১৭ই এপ্রিল ১৯৭১ – মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় এক আমবাগানে শপথ নেয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার।
শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেলে। তাঁর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন মেহেরপুরে তাৎক্ষণিকভাবে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে।
সেখানে তিনি বলেন, ”সমবেত সাংবাদিক বন্ধুগণ এবং উপস্থিত জনসাধারণ, আপনাদের সামনে আমার মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রীকে আপনাদের সামনে সর্বপ্রথমে উপস্থিত করছি। জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ।”
এ সময় সবাই হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানান।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ছাড়াও তিনি মন্ত্রী হিসাবে অনুষ্ঠানে হাজির করেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে।
সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর নাম ঘোষণা করা হয়।
এই মুজিবনগর সরকারের অধীনেই পরিচালিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ।
মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা – যা পরে মুজিবনগর নামে পরিচিতি পায় – সেখানে অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল, তা আয়োজনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন সেসময় মেহেরপুরের সাবডিভিশনাল অফিসার তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
মি. চৌধুরী বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন ওই অনুষ্ঠান আয়োজনের নানা খুঁটিনাটি কথা।
”আমি এবং আমার বন্ধু মাহবুব, আমাদের সহযোগিতায় তাজউদ্দীন সাহেব এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে আমরা সীমান্ত পার করে ভারতে নিয়ে গিয়েছিলাম,” বিবিসিকে জানাচ্ছিলেন তিনি।
”সেই সুবাদে তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং পরের দিকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। আমরা টেলিফোনে কলকাতার সঙ্গে মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গার সংযোগ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলাম।”
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ”এরই ধারাবাহিকতায় যখন সরকার গঠন করার প্রয়োজন দেখা দিল, তখন আমাকে বলা হলো যে অতিসত্বর সরকার গঠন করা হবে, তোমাদের দিক থেকে একটা প্রস্তুতি নাও। ধারণা দেয়া হলো যে ওই এলাকাটায় এটি গঠিত হতে পারে।”
”কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে তখন আমরা পিছু হটতে শুরু করেছি। পাকিস্তান আর্মি যশোর থেকে আক্রমণ শুরু করেছে, চুয়াডাঙ্গায় বম্বিং শুরু করেছে। আর্টিলারির সহায়তায় তারা বেশ অগ্রসর হচ্ছে। টেকনিক্যাল রিট্রিট বলতে যেটা বোঝায়, আমরা সেটা এর মধ্যেই শুরু করে দিয়েছি।”
”এসব ঘটনার মধ্যেই আমাদের মাঝে মাঝে বলা হচ্ছে যে, তোমরা তৈরি থেকো, সরকার গঠন হতে পারে। এরকম সময়ে ১৫ই এপ্রিলের দিকে আমরা যখন মেহেরপুরে চলে এসেছি, তখন আমাকে খবর দেয়া হলো যে একটা জায়গা তোমরা বাছাই করো,” স্মৃতিচারণ করছিলেন মি. চৌধুরী।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর কাছে প্রশ্ন ছিলো যে বৈদনাথতলার ওই স্থানটিকে বাছাই করার ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো আমলে নেয়া হয়েছিল?
জবাবে তিনি বলেন, এমন একটি জায়গা বাছাই করতে বলা হয়েছিলো যেখানে ভারত থেকে সহজেই ঢোকা যায়, যে এলাকা শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে – বিশেষ করে আকাশ থেকে এবং বাংলাদেশের দিক বিবেচনা করলে একটু যেন দুর্গম হয়।
”লেফটেন্যান্ট কর্নেল চক্রবর্তী নামে বিএসএফের একজন কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বৈদ্যনাথতলার আমবাগানটি বাছাই করা হলো। সেখানে আমবাগান থাকায় আকাশ থেকে সহজে দেখা যায় না। মেহেরপুর থেকে ১০/১২ কিলোমিটার দূরত্বে হলেও রাস্তাঘাট নষ্ট থাকায় সহজে যাওয়া যায় না। আবার ভারত থেকে সহজেই সেখানে প্রবেশ করা যায়।”
তিনি বলেন, পুরো বিষয়টির আয়োজন করা হয়েছিল খুবই গোপনে।
‘কী হবে সেটা কাউকে বলিনি। তখন আমাদের সীমান্ত এলাকায় রেগুলার ইপিআর নিয়ে গিয়েছিলাম, সেই সঙ্গে আনসারের একটি ছোট কন্টিনজেন্ট রেখেছিলাম – সীমান্তের প্রতীকী নিরাপত্তার জন্য।”
মি. চৌধুরী বলেন, ”তাদের কাছে গিয়ে আমরা বললাম যে, ভারতের দিক থেকে কয়েকজন লোক আসতে পারে। এখানে একটা জায়গায় অনুষ্ঠান হতে পারে, তোমরা তাদের সাথে যোগাযোগ রেখো এবং যা বলে করো। পরে খবর পাঠানো হলো যে ১৭ই এপ্রিল তোমরা প্রস্তুত থেকো।”
ওই সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে পিছু হটে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার কৃষ্ণনগরে পৌঁছেন মাগুরার তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম এবং পাবনার প্রশাসক নুরুল কাদের।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের খবর তাদের কাছেও পৌঁছেছিল, বলছেন ওয়ালিউল ইসলাম।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন,”তখন মেজর ওসমান চুয়াডাঙ্গা থেকে তার হেডকোয়ার্টার মেহেরপুরে নিয়ে গেছেন। চুয়াডাঙ্গায় কিছু বোমাবর্ষণ হওয়ায় তারা জায়গা বদল করেছেন। ওখানে দুই দিন থাকার পরে আমরা যখন ভারতে প্রবেশ করি, তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে।”
”সেখান থেকে আমরা কৃষ্ণনগরে গেলাম – এটা ১৬ তারিখের কথা। নুরুল কাদের আমাকে বললেন, তুমি কাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে চলে এসো, কিছু কাজ আছে।”
‘আমি সাড়ে ৮টা-পৌনে ৯টার দিকে গেলে তিনি বললেন, নদীয়ার ডিএম (ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট) খুঁজছে, তুমি একটু কথা বলো। আমি ফোন করলে তিনি বললেন, দেখুন আমাদের কাছে খবর আছে, আমাদের কাছাকাছি বাংলাদেশের ভেতরে আপনাদের সরকার শপথ নেবে। তো, আপনারা যারা এখানে আছেন, তাদের পাঠিয়ে দেয়ার জন্য আমি অনুরোধ পেয়েছি,” বলছেন মি. ইসলাম।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে সকালে।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী জানান, স্থান নির্বাচনের পর তাদের অনুষ্ঠান আয়োজনের যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হলো। ( রিপোর্টটি ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে প্রকাশ হয়েছিল)।