দীর্ঘ ৩০ বছর পর ইসলামিক রাষ্ট্রের পরিচয় মুছতে চলেছে সুদান। উত্তর আফ্রিকার এই দেশটির শতকরক ৯৭ ভাগ মানুষই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ১৯৮৯ সাল থেকে সুদানে ইসলামিক আইনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু হয়। কিন্তু সুদান সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সশস্ত্র আন্দোলন করে চলছিল “পিপলস লিবারেশন মুভমেন্ট” নামে এক বিপ্লবী সংগঠন। তারা বরাবর চেয়েছিল সুদানকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে। খবর রয়টার্স /এপি।
অবশেষে সুদানের প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লা হামদক ও পিপলস লিবারেশন মুভমেন্ট এর নেতা আবদেল আজিজ আল হিলু এক শান্তি চুক্তি করলেন। এই শান্ত চুক্তিটি ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবাতে সংগঠিত হয়। সেখানে বিবাদমান দুইপক্ষই দেশের সংবিধানকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে সম্মত হয়েছেন।
৪ সেপ্টেম্বর চুক্তি সাক্ষরের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন সুদানের প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লা হ্যামদক এবং পিওপল’স লিবারেশনের নেতা আজিজ আল-হিলু। দুজনেই একবাক্যে স্বীকার করে নেন সমস্ত মানুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত, কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব সব সময় মুক্তচিন্তার পক্ষে থাকা। আর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সুদানের ভাবমূর্তি উন্নত হবে বলে মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী। সেইসঙ্গে দীর্ঘ সশস্ত্র লড়াইয়ের অবসান নিঃসন্দেহে খুশির খবর।
শান্তি চুক্তিতে বলা হয়েছে- “ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে পৃথক করে এক ধর্মনিরপেক্ষ সুদান গড়ে তোলাই প্রধান লক্ষ্য। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার সুনিশ্চিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর।”
যদিও এই শান্তিচুক্তি এতোটা সহজ হয়নি। কারণ- পিপলস্ লিবারেশন মুভমেন্টের বেশ কিছু শাখা সুদানকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে মান্যতা দিতে চায়নি।
এক নজরে সুদান:
১৮২০ সালে মিসরের ওসমানীয় শাসক মুহাম্মদ আলি পাশা সুদান দখল করেন। নামেমাত্র ওসমানীয়দের অধীনে থাকলেও পাশা মূলত নিজেকে মিসরের স্বাধীন শাসক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। পাশা তার ছেলে ইসমাইলকে সুদান শাসনের দায়িত্ব দেন। ইসমাইল ও তার পরবর্তী শাসকরা সুদানে বহু অবকাঠামো গড়ে তোলেন।
১৮৭৯ সালে ইসমাইল পদত্যাগে বাধ্য হন এবং ইসমাইলের ছেলে প্রথম তৌফিক বাবার স্থলাভিষিক্ত হন। তবে তৌফিকের দুর্নীতির কারণে সেখানে অল্প দিনের মধ্যেই একটি বিপ্লব হয়। তৌফিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ব্রিটিশদের সাহায্য কামনা করেন। এ সুযোগে ব্রিটিশরা ১৮৮২ সালে মিসর দখল করে নেয়। স্বাভাবিকভাবে সুদানও ব্রিটিশদের দখলে চলে আসে। তখন শুরু হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। এতে নেতৃত্ব দেন মুহাম্মদ আহমদ ইবনে আবদ আল্লাহ। ১৮৮৫ সালে সুদানে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল গর্ডনের পতন হয়। সুদান থেকে প্রত্যাহার করা হয় মিসরীয় ও ব্রিটিশ সৈন্য।
ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই মিসরীয়রা দাবি করতে থাকে, মিসর ও সুদান এক রাষ্ট্র হবে। কিন্তু মিসরীয়রা শেষ পর্যন্ত উপলব্ধি করে, সুদানের ওপর মিসরীয় সার্বভৌমত্ব দাবি বাতিল না করলে ব্রিটিশরা স্বাধীনতাকে বিলম্বিত করবে। এ উপলব্ধির পর ১৯৫৪ সালে মিসরীয়রা ব্রিটিশদের সাথে একটি চুক্তি করে। ওই চুক্তি অনুসারে ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি সুদান স্বাধীনতা লাভ করে। ইসমাইল আল আজহারি সুদানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক সুদানের প্রথম সরকারের নেতৃত্ব দেন।
তবে স্বাধীনতার এক বছর আগে ১৯৫৫ সালে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলের আশঙ্কা, স্বাধীন সুদানে নেতৃত্ব দেবে উত্তরের মুসলমান জনগোষ্ঠী। কারণ উত্তরাঞ্চলের মুসলমানদের সাথে মিসরসহ আরব বিশ্বের সুসম্পর্ক রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে দুই অঞ্চলে দুই ধরনের প্রশাসন চালুর দাবি জানায় ব্রিটিশরা।
১৯৫৫ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলে। গৃহযুদ্ধ চলতে থাকলে স্বাধীনতার পরপরই একজন সামরিক কর্মকর্তা দেশটির ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৭২ সালে এক চুক্তিতে দেশটিতে গৃহযুদ্ধের অবসান হলেও ১৯৮৩ সালেই আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয় দেশটিতে।
১৯৮৯ সালের ৩০ জুন কর্নেল ওমর আল বশির একদল সামরিক কর্মকর্তার সমর্থন নিয়ে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থান ঘটান। তিনি দেশটিতে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন এবং ইসলামি আইন চালু করেন।
ক্ষমতা দখলের পরপরই তিনি গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি নিজেকে সুদানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। সে বছর দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও হয়। একমাত্র প্রার্থী ছিলেন তিনি নিজেই। এর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সুদানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে।
প্রেসিডেন্ট বশির শান্তিপ্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে নানা পদক্ষেপ নেন। তিনি ২০০৫ সালের ৯ জানুয়ারি একটি চুক্তি করেন। চুক্তি অনুসারে চুক্তির পর থেকেই দক্ষিণাঞ্চল স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে এবং স্বাধীনতার জন্য ছয় বছর পর গণভোট হবে। কিন্তু চুক্তির পর দক্ষিণের এক নেতা বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলে দেশটিতে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ২০০৫ সালের ২৪ মার্চ দেশটিতে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়। তবে এ বাহিনী মোতায়েনের বিরোধিতা করেন প্রেসিডেন্ট বশির।
অবস্থানগত দিক থেকে দেশটির অবস্থান উত্তর আফ্রিকায়। লৌহিত সাগরের সাথে দেশটির ৮৫৩ কিলোমিটার উপকূল রয়েছে। আয়তনে আফ্রিকা মহাদেশে সবচেয়ে বড় ও বিশ্বে দশম সুদান। এর আয়তন ২৫ লাখ ৫ হাজার ৮১০ বর্গকিলোমিটার। সুদনের উত্তরে মিসর, পূর্বে ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে কেনিয়া ও উগান্ডা, দক্ষিণ-পশ্চিমে কঙ্গো ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, পশ্চিমে শাদ ও উত্তর-পশ্চিমে লিবিয়া। এর বেশির ভাগ ভূমি সমতল। তবে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে পর্বতমালা। পৃথিবীর দীর্ঘতম নদ নীলের একটি অংশ সুদানের রাজধানী খার্তুমের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে।
সুদানের দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেশি হয়। উত্তরে নুবিয়ান অঞ্চলে সামান্য মরুভূমি রয়েছে। তবে দেশটিতে মরুকরণ অব্যাহত রয়েছে।
দেশটির ৭০ শতাংশ জনগণই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। আদিবাসী ২৫ শতাংশ ও মাত্র ৫ শতাংশ খ্রিষ্টান। এখানকার খ্রিষ্টানরা রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনুসারী। সব মুসলমানই সুন্নি।