খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী কোথায় আছেন কেউ জানেনা। ১৪ বছর ধরে তিনি নিখোঁজ। তার সন্ধানে গোয়েন্দারা দেশে বিদেশে নানা অনুসন্ধান চালিয়েও কোনো হদিস পাচ্ছে না। সিলেটে তার পরিবারের লোকজন এবং আত্মীয় স্বজনরাও হারিছ চৌধুরী সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারছেন না বা দেননা। ফলে খালেদা জিয়ার প্রভাবশালী এই রাজনৈতিক সচিব লাপাত্তা হয়ে কোথায় গেলেন তা নিয়ে নানা রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামাতের ক্ষমতাকালীন প্রধানমন্ত্রীর দাপুটে রাজনৈতিক সচিব ছিলেন হারিছ চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসলেও তার মূল ক্ষমতার উৎস ছিল হাওয়া ভবন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ফখরুদ্দীন -মঈনুদ্দিন সরকার গঠনের পর থেকে হারিছ চৌধুরী হাওয়ায় মিলিয়ে যান। তার কোনো সন্ধান পায়নি ওয়ান-ইলেভেন সরকার। এ সময় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে হারিছ চৌধুরীকে খুঁজতে থাকে গোয়েন্দারা । কিন্তু তার সন্ধান আর মেলেনি। গত ১৪ বছর ধরে তিনি কোথায় আছেন তা স্পষ্ট করে কেউ জানে না।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আলোচিত হাওয়া ভবনের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন হারিছ চৌধুরী। এ ক্ষমতা বলে তিনি দাবড়ে বেড়াতেন সবখানে।
হারিছ চৌধুরীর পারিবারিক ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলোর কেউ বলছেন, তিনি এখন ভারতের করিমগঞ্জেই রয়েছেন। সেখানে তার মামা বাড়ি। সেখানে প্রকাশ্যে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা। সেখানকার একজন আত্মীয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তিনি ব্যবসা পরিচালনা করছেন। আবার অন্য সূত্রগুলো বলছেন হারিছ চৌধুরী লন্ডন রয়েছেন। তিনি সেখানে নির্ভৃতে জীবন যাপন করছেন। মাঝেমধ্যে তাকে লন্ডনের বিভিন্ন এলাকায় মুখভর্তি দাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। তবে কোনো সূত্রই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না তিনি কোথায় আছেন।
হারিছ চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায়। তার নানাবাড়ি ভারতের করিমগঞ্জে। নানাবাড়িতে যাওয়া-আসার সুবাদে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সম্পর্কে আগে থেকেই জানাশোনা রয়েছে তার।
চারদলীয় জোট সরকারের বিদায়ের পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে পতন ঘটে হাওয়া ভবন সাম্রাজ্যের। একের পর এক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হতে থাকেন হারিছ চৌধুরী। এরপর নিজেকে রক্ষা করতে ২০০৭ সালের ২৯ জানুয়ারি জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে ভারতে পালিয়ে যান বিএনপি সরকারের দাপুটে এই নীতিনির্ধারক। ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও আর দেশমুখী হননি তিনি। গুজব রয়েছে, ২০১৫ সালে গোপনে দেশে এসেছিলেন হারিছ চৌধুরী। কিছুদিন সিলেটে অবস্থান করে নিজের সহায়-সম্পত্তি বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে ফের চলে যান ভারতে। সিলেটে হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানান, ২০১৫ সালের পর থেকে প্রায় দুই বছর দেশে কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ করেননি হারিছ চৌধুরী। তখন তিনি মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তবে গত বছর থেকে দেশে নিজের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে ফের যোগাযোগ রাখছেন। দেশের রাজনীতি ও রেখে যাওয়া সম্পত্তির খবরও রাখছেন তিনি। হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সিলেট বিএনপির এক নেতা জানান, বিভিন্ন দেশ ঘুরে বর্তমানে লন্ডনেই থিতু হয়েছেন হারিছ চৌধুরী।
তবে আরেক সূত্রের খবর, ভারতের করিমগঞ্জে তার মামাবাড়ির আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে পুরনো ব্যবসা রয়েছে। হারিছ চৌধুরীও জড়িয়ে পড়েছেন ব্যবসায়। তবে ঠিক কী ধরনের ব্যবসার সঙ্গে হারিছ চৌধুরী জড়িত, তা খোলাসা করতে চাননি তিনি। সেখানে প্রকাশ্যেই চলাফেরা করেন হারিছ চৌধুরী। সেখানে বাংলাদেশি কিছু ব্যবসায়ী থাকলেও হারিছ চৌধুরীর চেহারা ও বেশভূষায় খানিকটা পরিবর্তন আসায় তাকে সবাই চিনতে পারেন না। সেখানকার ব্যবসায়ীরা তাকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবেই জানেন। সূত্র জানায়, প্রায় ছয় মাস আগে নিজের আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠ সিলেট বিএনপির এক নেতার সঙ্গে ইন্টারনেট কলিংয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন হারিছ চৌধুরী। প্রায় আধা ঘণ্টার সেই আলাপে রাজনীতি, দেশে ফেরা-না ফেরা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলাপ করেন তিনি। ওই সময় বিএনপি নেতাকে তিনি জানান, তিনি সুস্থ আছেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। তিনি দেশে ফিরতে চান। দেশে ক্ষমতার বদল ঘটলে এবং খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্বে থাকলে তিনি দেশে ফিরবেন বলে জানান। হারিছ চৌধুরীর স্ত্রী ও সন্তানরাও রয়েছেন দেশের বাইরে। তার স্ত্রী একমাত্র মেয়েকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে আছেন। সেখানে ব্যারিস্টারি করছেন মেয়ে। হারিছ চৌধুরীর ছেলে নরওয়েতে একটি তেল কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন, সন্তানদের সঙ্গে হারিছ চৌধুরীর নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। সূত্র বলছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন নিজের নানাবাড়ি আসামের করিমগঞ্জে আত্মগোপন করে ছিলেন হারিছ চৌধুরী। তিনি ভারতে যাওয়ার কয়েকদিন পর তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও টাকা বস্তায় ভরে সীমান্ত দিয়ে সেখানে পাঠানো হয়। করিমগঞ্জ থেকে মেঘালয়ে গিয়ে কিছুদিন থাকেন তিনি। পরে ভারত থেকে যুক্তরাজ্যে যান। সেখান থেকে ইরানে ভাই আবদুল মুকিত চৌধুরীর কাছে যান হারিছ চৌধুরী। কয়েক বছর সেখানেই ছিলেন। মুকিত চৌধুরী ইরানে একটি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। তবে মুকিত চৌধুরী মারা যাওয়ার পর আর ইরানমুখী হননি হারিছ। হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আসামি হওয়ার আগে দেশে আসার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। এজন্য বিএনপি স্থায়ী কমিটির এক সদস্যের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন হারিছ চৌধুরী। কিন্তু ওই সময় দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাকে দেশে ফিরতে নিষেধ করেন।
সূত্রটি জানিয়েছে হারিছ চৌধুরী এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ প্রসঙ্গে জাতীয়তাবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাসের যুক্তরাষ্ট্র শাখার একজন দায়িত্বশীল নেতা লন্ডনে বসবাসরত হারিছ চৌধুরীর এক নিকটাত্মীয়ের বরাত দিয়ে জানান, ‘হারিছ চৌধুরী ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। নিয়মিত রক্ত পরিবর্তন করতে হয়। ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে দুইবার তিনি আমেরিকাতে চিকিৎসা করালেও আরোগ্য লাভ হয়নি।
জৌলুস নেই চৌধুরী বাড়ির:
হারিছ চৌধুরী’ ঢাকা থেকে সিলেটের কানাইঘাটে গ্রামের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন হেলিকপ্টারে। রাজকীয় বাড়ি বানিয়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন চৌধুরী বাড়ি। তিনি গ্রামে অবস্থানকালে এক মুহূর্তের জন্যও বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটত না। প্রভাব খাটিয়ে বাড়ির ভেতরেই পোস্ট অফিস, কৃষি ব্যাংক, মডেল স্কুল, তফশিল অফিস, দাতব্য চিকিৎসালয়, এমনকি পুলিশ ফাঁড়িও স্থাপন করিয়েছিলেন। আশপাশের সব রাস্তা কাঁচা হলেও তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আড়াই কিলোমিটার রাস্তা পিচঢালা। বাড়ির ভেতর নির্মাণ করা হয়েছিল নজরকাড়া বাংলো, ছিল চিড়িয়াখানাও। চৌধুরীবাড়ির সেই জৌলুস এখন আর নেই। কারণ বাড়ির ‘প্রাণপুরুষ’ সেই চৌধুরী ১৪ বছর ধরে ‘নিখোঁজ’।
যে সব মামলায় দণ্ডিত হারিছ চৌধুরী:
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০১৮ সালে যাবজ্জীবন সাজা হয় হারিছ চৌধুরীর।
একইবছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটাবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হারিছ চৌধুরীর সাতবছরের জেল ও দশ লাখ টাকা জরিমানা হয়েছে। এই মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ারও সাজা হয়েছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যার এক মামলায় হারিছ চৌধুরীসহ ২৮ জনের জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।মামলাটি বিচারাধিন রয়েছে। এ ছাড়া গুশলানে সরকারি বাড়ি দখল করায় দুদকের আমলার আসামিও হারিছ চৌধুরী।