রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্টুরেন্টে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আজ ১ জুলাই। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর প্লটের হোলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্টুরেন্টে নারকীয় হামলায় চালায় জঙ্গিরা। জঙ্গিদের হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ৯ জন ইতালির নাগরিক, ৭ জন জাপানি, একজন ভারতীয় নাগরিক, একজন বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক। বাকি দুজন হলেন বাংলাদেশি নাগরিক। জঙ্গিরা নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর রাতভর ওই বেকারিতে বেশ কয়েকজন অতিথি ও বেকারির কর্মচারীদের জিম্মি করে রাখে। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে পুলিশ ও র্যাবের যৌথ অভিযানে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালিত হয়। জিম্মি থাকা অন্তত ৩৫ জনকে উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
এদেশে জঙ্গীবাদের ইতিহাসে হলি আর্টিজানের হামলা ছিল নজিরবিহীন ও ভয়ঙ্কর। জঙ্গীরা তাদের সাংগঠনিক শক্তিমত্তা জানান দেয়ার জন্যই এ হামলা চালায়। এর আগে এত বড়মাপের জঙ্গী হামলা কখনও হয়নি। এ হামলার আগে অর্থাৎ পুরো ২০১৫ সাল এবং ২০১৬ সালের প্রথম কয়েক মাসে বিভিন্ন ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে বাংলাদেশে যে কোন সময় বড়মাপের একটি জঙ্গী হামলা হতে পারে। ২০১৫ সালে একের পর এক লেখক, ব্লগার ও প্রকাশক হত্যার সময় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন যে জঙ্গীবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। তারই ইঙ্গিতস্বরূপ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গুলশানে ইতালির নাগরিক চেজারে তাবেলাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মধ্যপ্রাচ্য-ভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট গ্রুপ সে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে। তখন থেকে অনেকেই আঁচ করছিলেন যে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকরা হুমকির মুখে।
শেষ হয়নি বিচার প্রক্রিয়া:
দীর্ঘ পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি হলি আর্টিজান হত্যা মামলার বিচারকাজ। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল এই মামলায় ৭ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। এরপর আসামিরা সবাই জেল আপিল করে। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের রায়ে খালাস পাওয়া একজনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এরপর প্রায় ১৯ মাস পেরিয়ে গেলেও বিচারিক কার্যক্রমের কোনও অগ্রগতি নেই। উচ্চ আদালতে থমকে আছে হলি আর্টিজানে ভয়াবহ হামলা মামলা বিচার।
আদালত ও জেল সূত্রে জানা গেছে, এই মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে তিন জন— মামুনুর রশীদ রিপন, রাকিবুল ইসলাম রিগ্যান ও আসলাম হোসেন র্যাশ ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে উচ্চ আদালতে আপিল করে। এছাড়া বাকি চার আসামি— হাদিসুর রহমান সাগর, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, আব্দুস সবুর খান ও শরিফুল ইসলাম খালিদ ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর খালাস চেয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করেছে। একই দিনে ডেথ রেফারেন্স অনুমোদনের জন্যেও নথিপত্র উচ্চ আদালতে পাঠানো হয়।
আদালত সূত্র জানায়, ট্রাইবুন্যালের রায়ে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান নামে চার্জশিটভুক্ত যে আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষ সেই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য হাইকোর্টে আপিল করেছে। তবে গত ১৭ মাসে কোনও আপিলেরই শুনানি হয়নি। এই আপিলের আবেদন শুনানির জন্য এখনও পর্যন্ত কোনও বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি।
হাইকোর্ট সূত্রে জানা গেছে, ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য ২০২০ সালের ১৬ আগস্ট আলোচিত এ মামলার পেপারবুক প্রস্তুত হয়ে হাইকোর্টে পৌঁছায়। এক হাজার ৯০০ পৃষ্ঠার এই পেপারবুক শুনানির জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। এখন শুধু শুনানির দিন নির্ধারণের অপেক্ষা। করোনা পরিস্থিতির কারণে মামলাটির শুনানি শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না।
জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘হলি আর্টিজান মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের পেপারবুক তৈরি হয়েছে। এটি এখন আদালতে উঠবে। এর পাশাপাশি কেউ যদি আপিল করে থাকে, সেটি ব্যক্তিগত আইনজীবী বা জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই হোক না কেন, তা শুনানি হবে। শুনানি শেষে উচ্চ আদালত যে নির্দেশনা বা আদেশ দেবেন, তাই প্রতিপালন করা হবে।’
গুলশানের এই ঘটনায় হলি আর্টিজানের দুই জন শেফ নিহত হন। এদের একজন সাইফুল ইসলাম চৌকিদারকে প্রথমে সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও পরে মামলার তদন্তে তার সঙ্গে জঙ্গিদের কোনও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এছাড়া জাকির হোসেন শাওন নামে আরেকজন বেকারি কর্মচারী হামলার পর পালিয়ে আসলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে হেফাজতে নেয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক সপ্তাহ পর ওই বছরেরই ৮ জুলাই মারা যান তিনি। শাওনের পরিবারের অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর তার শরীরে অসংখ্য জখমের চিহ্ন ছিল।
মামলার তদন্ত:
বিশ্বব্যাপী আলোচিত এই হামলার ঘটনায় সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডোর নেতৃত্বে পুলিশ ও র্যাবসহ যৌথ বাহিনীর অপারেশনে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া গুলশান থানার মামলাটি তদন্ত করে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি। এই হামলায় মোট ২১ জনের সম্পৃক্ততা পায় তদন্ত সংস্থা সিটিটিসি। এর মধ্যে পাঁচ জঙ্গি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এছাড়া হামলার পরবর্তী পুলিশ ও র্যাবের বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয় আরও আট জন। জীবিত বাকি ৮ জনকে আসামি করে ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
চার্জশিটভুক্ত আট আসামিরা হলো- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ, মামুনুর রশিদ রিপন ও মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান। চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে মামুনুর রশিদ রিপন ও শরিফুল ইসলাম খালিদ ছাড়া বাকি ছয় জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এ মামলার চার্জশিট দেওয়ার সময় রিপন ও খালিদ পলাতক ছিল। পরে এলিট ফোর্স র্যাব ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি গাজীপুর থেকে মামুনুর রশীদ রিপন ও ২৫ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে শরীফুল ইসলাম খালিদকে গ্রেফতার করে।
মামলার চার্জশিটে বলা হয়েছে, আলোচিত গুলশান হামলায় জড়িত বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত কানাডিয়ান নাগরিক ও হামলার মূল পরিকল্পনকারী তামিম আহমেদ চৌধুরী, নব্য জেএমবির নুরুল ইসলাম মারজান, সরোয়ার জাহান, তানভীর কাদেরী, বাশারুজ্জামান চকলেট, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান ও রায়হানুল কবির রায়হান বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। হামলার সময়ই কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়েছিল পাঁচ জঙ্গি— রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, শফিকুল ইসলাম উজ্জল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল।
বিচার প্রক্রিয়া ও রায়
আদালত সূত্র জানায়, আলোচিত এই হামলার মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়ার পর ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করে। ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর এই মামলার প্রথম সাক্ষ্য নেওয়া হয় বাদী এসআই রিপনের। এরপর ধারাবাহিকভাবে মোট ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির পরিদর্শক হুমায়ূন কবিরের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে আদালত ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করেন।
২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান আট আসামির মধ্যে সাত জনকে ৬(২)(অ) ধারায় মৃত্যুদণ্ড ও প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হলো— জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। আদালতের রায়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অন্য ধারাতেও ভিন্ন ভিন্ন সাজার আদেশ দেওয়া হয়। তবে আদালত মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে সকল ধারা থেকেই খালাস দেন।
ভয়ে এখনো কেঁপে ওঠেন গুলশানবাসী:
২০১৬ সালের ১ জুলাই এ হামলায় কেঁপে ওঠে গোটা রাজধানী। গুলশানের ওই রেস্টুরেন্টে জঙ্গীরা আকস্মিক হামলা চালিয়ে হত্যা করে দেশী-বিদেশী ২৩ নাগরিককে। হামলার পাঁচ বছর পর আজও সেদিনের ঘটনা স্মরণে আসলে আঁতকে ওঠে গুলশানবাসী। হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টটি উঠে গেলেও এখন সেখানে বসবাস বাড়ির মালিকেরই। অন্যদিকে ভিন্ন নামে ব্যবসা শুরু করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে হলির মালিক। দিবসটি উপলক্ষে র্যাব পুলিশসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন গভীর শ্রদ্ধায় নিহতদের স্মরণ করবেন।
যে ভাবে হামলা করেছিলো জঙ্গিরা:
ঘটনাস্থল গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়ক। এর শেষ প্রান্তেই লেকের পাড়ে ৫ নম্বর প্লট। হামলার বছর দুয়েক আগে জুন মাসে এখানেই গড়ে তোলা হয়েছিল হলি আর্টিজান বেকারি। ভবনটির ওপরের তলায় ছিল বেকারির রান্নাঘর এবং মালামাল রাখার ঘর। আর নিচতলায় বেকারির বিক্রয়কেন্দ্র। রেস্তরাঁর রান্নাঘর ও অতিথিদের বসার জায়গা। সামনে সবুজ লন। দোতলায়ও ছিল অতিথি বসার ব্যবস্থা। লেকপাড়ের সবুজ লনযুক্ত এই বেকারি ছিল বিদেশীদের কাছে খুবই প্রিয়। খোলা থাকত সপ্তাহের সাত দিনই। শুক্র ও শনিবার সকাল ৮টায় খুলত। বন্ধ হতো রাত ১০টায়। ওই দুদিন এখানে সকালের নাশতার ব্যবস্থা থাকত। বাকি পাঁচ দিন খোলা থাকত সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। বেকারিতে ইতালিয়ান বিভিন্ন ধরনের কেক ও রুটিজাতীয় খাবার আর রেস্তরাঁয় মূলত স্প্যানিশ খাবার বানানো হতো। কমপক্ষে ৫০-৬০ জন অতিথি থাকতেন নিয়মিত। অতিথিদের প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল স্যামন মাছ, কোরাল মাছ, স্প্যানিশ খাবার পায়লা, কালামার ও গামবাস। চিকেন ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বার্গার, পিৎজাও খেতেন অনেকে। শুক্র ও শনিবার সকাল থেকেই বিদেশী অতিথিরা আসা শুরু করতেন। অনেকে বাসা থেকে কাপড় বা ম্যাট্রেস জাতীয় কিছু নিয়ে আসতেন। সকালের নাশতার পর লনে তা বিছিয়ে শুয়ে থাকতেন। তাঁরা দুপুরের খাবার খেতেন। এরপর একেবারে রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরতেন।
এমন একটি বিদেশীপ্রিয় রেস্টুরেন্টেই সেই রাতেই আকস্মিক হানা দেয় দেশীয় ৫ সশস্ত্র জঙ্গী। তারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে বসুন্ধরার বাসা থেকে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার উদ্দেশে রওনা হয়। সেদিন বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার দিকে কাঁধে থাকা ব্যাগে অস্ত্র-গুলি, গ্রেনেড, চাকু নিয়ে বের হয়ে রাত ৮টা ৪২ মিনিটের দিকে সেখানে পৌঁছে। প্রথমে নিবরাস ইসলাম ও মীর সামেহ মোবাশ্বের এবং একটু পর রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম বাঁধন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হলি আর্টিজানের মূল ফটকে যায়। তখন ফটকের নিরাপত্তাকর্মী নূর ইসলাম তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে নিবরাস নিরাপত্তাকর্মীর ডান চোখের নিচে ঘুষি মেরে তারা হলি আর্টিজানের ভেতর ঢুকে যায়। ঢুকেই গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তারা সবাই তরুণ। তারা ঢুকেই জিম্মি করে ফেলে সবাইকে। মুহূর্তেই খবর রটে যায়, গোটা দুনিয়ায়। আল জাজিরা, বিবিসি সিএনএনসহ বিশ্বের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলো প্রচার করে ঢাকার গুলশানে জঙ্গী হামলা। আতঙ্কে কাঁপতে শুরু করে গোটা দেশ। আধা ঘণ্টার মধ্যেই পাঁচ জঙ্গীর কাছে থাকা অস্ত্র-গুলি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে দেশী-বিদেশীদের হত্যা করে। বিভিন্ন রুম, টয়লেট, চিলারঘর, হিমঘর ইত্যাদি স্থান থেকে বিদেশীদের বের করে এনে তারা এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। একপর্যায়ে তারা দেশী-বিদেশীদের গুলি করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। জঙ্গীরা নয়জন ইতালিয়ান, সাতজন জাপানী, একজন ভারতীয় নাগরিক এবং বাংলাদেশের ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবির, ইশরাত আখন্দ, বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন ও দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২৩ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরদিন সকাল পৌনে ৮টায় সেখানে যৌথ বাহিনী অভিযান চালায়। সাঁজোয়া যানের ধাক্কা এবং অবিরাম গুলিতে তছনছ হয়ে যায় ভবনটি। থান্ডার বোল্টের অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গী। অবসান ঘটে এগারো ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির। গোটা জাতি ফিরে পায় স্বস্তি।
এমন একটি নজিরবিহীন জিম্মি দশায় দেশী-বিদেশী নাগরিকদের হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল দেশের সব ক’টা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের আদেশক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও র্যাব সহযোগী সম্মিলিত ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। সকাল ৭টার দিকে প্যারা কমান্ডো হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট রেকি করে। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা শুরু হয়। প্যারা কমান্ডো সদস্যরা ক্রলিং করতে করতে সামনে দিকে এগোতে থাকে এবং গুলি ছুড়তে থাকে পদাতিক ডিভিশন ও স্লাইপার টিম। এ সময় জঙ্গীরাও গুলি ছুড়তে থাকে। ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যে সব সন্ত্রাসী নির্মূল করে প্যারা কমান্ডো টার্গেট এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। পরে অপারেশনের অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে সকাল সাড়ে ৮টায় অভিযানের সমাপ্তি ঘটে। অভিযানে এক জাপানী ও দুজন শ্রীলঙ্কার নাগরিকসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান থান্ডার বোল্টে সব জঙ্গীই সেদিনই নিহত হয়। ঘটনাস্থলেই পড়েছিল পায়ে ক্যাডস, জিন্স প্যান্ট ও মাথায় ক্যাপ পরিহিত সব জঙ্গীর লাশ।
তৎপর আইনশৃংখলা বাহিনী:
ইতিহাসের ভয়াবহ এ হামলায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ খুলে দিয়েছে। জঙ্গীবাদবিরোধী অভিযানের নক্সা নতুন করে সাজায় বাংলাদেশের পুলিশ। জঙ্গীবাদবিরোধী গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং অভিযান পরিচালনার জন্য কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট গঠন করা হয়। এর পাশাপাশি পুলিশ সদর দফতরে একটি আলাদা গোয়েন্দা শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। যাদের কাজ জঙ্গী তৎপরতা সম্পর্কে নজরদারি করা। এ দিবসটির দুদিন আগে অর্থাৎ মঙ্গলবার র্যাব মহাপরিচালক বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই ঘোষণা দিয়েছেন ২০১৬ সালের পর র্যাব অনেক সক্ষমতা অর্জন করেছে। ইচ্ছে করলেও হলির মতো আরেকটা হামলা চালানোর সামর্থ্য নেই জঙ্গীদের। র্যাব এখন ওদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে। হলির হামলার পর এ পর্যন্ত ১৫শ’ জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়। এ বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারাও বলছেন, হলি আর্টিজানের পরে বাংলাদেশে যতগুলো জঙ্গীবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে সেগুলো সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে। বাকি যারা আছেন তাদের নেতৃত্ব পর্যায়ে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার মতো এখনও তাদের যথেষ্ট শক্তি আছে। জঙ্গীরা যাতে সংগঠিত হতে না পারে সেজন্য পুলিশ সজাগ রয়েছে।