর্বোত্তম সহজ পন্থায় আইনি সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২৮ এপ্রিল, ২০১৬ তারিখে সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় হেল্পলাইন কলসেন্টার ১৬৪৩০ উদ্বোধন করেন। এরপর থেকেই উক্ত হেল্পলাইন নম্বরে সারা দেশ হতে অসহায় ও সাধারণ মানুষ আইনি পরামর্শ ও তথ্যের জন্য ফোন কল করে যাচ্ছেন। এ হেল্প লাইনের মাধ্যমে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ২৯,২৩৩ জন নারী, ৮১,১৮৬ জন পুরুষ, ১,২৯২ শিশু এবং ২৭ জন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিসহ মোট ১,১১,৭৩৮ (এক লক্ষ এগারো হাজার সাতশত আটত্রিশ) জনকে বিনামূল্যে আইনগত তথ্য সেবা ও পরামর্শ প্রদান করেছে।