স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের ছেলের নামে সরকারি প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটার জমি কেনা, ৮০ লাখ টাকার জমি মাত্র ১৯ লাখ টাকায় রেজিষ্ট্রি করা, দলিল করতে সাব-রেজিষ্ট্রারের ঘুষ দাবির অভিযোগ নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিমন্ত্রীর মাঠ পর্যায়ের নিচুস্তরের একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সমাবেশে প্রকাশ্যে ঘুষের অভিযোগ করার বিষয়টি নিয়ে যশোরসহ সারাদেশেই নানামুখি আলোচনা চলছে।
প্রশ্ন তোলা হচ্ছে প্রতিমন্ত্রী জমি কিনতে এতো টাকা পেলেন কোথায়? মিল্কভিটার নামে কেনা জমি ছেলের নামে দলিল করলেন কেনো? ৮০ লাখ টাকার জমি ১৯ লাখ টাকায় রেজিষ্ট্রি করলেন কেনো? জমির দলিল দ্রুত রেজিষ্ট্রি করার জন্য সাব রেজিষ্ট্রারের উপর চাপ প্রয়োগ করলেন কেনো?
বলা হচ্ছে সরকারের মন্ত্রী হিসেবে সরকারি কাজে জমি কিনলে বিধি অনুযায়ি দলিল হবে এবং এতে সাব-রেজিষ্ট্রার কোনো অনিয়ম করলে তার উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন তিনি। কিন্তু তা না করে প্রকাশ্যে জনসভায় একজন সরকারি কর্মকর্তাকে ঘুষখোর বলা ও তার দপ্তরকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলা অনৈতিক। পুরো বিষয়টি নিয়ে নানা রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
উল্লেখ্য আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস উপলক্ষে গত বুধবার মণিরামপুর উপজেলা প্রশাসন ও বেসরকারি সংস্থা এমআরডিআই আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। সরকারি প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটার ফ্যাক্টরি করার জন্য আমি গত সপ্তাহে আমার ছেলের নামে একটি জমি রেজিস্ট্রি করতে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্নীতির রেট অনুযায়ী টাকা দিতে না পারায় সেই জমি রেজিস্ট্রি হয়নি।’
প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার হলে আইনমন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন অধিদপ্তরের নজরে আসে। নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজিআর) শহীদুল আলম ঝিনুক বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিষ্ট্রারসহ সাতজনকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নোটিশের জবাব দিয়েছেন সাব-রেজিষ্ট্রারসহ সংশ্লিষ্টরা। জেলা রেজিস্ট্রার মো. শাহজাহান সর্দার জানান,‘সমবায় প্রতিমন্ত্রী তাকে মণিরামপুরের মোহরার শামসুজ্জামান মিলনের বিরুদ্ধে অশোভন আচরণের অভিযোগ এনে তাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। বিষয়টি নিবন্ধন মহাপরিদর্শকের দপ্তরে লিখিতভাবে অবগত করে বুধবারই মিলনকে বদলি করা হয়।’
এদিকে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ মণিরামপুর উপজেলার সেই সাব-রেজিস্ট্রার শাহাজান আলীর দাবি, ‘প্রতিমন্ত্রীকে কেউ ভুল তথ্য সরবরাহ করায় তিনি হয়ত এমন বক্তব্য দিয়েছেন। প্রকৃত ঘটনা হলো, ইউনিয়ন পর্যায়ের জমি বেচাকেনার ক্ষেত্রে মোটমূল্যের সাড়ে ৬ শতাংশ টাকার পে-র্অডার রেজিস্ট্রির সময় জমা দিতে হয়। কিন্তু গত ১৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে পে-অর্ডার ছাড়াই মন্ত্রীপুত্র সুপ্রিয় ভট্টাচার্যের অনুকূলে দুইশ শতক (৬ বিঘা) জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য দলিল জমা দেয়া হয়। ফলে পে-র্অডারসহ দলিল জমা দেয়ার জন্য বলা হয়। বিকেল ৫টায় পে-র্অডার কপি জমা দিলে সিরিয়াল ভেঙ্গে তৎক্ষণাৎ দলিলটি রেজিস্ট্রি করে দেয়া হয়। এমনকি রেজিস্ট্রির দুইঘন্টার মধ্যে দলিলের নকলও (সার্টিফাইট কপি) ক্রেতাকে সরবরাহ করা হয়।’
মোহরার শামসুজ্জামান মিলন বলেন, ‘সাধারণত দলিল রেজিস্ট্রির ১৫ দিনের আগে দলিলের নকল (সার্টিফাইট কপি) সরবরাহ করা হয় না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রীর লোকজনের চাপে নিয়মিত অন্যান্য কাজ বাদ রেখে দুই ঘণ্টার মধ্যে তাদেরকে নকল কপি সরবরাহ করতে বাধ্য হয়। এমনকি উপজেলা ভূমি অফিসে নামপত্তনের জন্য ৩০ থেকে ৪৫ কার্যদিবস লেগে গেলেও মন্ত্রীপুত্রের দলিল রেজিস্ট্রির মাত্র তিনদিনের মধ্যে নামপত্তন করে দেয়া লেগেছে। তাহলে এখানে দলিল রেজিস্ট্রি না করে দেয়ার ঘটনা কিভাবে হল?’
এদিকে মণিরামপুর ভূমি ও রেজিস্ট্রি অফিসের একাধিক সূত্র জানায়, স্থানীয় রোহিতা ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামের ৮৪৫ নম্বর খতিয়ানের ৭৬, ৭৭, ৭৯ ও ৮৯ দাগের দুইশ শতক জমি প্রতিমন্ত্রী পুত্রের নামে গত ১৪ সেপ্টেম্বর রেজিস্ট্রি করা হয়। যার রেজিস্ট্রি দলিল নম্বর ৭৬৭১। আর এ জমির নামপত্তনের জন্য উপজেলা ভূমি অফিসে দাখিল করা কেস নম্বর ১২০১ (২০২১-২২)।
ওই জমির বিক্রেতা রোহিতা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানান, মন্ত্রীপুত্র শুভর (সুপ্রিয় ভট্টাচার্য) কাছে তিনি ৮০ লাখ টাকায় জমিটি বিক্রি করেছেন। তবে রেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ১৯ লাখ টাকা।
এদিকে রেজিস্ট্রি অফিসের একটি সূত্র জানায়, মন্ত্রীপুত্রের জমি রেজিস্ট্রির জন্য দলিল লেখক কামরুজ্জামানের সহকারী গৌতম ঘোষ বাপী দলিল জমা দিলে মোহরার মিলন সেটা সঠিক কিনা সেটা যাচাই করতে চাওয়ায় দুপক্ষের মধ্যে বিরোধ বাধে। এরপর পে অর্ডার ছাড়া রেজিস্ট্রি করতে অস্বীকৃতি জানানো এবং তৎক্ষণাৎ নকল কপি সরবরাহ করা নিয়ে আরও ক্ষুব্ধ হন দলিল লেখকরা।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘ওই অফিসে ঘুষ ছাড়া কাজ করা কঠিন। অফিসের লোকজনের দাবি সঠিক না। তার ছেলের দলিল করার জন্য ১০ দিন ধরে ঘুরিয়েছে। পরে এ নিয়ে দলিল লেখকরা কথা বললে তাদের সাথে অসদাচরণ করা হয়। এর প্রতিবাদে সেখানে দলিল লেখকরা কলমবিরতিও পালন করেছে। পরে অভিযুক্ত কর্মচারীকে বদলির পর দলিল লেখকরা বৃহস্পতিবার কাজ শুরু করে।’
সরকারি প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটার নামে কেনা জমি কেন তার ছেলের নামে নিবন্ধন (রেজিস্ট্রি) করা হল- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মিল্কভিটার নামে কেনার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাছাড়া সময়সাপেক্ষও। তাই মূলত জমিটা আটকাতে এ পন্থা নেয়া হয়।’