ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে অবৈধভাবে ৪৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পি কে হালদার ও তার সহযোগী ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ৫টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন, দুদক।
বৃহস্পতিবার দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলাটি দায়ের করা হয়েছে বলে সংস্থাটি জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, অবৈধভাবে ৪৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পি কে হালদারসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ৫ মামলা করেছেন দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান।
পি কে হালদার ছাড়াও এই মামলাগুলোতে আসামি করা হয়েছে তার অন্যতম সহযোগী ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের চেয়ারম্যান এম এ হাশেম, এমডি মো. রাশেদুল হক, ভারপ্রাপ্ত এমডি মো. আবেদ হোসেন এবং প্রতিষ্ঠানটির অন্যান্য বোর্ড সদস্যদের।
এই মামলার অন্য আসামিরা হলেন, দৃনান এ্যাপারেলসের চেয়ারম্যান কাজী মমরেজ মাহমুদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবু রাজীব মারুফ, ইমেক্সোর প্রোপাইটর ইমাম হোসেন, লিপরো ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উত্তম কুমার মিস্ত্রি, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের দুই পরিচালক সুকুমার সাহা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা সাহা, আর্থস্কোপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান প্রশান্ত দেউরী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরা দেউরী, ওকায়ামা লিমিটেডের চেয়ারম্যান সুব্রত দাস, আরবি এন্টারপ্রাইজের মালিক রতন কুমার বিশ্বাস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের পরিচালক পাপিয়া ব্যানার্জী ও তার স্বামী পরিচালক বাসুদেব ব্যানার্জী।
ওই ৩৭ জন আসামির তালিকায় আরও যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের পরিচালক এম নুরুল আলম, পরিচালক মো. নওশের-উল ইসলাম, পরিচালক নাসিম আনোয়ার, পরিচালক মো. নুরুজ্জামান, পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হাসেম ও পরিচালক জহিরুল আলম।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা অসৎ উদ্দেশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই ছাড়াই কোনো মর্টগেজ না নিয়ে দশটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মালিককে ঋণ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেন। এই প্রক্রিয়ায় বেনিফিশিয়ারিরা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ৪৩৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা ভুয়া ঋণের নামে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, বিপুল পরিমাণ এই অর্থ পরবর্তিতে বিভিন্ন লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে ভুয়া কোম্পানি ও বিভিন্ন ব্যক্তির হিসাবে স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে পাচার করে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ করেছেন।
গত বছরের ৮ জানুয়ারি প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করে দুদক। মামলার এজাহারে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা পাচারেরও অভিযোগ আনা হয়।
অন্যদিকে চলতি বছরের গত ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি পাঁচটি ভুয়া ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকার ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে পিকে হালদারসহ ৩৩ জনকে আসামি করে পাঁচটি মামলা করে দুদক।
পি কে হালদার ছাড়াও এসব মামলায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ হাশেম, সাবেক এমডি মো. রাশেদুল হক, নয় জন বোর্ড সদস্য, পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীসহ ৩৩ জনকে আসামি করা হয়।
দুদক সূত্রে জানা যায়, পিকে হালদারের আরও ৩৩ জন সহযোগীর সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ জারির অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। শিগগির এদের বিরুদ্ধে এই নোটিশ জারি করা হবে।
আর গত ১৬ মার্চ পি কে হালদারের বান্ধবী ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট নাহিদা রুনাই, একই প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত এমডি সৈয়দ আবেদ হাসান ও সিনিয়র ম্যানেজার রাফসান রিয়াদ চৌধুরীকে মতিঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে দুদক।
অন্যদিকে পিকে হালদারের সহযোগী ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমসহ ৪৫ জনের ইমিগ্রেশন বন্ধ চেয়ে ইমিগ্রেশন অথরিটির কাছে পত্র দেয় সংস্থাটি।
গত ৯ মার্চ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পিকে হালদার ও তার ৩৭ সহযোগীর বিরুদ্ধে দশটি মামলার অনুমোদন করে দুদক।
একইসঙ্গে পিকে হালদারের সহযোগী অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমসহ ৪৫ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ইমিগ্রেশনে চিঠি দেয়।
এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের মামলায় পি কে হালদারের তদন্তের অংশ হিসেবে তার ৭ হাজার ৮০ শতাংশ জমিসহ একটি ১০তলা ভবন জব্দে আদালত থেকে আদেশ পায় দুদক।
দুদকের এক আবেদনে ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এ আদেশ দেন।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে অন্তত চারটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।
এ চার কোম্পানি হল- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)।
এসব কোম্পানি থেকে তিনি ঋণের নামে বিপুল অঙ্কের টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।
এর মধ্যে আইএলএফএসএল গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে গত বছরের শুরুতে পি কে হালদারের বিদেশ পালানোর পর দুদক তার ২৭৫ কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদের’ খবর দিয়ে মামলা করে। এ মামলায় এরই মধ্যে পি কে হালদারের বেশ কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে দুদক।