প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাইবার ক্রাইম, মানি লন্ডারিং, মানবপাচার, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকের মত মারাত্মক সামাজিক অপরাধ দমনে পুলিশ সদস্যদের আরো আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।
অপরাধের ধরন বদলাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন আধুনিক প্রযুক্তির যুগ এবং সাইবার ক্রাইম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এটাকে আমাদের দমন করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গতানুগতিক অপরাধের পাশাপাশি সাইবার ক্রাইম, মানি লন্ডারিং, মানবপাচার ইত্যাদি বৈশ্বিক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকের মতো মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা-নির্যাতনসহ নিত্য নতুন সামাজিক অপরাধ। এসব অপরাধকে আরো দক্ষতার সঙ্গে দমন করতে হবে। বাসস।
প্রধানমন্ত্রী রোববার সকালে রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে ৩৭তম ব্যাচের শিক্ষানবিশ সহকারি পুলিশ সুপারদের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন। তিনি গণভবন থেকে ভিডিও লিংকের সাহায্যে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, কেবল দেশে নয়, বিদেশে পাঠিয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এটা অব্যাহত রাখা দরকার। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিলে তারা যতক্ষণ কাজে থাকবেন তাতে তাদের কর্মদক্ষতা আরো বৃদ্ধি পাবে। সে ব্যবস্থাও করতে হবে।’
ফেসবুক, অ্যাপস বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে গুজব ছড়নো বা মিথা তথ্য প্রদানসহ কিশোর ও উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা নানা অপরাধে যুক্ত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেখান থেকে তাদের বের করে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণভাবে গুজব রটানো বা এ ধরনের কাজ যেন করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।’
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে নিরলসভাবে কাজ করার জন্যও শেখ হাসিনা আহ্বান জানান।
এসব কাজে পুলিশের শক্তিশালী ও সাহসী ভূমিকার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী কর্তব্য পালনকালে মৃত্যুবরণকারী পুলিশ সদস্যদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি ও সমবেদনা জানান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, মানুষের সেবা দেয়া, তাদের জীবন মান উন্নত করা-এটাই হচ্ছে আমাদের সব থেকে বেশি প্রয়োজন।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। পুলিশের আইজি ড. বেনজির আহমেদ স্বাগত বক্তব্য রাখেন ।
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল খন্দকার গোলাম ফারুক, স্থানীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ এবং ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান অনুষ্ঠানে প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ শিক্ষানবিশ সহকারি পুলিশ সুপারদের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে পুরস্কার বিতরণ করেন।
সকল বিষয়ে কৃত্বিপূর্ণ অবদানের জন্য সহকারি পুলিশ সুপার স্নেহাশিষ কুমার দাস ‘বেস্ট প্রবেশনার’ পুরস্কার লাভ করেন।
অনুষ্ঠানে শিক্ষানবিশ সহকারি পুলিশ সুপারদের শপথ বাক্য পাঠ করানো হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানানো হয় এবং তিনি মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ প্রত্যক্ষ করেন।
প্রধানমন্ত্রী নবীন পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বাংলাদেশকে সকলে মিলে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশ যদি উন্নত হয়, তবে, গ্রাম, গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা আপনাদের আত্বীয়-স্বজন এবং পরিবারের সদস্যরাই উপকৃত হবে। তাদের জীবন সুন্দর হবে, তারাই নিরাপদে বাঁচতে পারবেন বা ভবিষ্যত বংশধরদের জীবনটা সুন্দর হবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত অসাম্প্রদায়িক উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সরকারেরও সেটাই দায়িত্ব, বলেন তিনি।
নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনী সব সময় সরকারের পাশে রয়েছে, উল্লেখ করে সরকার প্রধান নবীন কর্মকর্তাদের ‘আগামীর কর্ণধার’ আখ্যায়িত করে দায়িত্ব পালনে আরো আন্তরিক হবার পরামর্শ দেন।
শেখ হাসিনা এ সময় ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পুলিশ সপ্তাহে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে জাতির পিতা প্রদত্ত ভাষণের উল্লেখযোগ্য অংশ উদ্ধৃত করেন।
জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘একটা কথা ভুললে চলবে না তোমাদের। তোমরা স্বাধীন দেশের পুলিশ, তোমরা ইংরেজের পুলিশ নও, তোমরা পাকিস্তানি শোষকদের পুলিশ নও, তোমরা জনগণের পুলিশ। তোমাদের কর্তব্য জনগণকে সেবা করা, জনগণকে ভালোবাসা, দুর্দিনে জনগণকে সাহায্য করা।’
জাতির পিতার এই বক্তব্যকে প্রতিটি নবীন পুলিশ সদস্যকে চলার পথের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করে সেভাবেই দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। একইসঙ্গে জাতির পিতার ‘আপনাদের মানুষ যেন ভয় না করে। আপনাদের যেন মানুষ ভালোবাসে। অনেক দেশে পুলিশকে মানুষ শ্রদ্ধা করে। আপনারা শ্রদ্ধা অর্জন করতে শিখুন’ উদ্ধৃতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী পুলিশ সদস্যদের জনগণের আস্থা ও ভালবাসা অর্জনে ব্রতী হওয়ারও আহ্বান জানান।
পুলিশের বাজেট ২০০৯ সালের ৩ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১৬ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, উল্লেখ করে সরকার প্রধান অপরাধ দমনে পুলিশের নতুন ইউনিট প্রতিষ্ঠাতেও তাঁর সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরেন।
পিবিআই, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ পুলিশ, স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, নারী আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, এয়ারপোর্ট আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও কক্সবাজার এলাকার নিরাপত্তার জন্য দু’টি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন গঠন করার তথ্যও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে পুলিশ এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) এবং কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) গঠন করা হয়েছে।
এছাড়া, অপরাধী শনাক্তকরণ এবং তদন্তে প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার পুলিশ সেন্টার, ডিএনএ ল্যাব, অটোমেটেড ফিঙ্গার প্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম এবং আধুনিক রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপন করা হয়েছে, বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ পুলিশে সংযোজিত হতে যাচ্ছে সর্বাধুনিক অপারেশনাল গিয়ার ‘ট্যাকটিক্যাল বেল্ট’ যাতে অপারেশনাল ডিউটিতে অফিসার এবং ফোর্সগণ হ্যান্ডফ্রি রেখে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
পুলিশের জন্য কমিউনিটি ব্যাংক, আটটি বিভাগীয় শহরে বাংলাদেশ পুলিশ পরিচালিত আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ এবং বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিকে ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ হিসেবে গড়ে তুলতে তাঁর সরকারের পদক্ষেপ সমূহও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
করোনার কারণে ‘মুজিববর্ষে পুলিশের জন্য গৃহীত ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর না হওয়ায় সেখানকার বাজেট গৃহহীনদের জন্য তাঁর সরকারের গৃহ নির্মাণ কর্মসূচিতে ব্যয়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করায় প্রধানমন্ত্রী সকল পুলিশ সদস্যকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
‘মুজিববর্ষে দেশের একটি মানুষও আর গৃহহীন থাকবে না’ এবং ‘দেশের সকল ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের মাধ্যমে সমগ্র দেশকে আলোকিত করায় তাঁর সরকারের অঙ্গীকারের কথাও এ সময় পুণর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনার কারণে বিশ^ব্যাপী একটি স্থবির অবস্থার সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশ পুলিশ অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেছে।’
মৃতের সৎকার বা রোগাক্রান্তকে চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া বা ঘরে ঘরে রিলিফ পৌঁছে দেয়ায় পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী কর্তব্য পালনকালে মৃত্যু বরণকারী পুলিশ সদস্যদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।
তিনি আরো বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে আত্বীয়-স্বজন লাশ ফেলে চলে গেছে কিন্তু আমার পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সেখানে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।’
সে কারণে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের চিকিৎসার জন্য রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের পাশাপাশি তিনি একটি হাসপাতাল ভাড়া করে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পুলিশে পৃথক একটি মেডিকেল ইউনিট গঠন করাটা একান্তভাবে দরকার বলে আমি মনে করি। তাদের নিজস্ব একটি মেডিকেল ইউনিট থাকুক যারা এই চিকিৎসা সেবা দেখবে।’
তাছাড়া, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ ও জেলাগুলোতে পুলিশ হাসপাতালগুলোর উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত পুলিশের সেবা বিস্তৃত করার প্রয়াস হিসেবে ‘বিট পুলিশিং’ চালু করেন। যার মাধ্যমে আজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনগণের দোরগোড়ায় পুলিশি সেবা পৌঁছে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’র মাধ্যমে কেউ ফোন করলে তাৎক্ষণিক ভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে পুলিশ এবং তাদের সেবা প্রদান করছে।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা গত ১৯ ডিসেম্বর হিমছড়ির পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলা চার শিক্ষার্থীর ’৯৯৯’ এ ফোন করে পুলিশের চাহিদার প্রেক্ষিতে বিমান বাহিনীর সহযোগিতায় পরিচালিত ‘সার্চ এন্ড রেসকিউ’ অপারেশনের মাধ্যমে হেলিকপ্টারের সাহায্যে উদ্ধার পাবার ঘটনাটির পুনরুল্লেখ করেন এবং সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য তাঁর আহ্বান পুণর্ব্যক্ত করেন।