২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমানসহ পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)।
পুলিশ সদর দফতরের এনসিবি’র এআইজি মহিউল ইসলাম বাসসকে জানান, ‘তারেক রহমানসহ পলাতক আসামীদের দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকরের জন্য সম্ভাব্য দেশগুলোর সঙ্গে এনসিবি ঢাকা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। এছাড়া ইন্টারপোলের রেড নোটিশে নাম ওঠাতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে।’
২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলায় মোট ৪৯ জন আসামী ছিলেন। যাদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।। এদের মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ২৭ জন বর্তমানে কারাগারে আছেন। এছাড়া তারেক রহমান এবং হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জন রয়েছেন পলাতক । কারাগারে থাকা অবস্থায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আব্দুর রহিম কয়েকদিন আগে মারা গেছেন।
দণ্ডিতরা কে কোথায়?
তারেক রহমান:
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত ১২ বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। গ্রেনেড হামালা মামলায় তাঁকে যাবজ্জীবন শাস্তি দেয়া হয়েছে। অভিযোগপত্রে তাকে ‘পলাতক’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অর্থ পাচার এবং দুর্নীতির মামলায় এরই মধ্যে তাঁর সাজা হয়েছে। তারেক রহমানকে ফেরত আনার জন্য ২০১৪ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাজ্যকে চিঠি দেয় ৷ কিন্তু এরপর নতুন কোনো চিঠি বা সরকারি যোগাযোগের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে৷ তিনি ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আটক হয়ে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লন্ডনে গিয়ে আর ফিরে আসেননি৷
লুৎফুজ্জামান বাবর:
বিএনপি সরকারের সময় তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর মি: বাবরকে আটক করা হয়। সে থেকে তিনি কারাগারে আছে। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও লুৎফুজ্জামান মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
আব্দুস সালাম পিন্টু :
বিএনপি সরকারের সময় শিক্ষা উপমন্ত্রী ছিলেন আব্দুস সালাম পিন্টু। এছাড়া তখন তিনি টাঙ্গাইল জেলা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। উপমন্ত্রী থাকলেও তারেক রহমানের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। তিনি আছেন কারাগারে।
আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ:
জামাতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি ছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসামী। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ মামলায় তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় গ্রেনেড হামলা মামলা থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়।
মুফতি হান্নান:
উগ্র ইসলামপন্থী দল হরকাতুল জিহাদের নেতা ছিলেন মুফতি হান্নান। গ্রেনেড হামলা মামলার মূল আসামী। তাঁর স্বীকারোক্তির মাধ্যমেই গ্রেনেড হামলা মামলায় মোড় ঘুরে যায় বলে জানান রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবীরা। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তির পর তারেক রহমান এবং লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অনেককেই এ মামলার আসামী করা হয়। সিলেটে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তিনজনকে হত্যার দায়ে ২০১৭ সালে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সে গ্রেনেড হামলায় ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী আহত হয়েছিলেন। এছাড়া টুংগিপাড়ায় শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলে বোমা পুতে রাখাসহ আরো কয়েকটি বোমা হামলার সাথে জড়িত ছিলেন এ জঙ্গি নেতা।
তাজুল ইসলাম:
তিনি মাওলানা তাজউদ্দীন হিসেবে পরিচিত। বিএনপি সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু তার ভাই। গ্রেনেড হামলার পর তাকে ভুয়া পাসপোর্টের মাধ্যমে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি সেখানেই আছেন বলে জানা যায়। গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তাকে।
হারিছ চৌধুরী:
বিএনপি সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন তিনি। তৎকালীন সরকারে যাদের প্রভাব অনেক বেশি ছিল হারিছ চৌধুরী তাদের মধ্যে অন্যতম। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন শাস্তি দেয়া হয়েছে। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান মি: চৌধুরী। বর্তমানে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত নয়। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ একাধিক দেশে আসা যাওয়া করছেন বলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন। অবশ্য সম্প্রতি তার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে তিনি লন্ডনে আছেন এবং করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।
মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী:
বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর তাকে আটক করা হয়। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিজিএফআই-এর প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী। তৎকালীন প্রভাবশালী সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় এরই মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীকে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুর রহিম :
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা বা এনএসআই-এর সাবেক মহাপরিচালক। গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি ছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসামী। মামলার রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় এরই মধ্যে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। কয়েকদিন আগে করোনা আক্রান্ত হয়ে তার মত্যু হয়েছে।
লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক:
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবেক এ কর্মকর্তা খালেদা জিয়ার ভাগ্নে। এ মামলায় দীর্ঘ সময় তিনি জামিনে থাকলেও এখন তিনি কারাগারে রয়েছেন।
শহুদুল হক :
আওয়ামীলীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার সময় আইজিপি ছিলেন শহুদুল হক। মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড হয়েছে তার। গ্রেনেড হামলা হওয়ার পর তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাষ্ট্র পক্ষ। কারণ, হামলার পর ঘটনাস্থল একবারও পরিদর্শন করেননি মি: হক। শহুদুল হক এক সময় সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। পরে তাকে পুলিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর শহুদুল হককে পুলিশ প্রধানের পদে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। বিএনপি সরকারের সময় পুলিশ প্রধান পদে খুব বেশি দিন থাকতে পারেননি তিনি। আদালত অবমাননার দায়ে দণ্ডিত হওয়ায় তাকে সে পদ ছাড়তে হয়েছিল। ২০০৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ এক বছর আট মাস পুলিশ প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন মি: হক। তিনি বর্তমানে জামিনে আছেন।
মোহাম্মদ আশরাফুল হুদা :
গ্রেনেড হামলার সময় আশরাফুল হুদা ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত অর্থাৎ চার মাসেরও কম সময় পুলিশ প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন আশরাফুল হুদা। মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে তাকে। তিনি জামিনে আছেন।
খোদাবক্স চৌধুরী:
গ্রেনেড হামলার সময় অতিরিক্ত আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন খোদাবক্স চৌধুরী। পরবর্তীতে তিনি আইজিপি হয়েছেন। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনিও বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।
শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ:
বিএনপির টিকিটে কুমিল্লা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। জঙ্গীদের অন্যতম আশ্রয় ও প্রশ্রয় দাতা। গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়। মামলার অভিযোগপত্রে তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে। ধারনা করা হয়, তিনি সৌদি আরবে পলাতক আছেন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন আমেরিকায়:
বিএনপি সরকারের সময় তিনি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিজিএফআই-এর দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তীতে সেনা-সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি ডিজিএফআই-এর প্রধান হয়েছিলেন। সে সরকারের মেয়াদ শেষ হলে তিনি আমেরিকায় চলে যান। তাকে দেয়া হয়েছে দুই বছরের কারাদণ্ড। মামলার কাগজপত্রে তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে।
লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম:
সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
এ ছাড়া সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সাবেক সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান এবং এএসপি আব্দুর রশিদ বর্তমানে কারাগারে আছেন। এ তিনজন বিএনপি সরকারের সময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন।
গ্রেনেড হামলা মামলার আরেক আসামী হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক হানিফ পলাতক রয়েছেন। তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।