আদালতের ‘সময় নষ্ট করায়’ আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দকে হাইকোর্ট যে জরিমানা করেছে এই আদেশের বিরুদ্ধে তিনি আইনী লড়াই করবেন বলে জানিয়েছেন। মি. ইউনুছ বলেন,ভার্চুয়াল আদালতের ইন্টারনেটের জুম লাইনে তিনি ঢুকতে পারেন নি। এ ছাড়া তিনি যে লকডাউন নিয়ে রিট করেছিলেন তা ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় এই রিট এমনিতেই অকার্যকর হয়ে গেছে। ফলে তার অনুপস্থিতিতে যে জরিমানা করা হয়েছে তা সঠিক হয়নি এবং আদেশটি তিনি প্রত্যাহার ও পুনর্বিবেচনার আবেদন করবেন।
উল্লেখ্য মামলা করার পর শুনানি না করে এবং আদেশের সময় হাজির না থেকে আদালতের ‘সময় নষ্ট করায়’ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দকে বুধবার ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে হাই কোর্ট।
নির্ধারিত সময়ে তার অনুপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিচারক প্রশ্ন করেছেন, গণমাধ্যমকে দেখানোর জন্যই তিনি মামলা করেন কি না।
আদালত অবমাননার দায়ে এর আগেও সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ তিনমাসের জন্য তার আইনপেশার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো। আর এবার হাইকোর্ট তাকে জরিমানা করলো।
মহামারী সামাল দিতে সরকারের বিধিনিষেধ জারির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত ২৫ এপ্রিল হাই কোর্টে এই রিট করেছিলেন মি.ইউনুছ আলী। কিন্তু এরপর তিনি এই মামলার শুনানি করতে আদালতে আসেন নি। ফলে বুধবার ওই রিট আবেদন খারিজ করে দেন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের ভার্চুয়াল বেঞ্চ। সেই সঙ্গে আদালতের সময় নষ্ট করায় ‘খরচ বাবাদ’ আদালত ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
রিট মামলায় মি.ইউনুছ দাবি করেছিলেন,জরুরি অবস্থা জারি করা ছাড়া লকডাউন দেওয়ার সুযোগ নেই। চলমান লকডাউনের ওপর স্থগিতাদেশ এবং আর যাতে লকডাউন দেওয়া না হয়, সে জন্য নির্দেশনা চেয়েছিলেন তিনি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটিকে বিবাদী করা হয়েছিল তার ওই রিট আবেদনে।
সেখানে তিনি যুক্তি দেখান, “জরুরি অবস্থা জারি করা ছাড়া জনগণের চলাফেরার অধিকার, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার সরকার স্থগিত রাখতে পারে না। এটা সংবিধান পরিপন্থি। কিন্তু সরকার জরুরি অবস্থা জারি না করেই লকডাউন দিয়েছে, যা সংবিধানের ২৭, ২৮, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৫ ও ৩৬ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি।”
বিডি নিউজ জানিয়েছে, গত ২৭ এপ্রিল রিট আবেদনটি উপস্থাপন করলে শুনানির জন্য তা কার্যতালিকায় ওঠে। গত রোববার আদালত কার্যতালিকার ক্রমানুসারে ইউনুছ আলী আকন্দকে ডাকে। সেদিনও তিনি ছিলেন না। তখন আদালত মামলাটির শুনানি না করে মঙ্গলবার আদেশের জন্য রাখেন।
কিন্তু মঙ্গলবারও কার্যতালিকা ধরে ডেকে ইউনুছ আলী আকন্দকে পায়নি আদালত। বুধবার কার্যতালিকার প্রথমেই এ রিট মামলাটি ছিল।
এদিনও কার্যতালিকা ধরে কয়েকবার ডেকে রিটকারী আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দের সাড়া পাচ্ছিল না আদালত। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক এম ইনায়েতুর রহিম তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খানের কাছে পরামর্শ চান যে, শুনানি বা আদেশের সময় আদালতে আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় মামলা খারিজের সাথে খরচ বাবদ জরিমানা করা যায় কিনা।
জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার এবং আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, জনস্বার্থের মামলায় এ রকম হলে খরচ বাবদ জরিমানা করা যায়।
বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম তখন বলেন, “এই আবেদন (লকডাউন চ্যালেঞ্জ করা রিট) দিয়ে চার দিন পাঁচ দিন (তিনি) নাই। লকডাউন চ্যালেঞ্জ করে মাঝে মাঝে উঁকি দেন, আর মামলা ধরলে থাকেন না। প্রতিদিনই এ কাজ করেন। ঠিক আছে, ডিসমিস ফর ডিফল্ট কস্ট অব টাকা টেন থাউসেন্ড।”
তখন একজন আইনজীবী খরচ বাবাদ জরিমানার ১০ হাজার টাকা মাফ করে দেওয়ার আর্জি জানান।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম তখন বলেন, “কেন মাফ করবো? কোর্ট কাচারি নিয়ে ফাজলামো নাকি? লকডাউনের মধ্যে একটা মামলা করেছেন, উনাকে একদিনও পাওয়া যায় না। উনি মামলা করে মিডিয়ায় আগে বলে দেন যে মামলা ফাইল করা হয়েছে।
“পাঁচ দিন ছয় দিন ধরে মামলা লিস্টে, উনি আসেন না। কী ধরনের কথা! লিস্টে দিয়ে উনি পেপার পত্রিকায় নিউজ দেবেন!”
ভার্চুয়াল আদালতে উপস্থিত একজন আইনজীবী তখন বলেন, “তাকে (ইউনুছ আলী আকন্দকে) সিরিয়াসলি সতর্ক করা উচিৎ। আপিল বিভাগ থেকেও তাকে একবার সতর্ক করা হয়েছে।”
আদেশের পর যোগাযোগ করা হলে আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি তো লাইন টাইন পাই নাই জুমে। এখন মিডিয়ার মাধ্যমেই শুনলাম যে ১০ হাজার টাকা ফাইন ফর ডিফল্ট।
“এখন আমার কথা হইল, আমি যে মোশনটা ফাইল করেছিলাম, সেটা প্রথম এবং দ্বিতীয় লকডাউন চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু এই মামলার শুনানি হতে হতে আরও দুইবার লকডাউন বাড়ানো হয়েছে। সেগুলো আমি চ্যালেঞ্জ করি নাই। ফলে এই রিটটা এমনিতেই অকার্যকর হয়ে গেছে।”
আর শাস্তির বিষয়ে ইউনুছ বলেন, “মোশন মামলা ডিফল্ট ফর ডিসমিস (আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় খারিজ) হতে পারে। কিন্তু কস্ট (খরচ বাবদ জরিমানা) দেওয়ার কোনো বিধান নাই। এরকম কোনো নজির নাই।”
হাই কোর্ট রুলস অনুযায়ী এ আদেশটি প্রত্যাহার (রিকল) চেয়ে এই বেঞ্চেই আবেদন করবেন বলে জানান আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ।
আর যদি তাতে ব্যর্থ হন, তাহলে আদেশটি পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জনস্বার্থের মামলায় খরচ বাবদ জরিমানা করা যায় কিনা তা জানতে চেয়েছিলেন হাই কোর্ট। আমি বলেছি যে, কস্ট ইমপোজ করা যায়।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “লকডাউনের সময় কোর্ট সীমিত আকারে চলছে জরুরি সব মামলা শোনার জন্য। আমরা সবাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে থাকি। জনস্বার্থের নামে মামলা করে আদালতের সময় নষ্ট করার তো কোনো মানে হয় না।”
বিচার বিভাগ নিয়ে ফেইসবুকে কিছু মন্তব্যের কারণে গতবছর অক্টোবরে আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দকে গুরুতর আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সর্বসম্মত ওই রায়ে ইউনুছ আলীকে তিন মাস তাকে সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশা থেকে বিরত থাকার শাস্তি দেওয়া হয়।
দেশে বিভিন্ন ঘটনার পর রিট মামলা করে আলোচিত ইউনুস আলী আকন্দ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে ঢাকা-৮ আসন থেকে নির্বাচন করে হেরে যান। গতবছর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে আবেদন করে তিনি নতুন আলোচনার জন্ম দেন।