দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তদারকির দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাজে ক্ষোভ জানিয়েছে উচ্চ আদালত।
হাই কোর্ট বলেছে, “দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি-উন্নয়নের জন্য সরকার প্রধান যেখানে ক্লান্তিহীন কাজ করে যাচ্ছেন, সেখানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিশেষ করে ডিজিএম, জিএম, নির্বাহী পরিচালক ও ডেপুটি গভর্নররা ঠগবাজ, প্রতারক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিচ্ছে।”
ব্যক্তি স্বার্থের জন্য আর্থিক খাতের এই বিপর্যয়ের জন্য তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিৎ বলে মন্তব্য করেছে আদালত।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) পরিচালনা পর্ষদ অপসারণের নির্দেশনা চেয়ে একটি বিদেশি অংশীদারী প্রতিষ্ঠানের করা আবেদনে এই পর্যবেক্ষণসহ আদেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
এই আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ওমর ফারুখ। বিআইএফসির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী হাসান আজিম, মাহফুজুর রহমান মিলন ও মো.সাইফুল ইসলাম সাইফ।
বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের হাই কোর্ট বেঞ্চ গত ১৭ ডিসেম্বর এ আদেশ দেয়। সোমবার পূর্ণাঙ্গ আদেশের অনুলিপিতে এই পর্যবেক্ষণ দেখা যায়।
ওমর ফারুখ বলেন, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) ১০ শতাংশের বিদেশি অংশীদার ‘টিজ মার্ট ইনকরপোরেটেড’ গত বছর মার্চে আবেদনটি করেছিল।
বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে থাকা প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা বিআইএফসি থেকে কী পরিমাণ টাকা নিয়েছে, তা নির্ধারণের জন্য একটি স্বতন্ত্র নিরীক্ষক কোম্পানি নিয়োগের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল আবেদনে।
ব্যারিস্টার ওমর ফারুখ বলেন, “আদালত পর্যবেক্ষণসহ আদেশ দেয়। আদেশে বিআইএফসির নতুন চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ এবং নিরীক্ষক কোম্পানি নিয়োগ দিয়েছে।”
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীকে বিআইএফসির চেয়ারম্যান ও স্বাধীন-স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগের আদেশ দিয়েছে আদালত। তিনি পরিচালনা পর্ষদ এবং বার্ষিক সাধারণ সভায় সভাপতিত্ব করবেন।
পাশাপাশি আদালত আরও চারজনকে স্বাধীন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তারা হলেন, সাবেক সচিব শ্যামল কান্তি ঘোষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. জামিল শরিফ, আইসিএবির সাবেক সহ-সভাপতি মো. মাহামুদ হোসেন ও মো. শাহাদাত হুসাইন।
এছাড়ও এই আর্থিক সংস্থার নিরীক্ষা পরিচালনার জন্য নিরীক্ষক কোম্পানি নূরুল ফারুখ হাসান অ্যান্ড কো. চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এই নিরীক্ষক কোম্পানি বিআইএফসির সম্পদ, বিআইএফসির দায়, এর মূলধন, বিআইএফসিতে পৃষ্ঠপোষক অংশীদারদের বিনিয়োগের পরিমাণ এবং পৃষ্ঠপোষক অংশীদারদের বিনিয়োগের পদ্ধতিসহ বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখবে বলে জানান ওমর ফারুখ।
আদালত পর্যবেক্ষণে আরও বলেছে, ২০০২ সাল থেকে আজ অবধি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত কর্মকর্তাদের সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
আদালত মনে করে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উচিত এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধান চালানো।
পর্যবেক্ষণে আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেছে, “বাংলাদেশ ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ঠগবাজ ব্যবসায়ী, প্রতারকরা যাতে জনসাধারণের অর্থ আত্মসাত করতে না পারে, বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নর সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকবেন। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এদের গোপন আঁতাত, পরিকল্পনা ভেঙে দিতে হবে “
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
গত বছর এই প্রতিষ্ঠানটির বিদেশি পৃষ্ঠপোষক অংশীদার ‘টিজ মার্ট ইনকরপোরেটেড’ অর্থ আত্মসাত, অব্যবস্থাপনাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিল বিআইএফসি পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগে বিআইএফসি চেয়ারম্যানের অপসারণ, নতুন করে পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনের নির্দেশনা চেয়ে গত বছর হাই কোর্টে আবেদন করা হয়।
সেই সঙ্গে পি কে হালদার সংশ্লিষ্ট ‘সুকুজা ভেনচার লিমিটেড’ ও ‘কাঞ্চি ভেনচার লিমিটেড’ কীভাবে বিআইএফসির পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত হয়েছে, সেজন্য এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করার নির্দেশনাও চাওয়া হয়।
এছাড়া ২০১৫ থেকে গত পাঁচ বছর পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা বিআইএফসির কত টাকা আত্মসাত করেছে, তা খতিয়ে দেখতে স্বাধীন-স্বতন্ত্র নিরীক্ষক নিয়োগ এবং পি কে হালদারসহ তার আত্মীয়-স্বজন, সুকুজা ভেনচার লিমিটেড ও কাঞ্চি ভেনচার লিমিটেডের পরিচালক, বিআইএফসির সব পরিচালকসহ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ও তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ রাখার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল।
আদালত এ আবেদনের শুনানি নিয়ে গত বছর ১১ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী আদেশ দেয়। সে আদেশে বিআইএফসির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি, স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছিল আদালত।
সে আবেদনের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর পর্যবেক্ষণসহ আদেশ দিল উচ্চ আদালত।
আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী তারিখ রেখে এই সময়ের মধ্যে এ আদেশ প্রতিপালনের অগ্রগতি জানাতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের।