দুদকের আবেদনে আদালত ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়ার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন সংবাদ সম্মেলন করে দুষলেন বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে।
খোকনের অভিযোগ, মেয়র তাপস নিজের ‘ব্যর্থতা ঢাকতে’ দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তাকে ‘হয়রানি’ করছেন।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এসে সাবেক মেয়র বলেন, “দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের এক আদেশ বলে আমার এবং আমার পরিবারের আটটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। যে আটটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আমার এবং আমার পরিবারের সাত কোটি ৬২ লক্ষ ৭৪ হাজার ৬০৩ টাকা রক্ষিত রয়েছে।
“আপনাদের অবগতির জন্য জানাতে চাই, দুদক আমার এবং আমার পরিবারের কোনো সদস্যকে কোনোরূপ নেটিস প্রদান না করে, কোনোরূপ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে সরাসরি আদালতের মাধ্যমে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে।”
খোকন বলেন, “আমি মনে করি, এহেন কর্মকাণ্ডে আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশেনের মেয়র তাপস নগর পরিচালনায় তার সীমাহীন ব্যর্থতা ঢাকতে আমার প্রতি বিভিন্ন হয়রানিমূলক এবং বিদ্বেষমূলক আচরণ করে আসছে। আমি ও আমার প্রাণপ্রিয় ঢাকাবাসী এবং প্রিয় দেশবাসী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দুদকের এহেন কর্মকাণ্ড তাপসের প্ররোচনায় সংঘটিত হয়েছে।”
দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দুদকের একজন উপপরিচালক গত রোববার খোকন ও তার পরিবারের কয়েকজন সমস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করার আবেদন করেছিলেন। ঢাকা মহানগরের একজন জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ ওইদিনই তা মঞ্জুর করেন।
এর মধ্যে সাঈদ খোকনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তিনটি তার মা ফাতেমা হানিফের একটি, বোন শাহানা হানিফের দুটি এবং স্ত্রী ফারহানা আলমের দুটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
দুদকের আবেদনে বলা হয়, ওই ব্যাংক হিসাবগুলোতে ‘অস্বাভাবিক ও বিপুল অংকের অর্থ লেনদেন করা হয়েছে, যা ‘সন্দেহজনক’।
“তাই সুষ্ঠু তদন্তের প্রয়োজনে ব্যাংক হিসাবগুলো থেকে অর্থ উত্তোলন, স্থানান্তর বা হস্তান্তর বন্ধ রাখতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যাংক হিসাবগুলো অবরুদ্ধ করা প্রয়োজন।”
ওই ব্যাংক হিসাবের অর্থ এরইমধ্যে ‘স্থানান্তরের চেষ্টা হয়েছে’ দুদকের আবেদনে আদালতে জানানো হয়েছে। তবে সেখানে টাকার কোনো অংক উল্লেখ করা হয়নি।
খোকন তার সংবাদ সম্মেলনে অবরুদ্ধ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিতে দুদকের প্রতি অনুরোধ জানান।
তিনি বলেন, “বর্তমান করোনাভাইরাসের পরিস্থিতিতে আমার এবং আমার পরিবারের ব্যংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ থাকলে আমার ও আমার পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পাওনা বন্ধ হয়ে যাবে। আমার সংসার পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়বে। বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু আমার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।
“আমি দুদককে অনুরোধ করব, আপনারা আদালতের মাধ্যমে আমার জব্দকৃত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে আমাকে স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ করে দেবেন, যেটা আমার এবং আমার পরিবারের সাংবিধানিক অধিকার।”
আমাকে মেরে বড় হতে হবে?’
তাপসকে কীভাবে ব্যর্থ মেয়র বলছেন- এমন প্রশ্ন সাংবাদিকরা রেখেছিলেন সাবেক মেয়র খোকনের সামনে।
উত্তরে তিনি বলেন, “এই তাপস কতটুকু ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন এই শহরের মানুষ জানে। কত পার্সেন্ট ভোট পেয়েছেন এই শহরের মানুষ জানে। যাই হোক, ক্ষমতায় আছেন। মানুষের কাজ করেন।
“ঢাকার মরা লাশটার ওপরও ট্যাক্স বসিয়ে দিয়েছে এই মেয়র। ঢাকার মরা মানুষের উপর ট্যাক্স বসিয়ে দিয়েছে। আপনি কীভাবে ভালোবাসা আশা করেন। আপনার ব্যর্থতার দায় ঢাকার জন্য আর মানুষ পান না? বারবার শুধু আমার উপরেই? কেন? কেন? আমার ঢাকাবাসী দাফনের পয়সাটুকু দিতে পারে না। আমি দাফন ফ্রি করে দিয়েছিলাম।
“আজকে আজিমপুরে গিয়ে দেখেন একটা লাশ নামানোর আগে টিকেট লাগে। ব্যর্থ বলব না তো কি বলব? আজকে এই শহরের মোড়ে মোড়ে একটা স্লিপ নিয়ে লোকজন চাঁদা তোলার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। নেয় কি নেয় না?”
বর্তমান মেয়রের সমালোচনা করে সাবেক মেয়র বলেন, “মানুষের কথা শুনে আমি লক্ষ লক্ষ ব্যানার ফেস্টুন ফেলে দিয়েছিলাম। আর সিটি করপোরেশন নিজের নামে ব্যনার ফেসটুন লাগাচ্ছে। নগর পরিচালনা করতে পরেন না, আরো বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখ? আরে তোমার বড় হওয়ার পথে সাঈদ খোকন বাধা নাকি? তুমি বড় হও, তাতে আমার কী? আমাকে মেরে বড় হতে হবে নাকি?
দুদক কীভাবে চলছে, প্রশ্ন খোকনের
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাঈদ খোকন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দুদক কীভাবে চলছে তা দেশবাসী ‘জানে’।
“তদন্ত করতে আমার কিংবা আমার পরিবারের কোনো আপত্তি নেই। দুদক তদন্ত করতেই পারে। কিন্তু কারও প্ররোচনায় কোনো দলাদলিতে নিজেকে দুদক জড়াবে, একজন নাগরিক হিসোবে আমি এটা প্রত্যাশা করি না। একজন নাগরিক হিসেবে আমি কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকা দেখতে চাই।
“এই শহরের যেমন লক্ষ নাগরিক রয়েছে, কোটি নাগরিক রয়েছে, আমিও একজন সাধারণ নাগরিক। একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে যে প্রাপ্য অধিকারটুকু রয়েছে, আমি সেই প্রাপ্য অধিকারটুকু ফিরে পেতে চাই।
দুদকের অনুসন্ধান নিয়ে প্রশ্ন তুলে সাবেক মেয়র বলেন, “আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কী সন্দেহ স্পষ্টভাবে বলতে হবে। আরে ভাই, এই শহরে কী হচ্ছে মানুষ কি জানে না? দেখে না? দুর্নীতি দমন কমিশনে কী হচ্ছে মানুষ কি দেখে না? জানে না? কী দিয়ে কী করতে চান? শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চান? এটা এই শহরের মানুষ কখনোই মেনে নেবে না।”
সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে খোকন বলেন, “আপনারা জানেন, আমার পরিবার এই শহর, এই নগরী সেবা করে আসছি প্রায় এক শতাব্দি ধরে। প্রায় ৭০ বছরের উপরে হবে, ঢাকার শেষ সরদার মাজেদ সরকার, তার মেয়ে আমার মা ফাতেমা হানিফের অ্যাকাউন্টও ফ্রিজ করা হয়েছে। আমার বৃদ্ধ মাকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়।
“ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র হানিফের স্ত্রী লাঞ্ছিত হবে? এটা ঢাকাবাসী মেনে নেবে না। আমরা যদি ব্যবসা বাণিজ্য করতাম, এই শহরের ধনাঢ্য ব্যক্তি হতাম। ৩৩ বছরের রাজনীতিতে এই শহরের মানুষের জন্য আমার নেত্রীর জন্য মামলা হামলার শিকার হয়ছি। চরম সংগ্রামে রাজপথ ছেড়ে যাইনি। আজকে এই সময় দেখবার জন্য? আজকের এই অবস্থা দেখবার জন্য?
প্রয়োজনে ‘আন্দোলনের পথ’ বেছে নেওয়ার হুমকি দিয়ে খোকন বলেন, “কারও ব্যর্থতা ঢাকবার জন্য আরেক জনের মাথায় কালিমা লেপন করে দেবেন? আমরা এটা মেনে নিতে পারি না।… আইনি মোকাবেলা করব, সাথে সাথে ঢাকাবাসীকে নিয়ে প্রয়োজন হলে আরেকবার সংগ্রাম হবে।”
প্রেক্ষাপট
অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে খোকন ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের মে পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন।
২০২০ সালের নির্বাচনেও তিনি মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে তার জায়গায় যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মনির ছেলে শেখ ফজলে নূর তাপসকে প্রার্থী করে আওয়ামী লীগ। তিনিই এখন দক্ষিণের মেয়র।
গত বছরের শেষ দিকে গুলিস্তান এলাকার বিভিন্ন মার্কেটের অবৈধ দোকান উচ্ছেদ নিয়ে সাবেক ও বর্তমান মেয়রের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে।
দোকান উচ্ছেদ শুরু হলে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তোলে মালিকরা। প্রায় ৩৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে খোকনসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
এরপর ফুলবাড়িয়া মার্কেটে উচ্ছেদ অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের এক মানববন্ধনে যোগ দিয়ে মেয়র তাপসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন সাবেক মেয়র খোকন।
ক্ষমতাসীন দলের এই দুই নেতার পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যে তাপসের সমর্থক দুই ব্যক্তি সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে মানহানি মামলার আবেদন করেন আদালতে।
মেয়র তাপস সে সময় বলেছিলেন, ‘অতি উৎসাহীদের‘ ওই মামলায় তার সায় নেই। পরে একটি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, অন্যটি খারিজ করে দেয় আদালত। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।