ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১   দুপুর ২:৩০ 

সর্বশেষ সংবাদ

সিলেটের তারাপুর চা বাগান, দখলদার রাগীব আলী সুপ্রিমকোর্টের রায় মানছেন না, ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন না, স্থাপনাও সরাচ্ছেন না

গভীর সংকটে পড়েছে সিলেটের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার দেবোত্তর সম্পত্তি তারাপুর চা বাগান। আদালতের নির্দেশে ব্যবস্থাপনা কমিটি দায়িত্ব গ্রহণের পর আলোচিত এ চা বাগান পরিচালনা নিয়ে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ মিলছে না, সাবেক দখলদার রাগীব আলীও আদালত নির্দেশিত ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন না। ফলে অর্থ সংকটে পড়েছে ব্যবস্থাপনা কমিটি। অর্থের অভাবে শ্রমিকদের বেতন দেয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আন্দোলনে নেমেছেন শ্রমিকরা।
শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে সপ্তাহখানেক বন্ধ ছিল বাগানের উৎপাদন। এখন আবার উৎপাদন শুরু হলেও তা অব্যাহত রাখা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শঙ্কা বাগানের ভবিষ্যৎ নিয়েও।

সিলেট নগরের তারাপুর এলাকার এ চা বাগান প্রতারণার মাধ্যমে দখল করে নিয়েছিলেন বিতর্কিত শিল্পপতি রাগীব আলী। ২০১৬ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে রাগীব আলীর দখল থেকে চা বাগানের ভূমি উদ্ধার করা হয়। সে সময় আদালত নির্ধারিত সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে বাগান বুঝিয়ে দেয়া হয়।
তবে গত বছর উচ্চ আদালতের রিভিউ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচিত এ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার কর্তৃত্ব হারান পঙ্কজ গুপ্ত। রিভিউ রায়ে এ সম্পত্তি সংরক্ষণ ও তদারকির জন্য একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয়া হয়। এ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের জেলা প্রশাসক ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করেন। এরপর চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি ব্যবস্থাপনা কমিটি তারাপুর চা বাগানের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
তবে দায়িত্ব গ্রহণের পরই অর্থ সংকটে পড়ে ব্যবস্থাপনা কমিটি। এতদিন কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাগানের কার্যক্রম চললেও ব্যবস্থাপনা কমিটি দায়িত্ব গ্রহণের পর ঋণ দেয়া বন্ধ করে দেয় কৃষি ব্যাংক। ঋণ না পেয়ে গত মাসে শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারেনি কমিটি। আর মজুরি না পাওয়ায় গত ২০ মে থেকে চা পাতা উত্তোলন বন্ধ করে দেন শ্রমিকরা। ফলে বন্ধ হয়ে পড়ে উৎপাদন। ব্যবস্থাপনা কমিটির আশ্বাসে চলতি মাস থেকে আবার কাজে যোগ দিয়েছেন শ্রমিকরা। তবে ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরাই বলছেন, ব্যাংকঋণ বা রাগীব আলীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ না পেলে বাগান পরিচালনা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা জানান, রিভিউ রায়ে চা বাগান ধ্বংসের জন্য শিল্পপতি রাগীব আলীকে সোয়া ৩ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে ও বাগানের ভেতর থেকে স্থাপনা সরিয়ে নিতে বলা হয়। তবে এখন পর্যন্ত রাগীব আলী কোনো ক্ষতিপূরণ তো দেননি, স্থাপনাও সরিয়ে নেননি।
বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে গত ২০ মে সিলেটের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তারাপুর চা বাগানের শ্রমিকরা। সেদিন থেকে তারা পাতা উত্তোলন বন্ধ করে দেন। এরপর গত ২৬ মে শ্রমিকদের সঙ্গে বাগান ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে এক সপ্তাহের বকেয়া মজুরি দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি মাস থেকে কাজে যোগ দেন শ্রমিকরা।
তারাপুর চা-বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি চৈতন্য মোদী বলেন, তারাপুর চা-বাগানের মালিকানা-সংক্রান্ত নানা জটিলতা ও মামলা-মোকদ্দমা থাকায় ঘন ঘন মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছে। বর্তমানে যারা বাগান পরিচালনা করছেন, তারা ঠিকমতো বেতন-ভাতা পরিশোধ করছেন না। শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তিনি বলেন, মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে আমাদের সংসার চলে। এখন এ টাকাও যদি না পাই তবে না খেয়ে মরতে হবে।
চৈতন্য মোদী জানান, গত ২৬ মে বৈঠকের পর ব্যবস্থাপনা কমিটি এক সপ্তাহের বকেয়া মজুরি দিয়েছে। তবে এখনো এক সপ্তাহের মজুরি ও ভাতা বকেয়া রয়েছে। এগুলো না পেলে শ্রমিকরা আবার আন্দোলনে যাবেন।
বর্তমানে তারাপুর চা বাগানে ১৪১ জন শ্রমিক কর্মরত আছেন বলে জানিয়েছেন তারাপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক অপু চক্রবর্তী।
গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর তারাপুর চা বাগান নিয়ে উচ্চ আদালতের রিভিউর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এতে বাগান পরিচালনার লক্ষ্যে পাঁচ বছরের জন্য ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে চা বাগানের সম্পত্তি পরিচালনার পাশাপাশি বাগান দখল করে রাগীব আলী ও তার স্ত্রীর নামে গড়ে তোলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সব স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া বাগান ধ্বংস করে স্থাপনা নির্মাণের জন্য রাগীব আলীকে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেয়া হয়।
আদালতের নির্দেশে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নারায়ণ চন্দ্র সাহাকে সভাপতি করে ১১ সদস্যের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিরল শান্তনু দত্ত সন্তু। তিনি বলেন, আমরা গত জানুয়ারিতে বাগানের দায়িত্ব নিই। এর আগে থেকেই কৃষি ব্যংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাগানের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। চা পাতা বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করা হতো।

সন্তু বলেন, আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বাগানের কার্যক্রম চালিয়ে যাই। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ায় পর ব্যক্তিগত ঋণ পরিশোধের কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু গত ৬ মে কৃষি ব্যাংক থেকে জানানো হয়, যেহেতু এটি দেবোত্তর সম্পত্তি তাই তারা আর ঋণ দিতে পারবে না। ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত জানার পর আমরা বিপাকে পড়েছি।
তিনি আরো বলেন, এক সপ্তাহের বকেয়া মজুরি দেয়ার পর শ্রমিকরা চলতি মাসে আবার কাজ শুরু করেছেন। আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে এ টাকা দিয়েছি। কিন্তু বাগান পরিচালনার জন্য দ্রুত অর্থের সংস্থান না হলে আমাদের পক্ষ থেকে এভাবে টাকা দিয়ে চালানো সম্ভব নয়। কারণ নিজেদের টাকা দিয়ে বাগান চালানোর সংগতি আমাদের নেই। এভাবে চলতে থাকলে আমরা আদালতে গিয়ে নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করব।
দেবোত্তর সম্পত্তি জেনেও এতদিন ব্যাংকঋণ দিয়েছে, অথচ আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর কেন অস্বীকৃতি জানাচ্ছে এমন প্রশ্ন রেখে শান্তনু দত্ত বলেন, আমার মনে হচ্ছে এটি আমাদের ব্যর্থ প্রমাণ করে আবার তারাপুর চা বাগান দখল করার একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বাগানের ভেতর থেকে রাগীব আলীর স্থাপনা সরানো ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশনা প্রসঙ্গে শান্তনু দত্ত বলেন, এগুলো তো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। প্রশাসনকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু প্রশাসনের কাছ থেকে আমরা কোনো সহায়তা পাচ্ছি না।
এ প্রসঙ্গে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে বলেন, আদালত ব্যবস্থাপনা কমিটি করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আমি তা করে দিয়েছি। এখন বাগান পরিচালনার বিষয়টি ব্যবস্থাপনা কমিটি দেখবে।
রাগীব আলীর স্থাপনা অপসারণ ও ক্ষতিপূরণ আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে ব্যবস্থাপনা কমিটি উদ্যোগ নেবে। তারা আমাদের সহযোগিতা চাইলে সহযোগিতা করব।
সিলেট নগরের পাঠানটুলা এলাকার প্রায় ৪২৩ একরের তারাপুর চা বাগান দেবোত্তর সম্পত্তি। প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার এ সম্পত্তি ১৯৯০ সালে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে দখল করে নেন শিল্পপতি রাগীব আলী। এরপর ১৯৯৫ সালে বাগানের ৮দশমিক ২২ একর জায়গার চা গাছ ধ্বংস করে নির্মাণ করেন প্রায় এক হাজার শয্যার জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। মেডিকেল কলেজের পাশে আরো অনেক জায়গাজুড়ে নিজের স্ত্রীর নামে রাবেয়া খাতুন নার্সিং কলেজ, মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের জন্য ছাত্রাবাসসহ বেশকিছু স্থাপনা গড়ে তোলেন রাগীব আলী। এছাড়া বাগান ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে আরো অসংখ্য স্থাপনা।
জেলা প্রশাসনের হিসাবে জানা গেছে, চা বাগানের ভেতরে অবৈধভাবে মোট ৩৩৭টি স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এর বেশির ভাগই বহুতল আবাসিক স্থাপনা।
তারাপুর চা বাগানের মালিক বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্ত ১৯১৫ সালের ২ জুলাই তারাপুর চা বাগানসহ তার সব সম্পত্তি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউর দেবতার নামে রেজিস্ট্রি দানপত্র করে দলিলপত্র করে দেন। বৈকুণ্ঠ গুপ্তের ছেলে রাজেন্দ্র গুপ্ত ও তার তিন ছেলে মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হন। তার তিন মেয়েকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে পাক সেনারা। ১৯৮২ সালে রাজেন্দ্র গুপ্তের ছেলে পঙ্কজ গুপ্ত ভারতে চলে যান। এ সময় পার্শ্ববর্তী মালনীছড়া চা বাগানের স্বত্বাধিকারী রাগীব আলীকে তারাপুর চা বাগান দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে যান। এরপর পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মূলে দেবোত্তর সম্পত্তিটির সেবায়েত বনে যান দেওয়ান মেস্তাক মজিদ, যিনি রাগীব আলীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তিনি রাগীব আলীকে ৯৯ বছরের জন্য বাগানটি লিজ দেন। ১৯৯০ সালে বাগানটির দখল নেন শিল্পপতি রাগীব আলী।
২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি তত্কালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে হাইকোর্টের আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ দেবোত্তর সম্পত্তি তারাপুর চা বাগান রাগীব আলীর দখল করাকে প্রতারণামূলক আখ্যা দিয়ে পুরো বাগান সেবায়েত পঙ্কজ গুপ্তকে বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে বাগান দখল করে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ছয় মাসের মধ্যে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়।
এ নির্দেশনার পর ওই বছরের ১৫ মে জেলা প্রশাসন রাগীব আলীর দখল থেকে চা বাগানের ভূমি উদ্ধার করে সেবায়েত পঙ্কজ গুপ্তকে বুঝিয়ে দেয়। বাগানের ৪২২ দশমিক ৯৬ একর ভূমির মধ্যে ৩২৩ একর ভূমি সেদিন সেবায়েতকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। তবে বাগানের ভেতরে জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নার্সিং কলেজসহ রাগীব আলীর নির্মিত সব স্থাপনা বহাল থাকে। মেডিকেল কলেজসহ স্থাপনাগুলো না সরাতে উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেন রাগীব আলী। এ আবেদনও খারিজ হয়ে যায়। তবে রিভিউ রায়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসাইনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চ পংকজ গুপ্তের সেবায়েত দাবিও খারিজ করে দেন। (দেবাশীষ দেবু ,বণিক বার্তা।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত