পেগাসাস কাণ্ডে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশেও। দেশের সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ,আমলা অনেকেই এই অতঙ্কের মধ্যে আছেন। কার মোবাইল নজরদারিতে পড়েছে, কে কখন কী বলেছেন এ নিয়ে নিজেরাই এখন আতঙ্কিত। কবে আবার কী ফাঁস হয়ে যায় এ নিয়েও রয়েছে চিন্তা।
প্রসঙ্গত ইসরায়েলি কোম্পানি এনএসও গ্রুপের তৈরি ‘পেগাসাস’ সফটওয়ার ব্যবহার করে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, এমনকি কোনো দেশের ক্ষমতাসীন পরিবারের সদস্যদের ওপরও ফোনে আড়িপাতা হয়েছে এমন খবর প্রকাশ হয়েছে সম্প্রতি। যা নিয়ে তোলপাড় চলছে বিশ্বজুড়ে। ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বরের একটি তালিকা ফাঁস হয়েছে যাদের স্মার্টফোনে আড়িপাতা হয়েছে ।
দ্য গার্ডিয়ান’, ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’, ‘দ্য ওয়ার’সহ ১৭ টি সংবাদমাধ্যমের একটি সম্মিলিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ‘পেগাসাস’ নামে পরিচিত একটি ফোন হ্যাকিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী হাজার-হাজার মানুষকে নিশানা করা হয়েছিল।
ইজরায়েলের ‘এনএসও গ্রুপ’ নামে একটি সংস্থা ‘পেগাসাস’ সফটওয়ার তৈরী করেছে। এই সফটওয়ার মোবাইলে আড়িপাতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এ তথ্য ফাঁস হওয়ার পর এনএসও দাবি করেছে তারা নিজেরা কারো ফোনে আড়ি পাতে না। তাদের সফটওয়ার কেউ কিনে নিয়ে ব্যবহার করতে পারে। সেই সংস্থার তরফে দাবি করা হয়েছে, শুধুমাত্র সরকারি ক্রেতাদেরই বিক্রি করা হয় সেই ফোন হ্যাকিং সফটওয়ারটি। অর্থাৎ কোনো দেশের সরকার ছাড়া এই সফটওয়ার কেউ কিনতে পারেনা এবং ব্যবহারও করতে পারে না।
অতীতে ফোন হ্যাকিংএর জন্য যেসব সফটওয়ার ব্যবহার করা হতো
ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগেসাস সফটওয়্যার সেগুলোর চেয়ে অনেক বেশি আপডেট। এর আগের স্পাইওয়্যার ঘরানার সফটওয়্যারগুলো কার্যকর হওয়ার জন্য ব্যবহারকারীর দিক থেকে অন্তত একটি ক্লিকের দরকার হতো। কিন্তু পেগেসাসের ক্ষেত্রে তা দরকার পড়ছে না। লক্ষ্যবস্তুর ব্যবহৃত ডিভাইসের যেকোনো নিরাপত্তা ত্রুটির ফাঁক গলে এই নজরদারি চালু হয়ে যাবে। ব্যক্তির ব্যক্তিগত বলে কিছুই আর থাকবে না। যখন যাকে খুশি, তার অন্দরেই উঁকি মারতে পারবে। দরকার শুধু গ্রাহকের দিক থেকে একটি সবুজ সংকেত।
পেগাসাস কি বাংলাদেশেও ব্যবহৃত হয়েছে?
বিবিসি বাংলা জানিয়েছে বিশ্বের ১৭টি প্রথম সারির মিডিয়া, সাংবাদিকতা বিষয়ক প্যারিস-ভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ফরবিডেন স্টোরিজ‘ এবং সেইসাথে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের পুরোটা এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি।
অনুসন্ধানে যেসব দেশে ব্যাপকহারে এই নজরদারি চালানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে তেমন ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু ভারতের নাম রয়েছে। তবে তালিকা আরো লম্বা কিনা তা এখনো অপরিষ্কার।
বিশ্বের প্রায় যে ৫০টি দেশে ৫০ হাজারেরও বেশি মোবাইল ফোনে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও‘র তৈরি পেগাসাস নামের সফটওয়ারটি ঢুকিয়ে নজরদারির নজির এই অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে তাতে বাংলাদেশের কোনো টেলিফোন নম্বর রয়েছে কিনা তা এখনও অস্পষ্ট।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট, যারা এই অনুসন্ধান প্রকল্পের অন্যতম অংশীদার, সোমবার প্রকাশিত তাদের এক রিপোর্টে বাংলাদেশের নাম লেখা হয়েছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের ঐ রিপোর্টে ‘কারা এনএসও‘র ক্রেতা?‘ – এ উপ-শিরোনামে (সাব- হেড) ৪৫ টি দেশের নাম লেখা হয়েছে যেখানে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে নজরদারি হয়েছে বা হচ্ছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
সেই তালিকায় ভারত, পাকিস্তানের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার আর যে দেশটির নাম রয়েছে তা বাংলাদেশ।
তবে এই তালিকার সূত্র হিসাবে সিটিজেনস ল্যাব নামে ক্যানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বলা হয়েছে।
২০১৮ সালের তালিকায় বাংলাদেশ:
জানা গেছে, সিটিজেনস ল্যাব, পেগাসাসের ব্যবহার নিয়ে তাদের ২০১৮ সালের এক অনুসন্ধানের পর প্রথম বাংলাদেশের নাম করেছিল। তবে ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টে বলা হয়েছে, “কোনো দেশে কোনো মোবাইল ফোনে পেগাসাসের উপস্থিতি পাওয়ার অর্থ এই যে সেদেশের সরকারই পেগাসাসের ক্রেতা।“
ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত রিপোর্টে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য না দেয়া হলেও, সরকারের একজন মন্ত্রী পেগাগাস কেনা বা ব্যবহারের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন।
সরকারের টেলি যোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারকে উদ্ধৃত করে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার লিখেছে, “টেলিযোগাযোগ বিভাগ বা তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ এই ধরণের কোনো স্পাইওয়্যার কেনেনি। কেনার কোনো প্রশ্নই আসেনা… বাংলাদেশের মানহানির চেষ্টা হচ্ছে।
ইমসি ক্যাচার:
অবশ্য এ বছরের গোড়ার দিকে কাতারের আল জাজিরা টিভি তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলে নজরদারির জন্য বাংলাদেশ গোপনে ইসরায়েলি প্রযুক্তি কিনেছে – যে খবর নিয়ে সেসময় দারুণ হৈচৈ হয়।
জানুয়ারির শেষ দিকে প্রচারিত আল জাজিরার এক দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, পিকসিক্স নামের একটি ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের তৈরি ইমসি ক্যাচার নামে এই যন্ত্র দিয়ে ওয়াই-ফাই, সেলুলার এবং ভিডিও নজরদারি করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা এবং ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চুক্তি হয় এবং ২০১৯ সালে পূর্ব ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরিতে দু’জন ইসরায়েলি গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর চারজন বাংলাদেশি গোয়েন্দাকে প্রশিক্ষণ দেয়।
আল জাজিরা তাদের প্রমাণ হিসাবে নথিপত্র-ছবি-ফুটেজ প্রচার করে, তবে বাংলাদেশে সরকার অবশ্য সেসময় তা অস্বীকার করে।