যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ৩০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। রায়ে যদি আমৃত্যু উল্লেখ না থাকে সে ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হিসেবে ৩০ বছর সাজা খাটতে হবে আসামিকে। গত বছরের ডিসেম্বরে দেয়া আপিল বিভাগের এই রায়টি বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
যাবজ্জীবন কারদণ্ড নিয়ে যে বিভ্রান্তি ও ধোঁয়াশার সৃস্টি হয়েছিলো আপিল বিভাগের এই রায়ের ফলে বিষয়টি স্পষ্ট হলো বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গত বছরের ১লা ডিসেম্বর এই রায় দিয়েছিলেন । ৭ সদস্যবিশিষ্ট বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের মতামতের ভিত্তিতে আপিল বিভাগেরই একটি রায়ের রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করে এ রায় ঘোষণা করেছিলেন। ওই রায়ের কপিতে বিচারকদের স্বাক্ষরের পর বৃহস্পতিবার ১২০ পৃষ্ঠার রায়ের অনুলিপি প্রকাশ করা হলো।
রায়ে বলা হয়েছে, প্রাথমিক অর্থে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মানে হলো, দণ্ডিত ব্যক্তি তার স্বাভাবিক জীবনের বাকি সময় কারাভোগ করবেন। দণ্ডবিধির ৪৫ এবং ৫৩ ধারার সঙ্গে দণ্ডবিধির ৫৫ ও ৫৭ ধারা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ (ক) মিলিয়ে দেখলে যাবজ্জীবন সাজা হয় ৩০ বছর।
এতে বলা হয়, কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল অথবা ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে গঠিত ট্রাইব্যুনাল যদি কোনো আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়, সেক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ (ক) ধারা অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সুবিধা (রেয়াত) পাবেন না।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে সাভারে জামান নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ২০০৩ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এক রায়ে আতাউর মৃধা ওরফে আতাউর ও আনোয়ার হোসেন নামে দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের শুনানি শেষে ২০০৭ সালের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্টের রায়ে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করলে ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তখনকার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা)নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগ দুই আসামির মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। পাশাপাশি যাবজ্জীবন মানে ‘আমৃত্যু কারাবাস’সহ সাতটি অভিমত দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর আপিল বিভাগের দেওয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামি আতাউর মৃধা রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন। রিভিউ আবেদনে আসামি পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি ছিল, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মূল লক্ষ্য দণ্ডিত ব্যক্তির সংশোধন ও সংস্কার। দণ্ডবিধিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড নামে কোনো দণ্ড নেই। প্রচলিত ফৌজদারি আইন ও কারাবিধি অনুযায়ী যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছর সাজা। আসামি রেয়াত পেলে ওই সাজা কমে হয় সাড়ে ২২ বছর। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অর্থ ‘আমৃত্যু কারাদণ্ড’ হলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ (এ) এবং জেলকোডের সংশ্লিষ্ট বিধান অকার্যকর হয়ে যায়।
পরে এ বিষয়ে মতামত জানতে সর্বোচ্চ আদালত পাঁচ জন অ্যামিকাস কিউরির (আদালতের বন্ধু) বক্তব্য শোনে। তারা হলেন অ্যাডভোকেট আব্দুর রেজাক খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, অ্যাডভোকেট মুনসুরুল হক চৌধুরী, এ এফ হাসান আরিফ ও অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন।