ঢাকা   শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১   রাত ৩:২৮ 

সর্বশেষ সংবাদ

সাম্প্রদায়িক হামলা: ভারতের সতর্ক প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিবিসি যা বলছে

বাংলাদেশে গত কয়েকদিনে বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের মন্দির, পূজামন্ডপ ও ঘরবাড়িতে একের পর এক হামলার পরও প্রতিবেশী ভারতের প্রতিক্রিয়া রীতিমতো সতর্ক ও সাবধানী থেকেছে।
অথচ অতীতে একই ধরনের ঘটনায় ভারত ঘটনাস্থলে দূতাবাসের প্রতিনিধি পাঠিয়ে খোঁজখবর নিয়েছে, ভারতীয় কর্মকর্তারা গিয়ে স্থানীয় হিন্দুদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন – কিন্তু এবারে তার কোনওটিই করা হয়নি।
বরং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শেখ হাসিনা সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে তাদের আস্থা আছে, ভারত আপাতত এটুকু বলেই তাদের দায় সেরেছে।
দিল্লিতে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই সঙ্কটের মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে আরও বিব্রত করা সমীচীন হবে না – এই ভাবনা থেকেই ভারত এমন সংযত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।
হাসিনার ওপর দিল্লির ভরসা
বস্তুত সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশের নাসিরনগর, সিলেট বা মুরাদনগর-সহ বিভিন্ন স্থানে যেখানেই হিন্দুরা আক্রান্ত হয়েছেন, প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভারত বেশ কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।
এমন কী, বহু জায়গায় ভারতীয় কর্মকর্তারা গিয়ে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের হিন্দুদের অধিকারের পক্ষেও কথা বলেছেন।

সেই তুলনায় গত সপ্তাহে কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, চট্টগ্রামে ব্যাপক হামলা ও হিন্দুদের প্রাণহানির পরও দিল্লির প্রতিক্রিয়া কিন্তু ছিল বেশ সাবধানী।
এ পর্যন্ত ভারত রাষ্ট্র হিসেবে ওই ঘটনায় একটিই মন্তব্য করেছে – দিনপাঁচেক আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী তার নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে শুধু বলেছেন, “ধর্মীয় জমায়েতে হামলার ওই অপ্রীতিকর ঘটনাগুলোর বিচলিত করার মতো খবর আমাদেরও নজরে এসেছে।”

ছবি-ইন্টারনেট।

তবে শেখ হাসিনা সরকার যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় খুব দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করেছে এবং সরকার ও সুশীল সমাজের সহযোগিতায় দুর্গাপুজো সম্পন্ন হতে পেরেছে – সেটাও তিনি একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা নিয়ে ভারতের শাসক দল বিজেপির নেতা বা এমপি-রা যেখানে লাগাতার প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন এবং সোশ্যাল মিডিয়াতেও আগুন ঝরাচ্ছেন – সেখানে তাদের দলের সরকারের এই ধরনের সংযত প্রতিক্রিয়া কিছুটা বেমানান অবশ্যই।
ভারত উদ্বিগ্ন
দিল্লির গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভিআইএফের সিনিয়র ফেলো শ্রীরাধা দত্ত কিন্তু মনে করেন কূটনৈতিক বাস্তবতা অনুধাবন করেই ভারত সরকার প্রকাশ্যে অন্তত এধরনের একটা অবস্থান নিয়েছে।
তিনি বলছিলেন, “শেখ হাসিনা তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে এই মুহুর্তে দিল্লির যা সম্পর্ক, তাতে ফোন তুলে যে কোনও সময় সব কথাই বলা যায়, এবং বলাও হয়। কমিউনিকেশন চ্যানেলগুলো সব চালুই আছে।”
“বাংলাদেশের ঘটনায় ভারতের উদ্বেগ অবশ্যই আছে, কিন্তু তা নিয়ে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে সে দেশের সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলাটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।”

গোয়েন্দা তথ্যর অভাব :
“উনি তো ইতিমধ্যে বলেইছেন এই সব ঘটনায় দোষীরা কেউ ছাড় পাবে না … কিন্তু সেটা বাদ দিলেও ভারতের একটা উপলব্ধি আছেই যে এটা যদি কেউ অ্যাড্রেস করতে পারেন তো সেটা শেখ হাসিনাই পারবেন।”
“ফলে এই মুহুর্তে তাঁকে আরও কোণঠাসা না-করাই ভারতের লক্ষ্য। কিন্তু বিবৃতি না-দিলেও যতদূর জানি, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে তাঁদের পর্যায়ে বিষয়টা নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগে আছেন।”
এর পাশাপাশি হিন্দুদের ওপর হামলা যেভাবে খুব অল্প সময়ের ভেতর বাংলাদেশের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই ঘটনার ব্যাপকতাও অপ্রত্যাশিত ছিল, ছিল না তেমন গোয়েন্দা তথ্যও।
আর সেটাই দিল্লিকে বেশ কিছুটা হতচকিত করে দিয়েছিল – বিবিসিকে বলছিলেন শ্রীরাধা দত্ত।
তাঁর কথায়, “আমাদের থিঙ্কট্যাঙ্ক লেভেলেও বিষয়টা নিয়ে খুব সমালোচনা হচ্ছে। কীভাবে এত বড় হামলা হতে পারল, কেই আগেভাগে কিছু জানতেই পারল না – এটা নিয়েও নানা রকম প্রশ্ন উঠছে।”
পরিকল্পিত হামলা?
“বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে হিন্দুদের ওপর হামলা আগেও হয়েছে, কিন্তু এবারের হামলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে খুব পরিকল্পিতভাবে একটা যেন সংগঠিত আক্রমণ চালানো হয়েছে।”
“দুর্গাপুজোর মন্ডপে হামলা বা মন্দিরে ভাঙচুরের ঘটনাও নতুন কিছু নয় – কিন্তু এইবারে যেটা হয়েছে তা নজিরবিহীন!”, মন্তব্য শ্রীরাধা দত্তর।
ঢাকায় ভারতের প্রাক্তন হাই কমিশনার ও সাবেক কূটনীতিবিদ পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী আবার মনে করছেন, বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা একটা বৃহত্তর হাসিনা-বিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই ভারতের বিশ্বাস, আর এই পরিস্থিতিতে দিল্লি সর্বতোভাবে তাঁর পাশে দাঁড়াতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক।

হাসিনা-বিরোধী ষড়যন্ত্র?
মি চক্রবর্তী বিবিসিকে বলছিলেন, “এর পেছনে যে গভীর ষড়যন্ত্র আছে, সেটা ভারত ভালই বুঝতে পেরেছে। আর সেই ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য হল সাম্প্রদায়িক তাস ব্যবহার করে শেখ হাসিনাকে অপ্রস্তুত করা।”
“এখন যদি ভারত এই ঘটনার কঠোর নিন্দা করে বিবৃতি দিতে যায় সেটা তো প্রকারান্তরে হাসিনা সরকারেরই নিন্দা করা হয়ে যাবে। কিন্তু তাতে ভারতের কোনও উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না।”
“কিন্তু ভারত শেখ হাসিনাকে এই বার্তাটা অবশ্যই পাঠাচ্ছে যে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনুন – এবং তাঁকে আমরা যতটুকু চিনি, তাতে এটাও জানি যে তিনি অবশ্যই সেটা করবেন।”
তালেবান ও পাকিস্তানের প্রভাব?
এর পাশাপাশি আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবানের প্রত্যাবর্তন ও পাকিস্তানের ভূমিকাও বাংলাদেশের এই সব ঘটনায় প্রভাব ফেলেছে বলে পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর বক্তব্য।
তিনি বলছিলেন, “কাবুলে যা ঘটেছে তাতে বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা যে উৎসাহিত বোধ করছে তা তো অস্বীকার করা যাবে না। ইসলামী নেটওয়ার্ক যেগুলো আছে, তাতেও পাকিস্তানের হাত আছে এবং সেখান থেকে রোজ গরম গরম কথা বলা হচ্ছে।”
“এরা যেমন লাগাতার ভারত-বিরোধী প্রচার চালাচ্ছে, তেমনি হাসিনাকেও ভারতের চাটুকার হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। এর কোনওটাই অবশ্য নতুন কথা নয় – কিন্তু বাংলাদেশে ইদানীং এরা আবার নতুন করে মাথা চাড়া দিচ্ছে”, মন্তব্য মি চক্রবর্তীর।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের বাড়বাড়ন্ত ঠেকানো ভারতেরও প্রায় ঘোষিত লক্ষ্যের মধ্যে পড়ে – আর সেই উদ্দেশ্য পূরণে শেখ হাসিনা ছাড়া আর কারও ওপর ভরসা রাখা ভারতের পক্ষে সম্ভবই নয়।
সে কারণেই সম্ভবত, গত দশ দিনে বাংলাদেশে শত শত হিন্দু আক্রান্ত হলেও তার জন্য সে দেশের সরকারের মৃদু সমালোচনা করেও ভারত একটি কথাও বলেনি। শুভজ্যোতি ঘোষ, বিবিসি বাংলা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত