তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল আদালতের মাধ্যমে দেশের বিচারাঙ্গনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় দুমাস ধরে দেশের সবকিছু বন্ধ। আদালত বন্ধ থাকায় বিচারপ্রার্থীরা চরম বিপাকে পড়েছেন। এমনিতেই মামলাজটের কারণে আদালতে অচলাবস্থা, তার ওপর দিনের পর দিন বন্ধ থাকায় দুর্ভোগের মাত্রা যে আরো বাড়বে তা নিশ্চিতই বলা যায়। এ থেকে পরিত্রানের পথ খুঁজতে গিয়ে আপাতত মিলেছে ভার্চুয়াল কোর্টের দাওয়াই। সিদ্ধান্ত হয় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আপতকালিন সময়ে বিচারকাজ চালানোর। সরকারি এ সিদ্ধান্তের পর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করে ভার্চুয়াল কোর্টের অনুমোদন দেয়া হয়। এর ফলে আইনজীবী ও আসামী বা বিচারপ্রার্থীকে সশরীরে আদালতে হাজির না হয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে শুনানি করবেন। এজন্য হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে পৃথক বেঞ্চ গঠন করা হয়ছে। জজ আদালত ও সিএমএম এবং সিজিএম আদালতেও দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছে। আইনজীবীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘরে বসেই মামলা পরিচালনা করবেন।
মঙ্গলবার প্রথম দিনেই হাইকোর্টে এক রিটে চট্টগ্রামের হালদা নদীর ডলফিন হত্যা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালককে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ই-মেইলের মাধ্যমে হাইকোর্টকে জানাতে বলা হয়েছে।
হালদা নদীতে ডলফিন হত্যা বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে করা একটি রিট আবেদনের ওপর শুনানি শেষে এ আদেশ দেয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চ।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, প্রযুক্তির মাধ্যমে আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর প্রথম আদেশ আসলো উচ্চ আদালত থেকে।
এ দিকে ঢাকার সিএমএম কোর্টে চারটি ভার্চুয়াল আদালতে প্রথম দিনে ১৮ মামলায় ৩৪ জনকে জামিন দেয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা আদালতেও ভার্চুয়াল কোর্টে মামলার শুনানি হয়েছে। যার মাধ্যমে দেশের বিচারবিভাগে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো।
সোমবার হাইকোর্টে ভার্চুয়াল আদালতে প্রথম রিট আবেদনটি করেন ব্যারিস্টার আবদুল কাইয়ুম লিটন।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার ও সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস।
এদিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের চারটি ভার্চুয়াল কোর্টে ১৮ মামলায় ৩৪ জনকে জামিন দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার এ চার আদালতে মোট ২৫টি জামিন আবেদন জমা পড়ে। চারটি কোর্টে ধারাবাহিকভাবে এসব আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ১৮টির আবেদন মঞ্জুর হয় বলে আদালত সূত্রে জানা যায়।
এর আগে সোমবার হাজতি আসামিদের জামিন শুনানির জন্য ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চারটি ভার্চ্যুয়াল কোর্ট গঠন করা হয়। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) এএম জুলফিকার হায়াত স্বাক্ষরিত এক নোটিশে এ আদালত গঠনের কথা জানানো হয়।
নোটিশে বলা হয়, ‘আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০’ এর ক্ষমতাবলে সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক জারি করা ‘বিশেষ প্র্যাকটিস নির্দেশনা’ অনুসারে এ কোর্ট গঠন করা হয়। সাপ্তাহিক ছুটি ও অন্য সরকারি ছুটি ব্যতীত অন্য সময়ে এসব আদালতে ই-মেইল ও ই-ফাইলিংয়ের মাধ্যমে জামিন আবেদন করা যাবে।
ঢাকার সিএমএম আদালতে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট ১ এর দায়িত্বে রয়েছেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারাফুজ্জামান আনছারী, কোর্ট ২ এর দায়িত্বে সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরী, কোর্ট ৩ এর দায়িত্বে দেবদাস চন্দ্র অধিকারী ও কোর্ট ৪ এর দায়িত্বে রয়েছেন রাজেশ চৌধুরী।
মঙ্গলবার এমন তথ্য জানিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান।
গত ১০ মে নিম্ন আদালতের ভার্চ্যুয়াল কোর্টে শুধু জামিন শুনানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। এ বিষয়ে ওইদিন একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলা এবং এর ব্যাপক বিস্তার রোধকল্পে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আগামী ১৬ মে পর্যন্ত সব আদালতে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ছুটির সময়ে বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলার জেলা ও দায়রা জজ, মহানগর এলাকার মহানগর দায়রা জজ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, বিশেষ জজ আদালতের বিচারক, সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক, জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারকক এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিজে অথবা তার নিয়ন্ত্রণাধীন এক বা একাধিক ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০ এবং উচ্চ আদালতের জারিকৃত বিশেষ প্র্যাকটিস নির্দেশনা’ অনুসরণ করে শুধু জামিন সংক্রান্ত বিষয়গুলো তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার উদ্দেশ্যে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।
এরপর সোমবার থেকে জামিন শুনানি শুরু হয়। প্রথমবারের মতো কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ এক আসামিকে জামিন দেন।
মঙ্গলবার সুপ্রিমকোর্ট জানায়, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ৪টি মামলার শুনানি নিয়ে ৪ জনের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেছেন। পাশাপাশি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত ১৯ মামলার শুনানি নিয়ে ৩৪ জনকে জামিন দিয়েছেন।
নোয়াখালীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (সিজেএম) মোট আবেদন ২০ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ১০টির শুনানিতে ৪ জনের জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে।
কুমিল্লার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৭টি মামলার মধ্যে ২টির শুনানি হয়েছে। একটিতে একজনের মঞ্জুর করে অপরটি খারিজ করা হয়েছে।
ফেনীর সিজেএম আদালতে ২২টি আবেদনের মধ্যে ৩টির শুনানি শেষে ৬ জনকে জামিন দেওয়া হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিজেএম আদালতে মোট আবেদন জমা পড়েছে ২০০টি। এর মধ্যে ২টি মামলার শুনানি শেষে ২ জন জামিন পেয়েছেন।
দিনাজপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালত ৮টি মামলায় শুনানি নিয়ে ৬টি মঞ্জুর করে ৬ জনকে জামিন দিয়েছেন। অপর ২টি আবেদন খারিজ করা হয়।
দিনাজপুর সিজেএম আদালতে মোট আবেদন পড়েছে ৮০টি। এরমধ্যে ২৬টির শুনানি শেষে ২০টিতে ২৪ জনকে জামিন দিয়েছেন আদালত। খারিজ করা হয় ৬টি আবেদন।
ঠাকুরগাঁও সিজেএম আদালতে একটি আবেদন মঞ্জুর করে একজনকে জামিন দেওয়া হয়েছে। খারিজ করা হয়েছে তিনটি আবেদন।
সিলেট জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৫টির শুনানি নিয়ে তিনটি আবেদন খারিজ করা হয়েছে। অপর দুই মামলায় ২ জনকে জামিন দেন আদালত।
সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালত ৮ আবেদনের মধ্যে ২টি মঞ্জুর করে ৮ জনকে জামিন দিয়েছেন।
সিলেট সিজেএম আদালতে ৯টির শুনানি নিয়ে ৮টিতে ১৫ জনকে জামিন দেওয়া হয়।
সিলেট সিএমম আদালতে ১৩টি আবেদনের শুনানি নিয়ে ৭টিতে ৭ জনের জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে। খারিজ করা হয়েছে ৬টি আবেদন।
সিলেট শিশু আদালতে একটি আবেদনের শুনানি নিয়ে এক শিশুকে জামিন দেওয়া হয়েছে।
সুনামগঞ্জ সিজেএম আদালতে ৮টি আবেদনের শুনানি নিয়ে ৫টি মঞ্জুর করে ৫ জনকে জামিন দেওয়া হয়েছে। বাকি তিনটি আবেদন খারিজ করা হয়েছে।
নেত্রকোনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত ৪টি আবেদনের শুনানি নিয়ে ৪ জনকে জামিন দিয়েছেন।
নেত্রকোনা সিজেএম আদালতে তিনটি আবেদনের শুনানি নিয়ে ৪ জনকে জামিন দেওয়া হয়েছে।
মাগুরা সিজেএম আদালত ১৫টি আবেদনের মধ্যে ১৩টি মঞ্জুর করে ১৮ জনকে জামিন দিয়েছেন। বাকি দু’টি খারিজ করা হয়েছে।
আরো একটি বেঞ্চ গঠনঃ
সুপ্রিম কোর্টে ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে শুনানির জন্য আরও একটি বেঞ্চ গঠন করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিচারপতি জেবিএম হাসান-এর বেঞ্চে অতিব জরুরি সব ধরনের ফৌজদারি মোশন ও তৎসংক্রান্ত জামিনের আবেদনপত্র ই-মেইলে পাঠানো যাবে।
এর আগে গত ১০ মে আপিল বিভাগে চেম্বার আদালত ও হাইকোর্ট বিভাগে তিনটি বেঞ্চ গঠন করেছিলেন প্রধান বিচারপতি।
আপিল বিভাগের বিচারকার্য পরিচালনার জন্য চেম্বার জজ হিসেবে বিচারপতি মো. নূরুজ্জামানকে প্রধান বিচারপতি মনোনয়ন দিয়েছেন।
বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান আগামী ১৪ ও ২০ মে সকাল সাড়ে ১১টা থেকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে শুধু ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে চেম্বার কোর্টে শুনানি গ্রহণ করবেন।