সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা এবং নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার দায়িত্বে থাকাকালে যে দায়িত্ব পালন করতে পারেন নি বলে অভিযোগ, বর্তমান কমিশনের সঙ্গে এক সংলাপে বসে তারাই দিয়েছেন একগুচ্ছ সুপারিশ। এর মধ্যে কে এম নুরুল হুদা নির্বাচনের সময় বিপুল সংখ্যক আইন শৃংখলা বাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, আর মাহবুব তালুকদার নির্বাচনকালীন সময়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে নেয়ার সুপারিশ করেছেন।
আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমরা ভালো করতে পারব। আপনারা নির্বাচনের ভেতরের ও বাইরের চ্যালেঞ্জের বিষয়ে জানতে পারবেন। নানাভাবে চেষ্টা করব সবগুলো নির্বাচন সফল করার।’
রোববার সাবেক সিইসি, নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিবদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলা হয়।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে সংলাপে যোগ দেন সাবেক সিইসি বিচারপতি মো. আব্দুর রউফ, ড. এ টি এম শামসুল হুদা, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ, সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক, জেসমিন টুলি ও মো. আবদুল্লাহসহ বেশ কয়েকজন।
সংলাপে অংশ নিয়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে মত দিয়ে বলেছেন, নির্বাচন করতে এতো আইনশৃংখলা বাহিনীর মোতায়েনের নজির পৃথিবীর আর কোথ্ওা নেই। আর সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, বিশ্বমানের নির্বাচন করতে হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে।
উল্লেখ্য, বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) গত মার্চ মাস থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সংলাপ করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় কয়েক দফায় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজ, সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপে বসে ইসি।
নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দরকার নেই : নুরুল হুদা
নির্বাচনে সেনাবাহিনী কোনো কাজে আসে না বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। তাই নির্বাচনে সেনা মোতায়েন না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। নুরুল হুদা বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচনে যে পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন হয় এটা বিশ্বে বিরল। মনে হয়, পৃথিবীতে কোথাও নাই। শত-শত, হাজার-হাজার লোক বন্দুক হাতে যুদ্ধাবস্থার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আমি দায়িত্বে থাকতেও বলেছি, এখনো বলেছি যে এসবের প্রয়োজন নাই।’ তিনি বলেন, ‘৭৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজে। আমার যখন স্কুলে ছিলাম তখন দেখতাম একজন চৌকিদার বাঁশি মুখে আর হাতে লাঠি নিয়ে একটা কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করতো। এখন আর্মি, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ নামে। একটা কেন্দ্রে যে পরিমাণ সশস্ত্র সদস্য থাকে তা একটা থানার সমান। এখন তো আমাদের সেই পরিস্থিতি নেই যে, বাক্স আছে লোকজন ব্যালটে ভোট দেবে। এখন আছে ইভিএম। ইভিএম এমন একটা বিষয় যেখানে বাক্স ছিনতাই করা যায় না। একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারে না। নির্বাচন শুরু হওয়ার আগে ইভিএম চালু করা যায় না। এর যথেষ্ট সুবিধা আছে।’
মাহবুব তালুকদার যা বললেন:
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, বাংলাদেশে বিশ্বমানের নির্বাচন করতে হলে একটি নিরপেক্ষ সরকার দরকার। গ্রহণযোগ্য সরকারই কেবল গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারে।
লিখিত বক্তব্যে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আমার মতে, আগামী জাতীয় নির্বাচনের একটাই চ্যালেঞ্জ। তা হলো, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করা। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।’
তিনি বলেন, আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় নির্বাচনের প্রতিটি আসনে অধিষ্ঠিত সংসদ সদস্যদের পদে বহাল রেখে সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারণা বাতুলতা মাত্র। নির্বাচনের পূর্বে সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ না করলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, অর্থাৎ সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
‘জাতীয় নির্বাচনে জেলা প্রশাসকদের তাদের নিজস্ব এলাকায় রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা হয়ে থাকে। জেলা প্রশাসকের বদলে নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তাদের স্থলাভিষিক্ত করা প্রয়োজন। যদি একান্তই জেলা প্রশাসকদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করতে হয়, তাহলে জাতীয় নির্বাচনের আগে তাদের ভিন্ন জেলায় বদলি করা আবশ্যক।’
মাহবুব তালুকদার বলেন, বর্তমানে সংলাপের যে ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা আমার কাছে গতানুগতিক মনে হয়। বিগত কমিশনগুলোর সংলাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমন্ত্রিত সুধীজন প্রায় একই ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন। ইভিএম বা ভোটকেন্দ্রের পাহারা এই মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ নয়।
তিনি বলেন, আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বিশ্বমানের নির্বাচন করতে হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে। পুলিশের কার্যক্রম কঠোরভাবে মনিটর ও নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক।’
সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের সংলাপ প্রয়োজন। আমি যে রূপরেখা উপস্থাপন করলাম, তার বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করা অপরিহার্য। সংবিধান সংশোধন না করা হলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার পরিবর্তন করা যাবে না। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।