বাংলাদেশের হিন্দু বিধবারা স্বামীর সব সম্পত্তিতে (অকৃষি-কৃষি) ভাগ পাবেন বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। বুধবার এ সংক্রান্ত একটি মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ রায় দেন হাইকোর্টের বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একক বেঞ্চ।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, বাংলাদেশে প্রচলিত (১৯৩৭ সালের ‘দ্য হিন্দু ওমেন’স রাইট টু প্রোপার্টি অ্যাক্ট’) যে আইন আছে, সে আইনে স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে কোনো পার্থক্য (কৃষি বা অকৃষি) করেনি। ফলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী স্বামীর রেখে যাওয়া কৃষি জমিতে তার বিধবা স্ত্রী অধিকারের দাবিদার।
খুলনার বটিয়াঘাটার জ্যোতিন্দ্র নাথ মণ্ডলের করা আবেদন (রিভিশন মামলা) খারিজ করে বুধবার বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একক হাই কোর্ট বেঞ্চের দেওয়া রায়ে এ পর্যবেক্ষণ এসেছে।
আদালতে আবেদনকারীর আইনজীবী ছিলেন মো. আব্দুল জব্বার। বিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন নাফিউল ইসলাম।
অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে এ মামলায় মতামত দিয়েছেন দিয়েছেন আইনজীবী উজ্জল ভৌমিক। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
রায়ের পর আইনজীবী উজ্জল ভৌমিক বলেন, “রায়ের এই পর্যবেক্ষণের আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। দেশের নিম্ন আদালত এই পর্যবেক্ষণ মানতে বাধ্য। এই রায়ের ফলে দেশের হিন্দু বিধবা নারীরা (জীবনস্বত্ব) তার স্বামীর রেখে যাওয়া কৃষি জমি ভোগ-দখল করতে পারবেন। এতদিন বিধবা নারীরা শুধু অকৃষি জমির অধিকারী ছিলেন। এখন স্বামীর সব সম্পত্তিতে বিধবা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল।”
এ আইনজীবী বলেন, ১৯৩৭ সালের আগে হিন্দু বিধবারা সম্পত্তির অধিকার পেত সন্তানের অবর্তমানে। ১৯৩৭ সালে ‘দ্য হিন্দু ওমেন’স রাইট টু প্রোপার্টি অ্যাক্ট’ করার পরে স্বামীর রেখে যাওয়া যে কোনো (কৃষি-অকৃষি) সম্পত্তিতে সন্তানের সাথে হিন্দু বিধবা নারীকে সমান অধিকার দেওয়া হয়।
অর্থাৎ বিধবার যদি ছেলেও থাকে তাহলে সে সমান সম্পত্তি পাবে। বিধবার যদি তিনটি ছেলে থাকে তাহলে সে সম্পত্তি সমান চার ভাগ হবে, দুই ছেলে থাকলে সমান তিন ভাগ হবে। এক ছেলে থাকলে সমান দুই ভাগ হবে, এ রকম।
১৯৩৭ সালের এই আইনটি চ্যালেঞ্জ করলে ইন্ডিয়ার ফেডারেল কোর্ট ১৯৪১ সালে কৃষি জমির অধিকারের ক্ষেত্রে হিন্দু বিধবাদের অধিকার বাতিল করে দেয়।
আইনজীবী উজ্জ্বল ভৌমিক বলেন, “১৯৭২ সালের আগে ইন্ডিয়ার ফেডারেল কোর্টের রায় অনুযায়ী এই বিধানই চলে আসছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে ১৯৩৭ সালের ‘দ্য হিন্দু ওমেন’স রাইট টু প্রোপার্টি অ্যাক্ট’ সরাসরি গ্রহণ করে বাংলাদেশ সরকার।
“মূল আইনটিতে যেহেতু হিন্দু বিধবাদের সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রে স্বামীর যে কোনো সম্পত্তির কথা বলা আছে, সেই আইনটিকেই আজকে বিচারিক ঘোষণার মাধ্যমে আরও পরিষ্কার করল।”
বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের আদালত ভারতের ফেডারেল কোর্টের ১৯৪১ সালের দেওয়া রায় অনুসরণ করেছে জানিয়ে এ আইনজীবী বলেন, “যেমন বিচারপতি হাবিবুর রহমানের একটি রায়ে বলা হয়েছিল, হিন্দু বিধবারা স্বামীর কৃষি জমিতে অধিকার পাবেন না। আবার বিচারপতি মোস্তফা কামাল রায়ে (যেটি ৩৪ ডিএলআর) বলেছেন, কৃষি জমিতে অধিকার পাবেন। ভাগ-বাটোয়ারার মামলায় এ রকম সাংঘর্ষিক রায় আছে আমাদের। একমাত্র এই স্বত্ত্ব মামলাটিতেই এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে আসল।”
মামলার নথি থেকে জানা যায়, খুলনার বটিয়াঘাটার হালিয়া গ্রামের অভিমূণ্য মণ্ডল মারা যাওয়ার পর তার রেখে যাওয়া কৃষি জমি স্ত্রী গৌরী দাসীর নামে রেকর্ড হয়।
এই রেকর্ড সংশোধনের জন্য ১৯৯৬ সালে খুলনার সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন গৌরী দাসীর দেবর জ্যোতিন্দ্র নাথ মণ্ডল।
আদালত ওই বছরের ৩০ মে তার আবেদন খারিজ করে দেয়। ১৯৪১ সালের ইন্ডিয়ার ফেডারেল কোর্ট এবং বাংলাদেশের হাই কোর্টের বিভিন্ন রায় অনুসরণ করে জ্যোতিন্দ্র নাথ মণ্ডলের আবেদনটি খারিজ করা হলেও রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলে দেয়, গৌরী দাসী স্বামী অভিমূণ্য মণ্ডলের কৃষি সম্পত্তিতে অধিকার পাবেন না।
এই রায়ের বিরুদ্ধে খুলনার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে আপিল করেন জ্যোতিন্দ্র নাথ মণ্ডল। ওই আদালত ২০০৪ সালের ৭ মার্চ জ্যোতিন্দ্র নাথ মণ্ডলের আবেদন খারিজ করে দেয়।
রায়ে বলা হয়, বিধবা গৌরী দাসী স্বামীর রেখে যাওয়া কৃষি সম্পত্তি পাবেন।
রায়ে আরও বলা হয়, “যেহেতু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধরন পরিবর্তন হয়েছে এবং যেহেতু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সরকার এককেন্দ্রিক এবং কৃষি জমি সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে বাংলাদেশের সংসদের আইনি কোনো অযোগ্যতা নেই, তাই ১৯৪১ সালে ইন্ডিয়া ফেডারেল কোর্টের রায় আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।”
এ রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরেই জ্যোতিন্দ্র নাথ মণ্ডল হাই কোর্টে রিভিশন আবেদন করেন।
এই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে বুধবার উচ্চ আদালত এ রায় দিল।