ঢাকা   বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১   সকাল ১১:৫৭ 

সর্বশেষ সংবাদ

সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে যা যা বললেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক

সবই পুরোনো প্রশ্ন, কিন্তু সরকারের মন্ত্রীসভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় যিনি সামলাচ্ছেন, সেই আইনমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে একই প্রশ্নই ঘুরপাক খায় সাংবাদিকদের ঠোঁটে। প্রশ্নবানে অনেকটা জর্জরিত আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, প্রধানবিচারপতি নিয়োগ, নির্বাচন কমিশন গঠন, খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গ থেকে ১৮ ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যন্ত বাদ যায়নি কোনো প্রশ্নই। আর সব প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছেন কনফিডেন্টলি। এক প্রশ্নের জবাবে মি. আনিসুল হক সাফ জানিয়ে দিলেন, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড হয় না, যেসব অভিযোগ ওঠে, সেগুলো ঠিক নয়।
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বিদেশি গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন ওকাব আয়োজিত মিট দ্যা ওকাব অনুষ্ঠানে নানা প্রশ্নের জবাব দেন আইনমন্ত্রী।
শুরুতেই আইনমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের কাজ তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। এরপর তিনি ওকাব সদস্য সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
গুম ও ক্রসফায়ারের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্তে স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি নিয়ে এক প্রশ্ন এলে আনিসুল হক বলেন, “আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, আপনারা এক্সট্রা জুডিসিয়াল কিলিং কোথায় পেলেন? এটা আমার উল্টো প্রশ্ন।
“আমার দেখা মতে, বাংলাদেশে কোনো এক্সট্রা জুডিসিয়াল কিলিং হয় নাই। আর সেইজন্যই এরকম দাবি আমলে নেয়ার প্রয়োজন মনে করি না।”
আনিসুল হক বলেন, “আমি যখন প্রথম আইনমন্ত্রী হই, আমাকে বলা হল ২৪১টি এক্সট্রা জুডিসিয়াল কিলিং ও গুমের অভিযোগ। আমি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ডেকে বললাম এই যে ২৪১টি, এগুলোর ব্যাপারে আপনারা আমাকে হিসাব দেন।
“কিন্তু পরে দেখা গেল, এর মধ্যে দুটো সত্য। বাকি ২৩৯টি মিথ্যা। সত্য দুটোর মধ্যে একটা হচ্ছে একজন পুলিশ কর্মকর্তা একজনকে গুলি করে মেরেছেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্ডার কেস হয়েছে। এরকম ঘটনা ঘটলে সরকার আইন অনুযায়ী যে ব্যবস্থা সেটাই নেয়।”
টেকনাফের একরামুল হত্যার পর কোনো মামলা হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে, কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি সরকারকে- এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, “কক্সবাজারে যে আরেকটি ঘটনা হয়েছে সিনহা হত্যা মামলা… তার তো বিচার হয়েছে। যিনি এটা করেছেন, তাকে তো ছাড় দেয়া হয়নি। কেউ যে কোনো অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা করে তাহলে পরে আমি অবশ্যই এটা বলতে পারি, সরকার এটার পদেক্ষেপ নেবে। কারও জন্য আদালতে যাওয়া বারিত নয়।”
র‌্যাবের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, “আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ব্যাপারটাকে নিষ্পত্তি করতে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিচ্ছে।”
ডিজিটাল আইনে সাংবাদিকদের ‘সরাসরি গ্রেপ্তার নয়’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, “এর কিছুটা অপব্যবহার হয়েছে, এটা ঠিক। এর কারণে কিন্তু একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে এই আইনটা আসলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত করছে। কিন্তু আসলে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের কোনোটাকেই সঙ্কুচিত করার জন্য করা হয়নি।”
ওই মামলায় সাংবাদিকদের তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার না করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “যদি কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়, তাহলে প্রথমে সেটির তদন্ত করবে আইসিটি অ্যাক্টের আওতায় গঠিত তথ্যানুসন্ধান সেল। সেই সেল মতামত দিবে যে মামলাটা ওই আইনে নেওয়া হবে কি না?
“স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেছি যে এই রকম মামলা করলে একজন সাংবাদিককে ইমিডিয়েটলি গ্রেপ্তার করা যাবে না। তাকে হয় সমন দিতে হবে, না হলে মামলা নেওয়ার পরে সুযোগ দিতে হবে যাতে তিনি আদালতে এসে জামিন চাইতে পারেন। আর সেলের এনকোয়ারি সম্পন্ন না হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো সাংবাদিককে অ্যারেস্ট করা যাবে না।”
এ বিষয়ে লিখিত কোনো আদেশ জারি করা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “এই ডাইরেকশনটা তো আমরা নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে দিতে পারি না। কিন্তু যেহেতু পুলিশ অ্যারেস্ট করার এখতিয়ার রাখে। ইন্টার্নালি প্রত্যেক থানাতে এরকম জানানো হয়েছে বলে আমার কাছে খবর আছে।”
বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতার ‘নিয়মই নেই’
জ্যেষ্ঠতমকে বাদ দিয়ে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে আনিসুল হক বলছেন, “প্রধান বিচারপতি নিয়োগ রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার, এখানে জ্যেষ্ঠ্যতার কোনো নিয়ম নেই। তাই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলাও সমীচীন নয়।
“প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে পরিষ্কারভাবে সংবিধানে বলা আছে। সেটা মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিরবচ্ছিন্ন এখতিয়ার। সেখানে কাকে তিনি প্রধান বিচারপতি বানাবেন সেটা তার প্রজ্ঞার বিষয়। সেজন্য এখানে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের বিষয়টা আসে না। লঙ্ঘনের বিষয়টা তখনই আসে যখন সেখানে একটা নিয়ম থাকে। এখানে কিন্তু এমন কোনো নিয়ম নেই যে যিনি জ্যেষ্ঠ তাকেই করতে হবে।”
আইনমন্ত্রী দাবি করেন, বিচারিক ব্যবস্থার জন্য যে অবকাঠামোর ঘাটতি ছিল, গত কয়েক বছরে তা ব্যাপক আকারে উন্নতি হয়েছে।
“জেলা শহরগুলোতে গিয়ে এখন যে সবচেয়ে লম্বা ভবনটি দেখবেন, সেটি হচ্ছে আদালত ভবন। জেলা শহরে আটতলা, দশতলা করে ভবন হয়েছে। সরকার দুই হাজার দুইশ কোটি টাকার ই-জুডিশিয়ারি প্রজেক্ট নিয়েছে। সেটি হলে দ্রুত মামলার নিস্পত্তি হবে। ই-জুডিসিয়ারির মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট করা যাবে।”
“আমাদের বিশ্বাস এসব উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে ৩৯ লাখ মামলার জট আমরা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারব,” বলেন তিনি।
নির্বাচন কমিশন গঠন প্রসঙ্গে:
প্রশ্ন আসে নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ নিয়ে। আইনমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছেন। সেখান থেকে যেসব নাম আসবে সার্চ কমিটি তার মধ্যে থেকে ১০ জনের নামের সুপারিশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। এর মধ্যে থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আর চারজন কমিশনার নিয়োগ করবেন। মন্ত্রী জানান, সময় সময় স্বল্পতার কারণেই এখন আইন প্রণয়নের সময় নেই । ফলে রাষ্ট্রপতির সার্চ কমিটির মাধ্যমেই নির্বাচন কমিশন হবে। তিনি বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছেন, “যদিও সার্চ কমিটির গেজেটটা আইন নয়, কিন্তু এটা যেহেতু সবার কনসেন্সের মাধ্যমে হয়েছিল। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেটা গেজেট করেছিলেন। সেটা কিন্তু আইনের কাছাকাছি।’তবে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করা দরকার উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন এটা রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ আইন হবে। ফলে সংসদে সর্বসম্মত আলোচনার মাধ্যমে এ আইন হতে হবে।

‘২০১৮ এর নির্বাচন প্রসঙ্গ:

২০১৮ সালের নির্বাচনকে আপনি কত নম্বর দেবেন- এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলে আইনমন্ত্রী বলেন, “দ্যাখেন, আমি পরীক্ষার খাতা দেখতে বসি নাই।”
নিজের আসনে সুষ্ঠু ভোট হয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, “আমার আসনে (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪, কসবা-আখাউড়া) বিএনপি চারজনকে প্রার্থী দিয়ে রেখেছিল। অনেকটা অকশনের মতো, যে বেশি পয়সা দেবে…। তাদের সেই দোষ যদি আমাদের উপর চাপাতে চান, তাহলে আমি সেটার দায় নিতে রাজি না।”
এই প্রসঙ্গে আনিসুল হক বলেন, “১৯৯৬ সালের নির্বাচনও দেখেছি। আগে আরও অনেক ভোটও দেখেছি। নির্বাচনে যদি কেউ না আসে… তো তাকে মানুষ কি ভোট দেওয়ার জন্য গিয়ে বসে থাকবে?”
ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে আনিসুল হক বলেন, “১৯৭৫ পরবর্তী নির্বাচনগুলো হয়েছিল, তার যে ইমপ্যাক্ট সেটা এখনও মানুষের মনে রয়ে গেছে। সেই ভীতিটা এখনও সম্পূর্ণভাবে দূর হয়নি। ডিজিটালি এখন আমরা অনেকটাই অগ্রসর হয়েছি। কানেক্টিভিটি নেটওয়ার্ক অনেক বেড়ে গেছে। আমার ধারণা, আগামী নির্বাচনে মানুষ অনেক বেশি ভোট দিতে আসবে।”
খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গ:
বিএনপির চেয়ারপারস খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে হলে আগে কারাগারে ফিরতে হবে বলে এর আগে বলেছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
এ নিয়ে এক প্রশ্নে বৃহস্পতিবারের সভায়ও তিনি একই কথা বলেন।
কারাগারে গেলেই খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন? হাইপোথিটিক্যালি বিষয়টা কী দাঁড়ায়- এক সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে আনিসুল বলেন, “হাইপোথিটিক্যাল কোনো প্রশ্নের জবাব আমি দেব না।”
খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে পরিবারের দরখাস্তের কথা উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, তার আত্মীয়-স্বজন একটা দরখাস্ত করেছিলেন। সেখানে কোনো আইনের ধারার কথা উল্লেখ ছিল না। তারপরও সেই দরখাস্তকে গণ্য করে ফৌজদারি আইনের ৪০১ ধারার বিধান অনুযায়ী সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ স্থগিত রেখে শর্তযুক্ত মুক্তি দিয়েছে। শর্ত হলো তিনি বাসায় চিকিৎসা নেবেন, কিন্তু বিদেশ যেতে পারবেন না। আনিসুল হক বলেন, ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন না হলেও সেদিন আনন্দ করে তার জন্মদিন পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনি লে. কর্নেল আবদুর রশিদকে ১৯৯৬ সালে ভোটার বিহীন নির্বাচনে বিরোধী দলীয় নেতা বানিয়ে ছিলেন খালেদা জিয়া। তার ছোট ছেলে মারা গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমবেদনা জানাতে বাসায় গেলে তাঁর (প্রধানমন্ত্রীর) মুখের সামনে গেইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এতকিছুর পরও তাকে শর্তযুক্ত মুক্তি দেয়া হয়েছে। তারপরও কেন মানবিকতার প্রশ্ন ওঠে, প্রশ্ন রাখেন আইনমন্ত্রী।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ওকাবের সমন্বয়ক বিবিসির সংবাদদাতা কাদির কল্লোল। ওকাবের সদস্য জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ফরিদ হোসেন ও ওকাবের সদস্য সচিব নজরুল ইসলাম মিঠুও সভায় বক্তব্য রাখেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত