ঢাকা   বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১   বিকাল ৫:৫৯ 

সর্বশেষ সংবাদ

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে মাদকের পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না

বাংলাদেশে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি মাদকের চালান আটক করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। জব্দ করা মাদকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছে ইয়াবা।
বিভিন্ন সময়ে পাচারের সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথাও অনেক সময় উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত শুক্রবার রাতে কক্সবাজারে ২০ হাজার ইয়াবাসহ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর একজন এসআই ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করেছে মাদকদ্র্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এছাড়া চলতি বছরেই বিভিন্ন সময় কক্সবাজার, টেকনাফসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ইয়াবা জব্দ করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রকাশিত সবশেষ হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ মাসেই প্রায় ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৯পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে।
আর বাংলাদেশের ২০২২ সালের বার্ষিক ড্রাগ রিপোর্ট অনুযায়ী, সব সংস্থা মিলে গত ৫ বছরে প্রায় ২১ কোটি ৬৬ লাখেরও বেশি ইয়াবা জব্দ করেছে।
ইয়াবার চালান ঠেকাতে সরকারি নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও ঠেকানো যাচ্ছে না এই মাদকের বিস্তার। এখন ইয়াবার পাশাপাশি ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের মতো ভয়ঙ্কর মাদকও আসছে বাংলাদেশে।
বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক চক্র একসময় বাংলাদেশকে মাদকের করিডোর হিসেবে ব্যবহার করলেও এই ব্যবসায় বাণিজ্যিক লাভের যে সুযোগ আছে তাতে অভ্যন্তরীণ বাজারও তৈরি হয়েছে।
অন্যতম রুট টেকনাফ :
বাংলাদেশে ইয়াবা-আইসের মতো মাদক প্রবেশের অন্যতম রুট হলো কক্সবাজার ও মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষা টেকনাফ রুট।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক গবেষক ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এম ইমদাদুল হক বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন – আশির দশকে ভারত থেকে অবৈধভাবে আসা ফেনসিডিলের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছিল মাদকসেবীদের কাছে। এরপর কিছু সময় হেরোইনে আসক্ত হয় মাদকসেবীরা। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই জায়গাটা দখল করে নিয়েছে মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা।
বিবিসিকে তিনি বলেন-“ স্বাধীনতার আগে থেকে টেকনাফ অঞ্চল মাদক চোরাচালানের অন্যতম রুট। আশির দশকে হেরোইন চোরাচালানের রুট হিসেবে এটা বেশ ব্যবহার করতো চোরাকারবারিরা। আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশকে একটা করিডোর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে”।
“মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে এখন ইয়াবা পাচারের অন্যতম রুট টেকনাফের রুট”- বলেন অধ্যাপক ইমদাদুল হক।
২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশে যেভাবে মাদক কারবার বেড়েছে তাতে দেশের ভেতরে এর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন “মাদকসেবীদের প্রথম পছন্দই এখন ইয়াবা”।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে গত পাঁচ বছরে শুধুমাত্র কক্সবাজার জেলা থেকেই আট কোটির বেশি ইয়ারা উদ্ধার করা হয়েছে। আর গত দুই বছরে এই জেলা থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার আইস উদ্ধার করা হয়েছে।
এই টেকনাফ রুট দিয়ে এলএসডি এবং আইসের মতো মাদক আসছে। যেটা বেশ ‘অ্যালার্মিং’ বলে উল্লেখ করছেন মি. হক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থায় গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের কাছাকাছি হওয়ায় সহজেই এই পথ বেছে নিতে পারছেন মাদক ব্যবসায়ীরা। তারা রাতের আঁধারে বা ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন সময় এই রুট বেছে নিচ্ছেন।
টেকনাফের সীমান্ত ঘেঁষা মিয়ানমারে বেশ কিছু ইয়াবা কারখানা তৈরি হয়েছে, যেখান থেকে ইয়াবার চালানগুলো বাংলাদেশে এসে ঢুকছে।
“মিয়ানমার এবং বাংলাদেশি সংঘবদ্ধ মাদক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন উপায়ে ইয়াবার চালান মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে এবং এখান থেকে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো দেশে সেগুলো পাচার করা হচ্ছে। অনেক জায়গায় রাতের আঁধারে হয়তো তারা সীমান্ত অতিক্রম করছে, তখন হয়তো তাদের আটকানো যাচ্ছে না”- বলছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক সঞ্জয় কুমার চৌধুরী।
অন্যদিকে কক্সবাজারের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর অধিনায়ক মো: আমির জাফর মনে করেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থাকার কারণে এখন মাদক পাচারের পরিধিও বেড়েছে।
“মিয়ানমারের যেখান থেকে মূলত ইয়াবার চালান এসে ঢুকে রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল সেই একই জায়গায়। পথঘাট চেনা। সেটা তাদের আনার জন্য সহজ। যেহেতু সংখ্যায় প্রায় দশ লাখের বেশি মানুষ বাস করছে”।
যেসব চালেঞ্জ তারা মোকাবেলা করছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো ইয়াবা, আইসের মতো মাদক পাচার ঠেকানো।
‘কম পরিশ্রমে বেশি লাভ’
ইয়াবার মতো মাদক ব্যবসায় বাণিজ্যিক লাভের যে সুযোগ রয়েছে সেই কারণে এর নিয়ন্ত্রণ সহজে সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক ইমদাদুল হক বলছেন, “ইয়াবা, আইসের মতো মাদক পাচার ঠেকাতে না পারার অন্যতম কারণ হলো বড় ধরনের বাণিজ্যিক লাভের যে সুযোগ এই লোভটা সংবরণ করতে পারছে না ব্যবসায়ীরা। স্থানীয়ভাবে ব্যবসায়ী, চোরাকারবারী, বিনিয়োগকারীর সংখ্যা যে বাড়ছে এর কারণ আন্তর্জাতিক চক্রও এখানে কাজ করছে”।
তার মতে, আর্থিক লাভের কথা ভেবেই বেপরোয়াভবে এই ব্যবসার কাজটি পরিচালনা করে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চক্র।
অনেকটা একই ধরনের মত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক সঞ্জয় কুমার চৌধুরীর। তার ভাষ্য অনুযায়ী “যারা ইয়াবার ব্যবসা করেন তারা অতি কম পরিশ্রমে অনেক টাকা লাভ করতে পারেন। প্রতি পিস ইয়াবার দাম ২০০ টাকা যদি হয় তাহলে এর বাজারটা কত বড় সেটা নিশ্চয়ই আঁচ করা যায়। এজন্য মানুষ ঝুঁকি নিয়ে কাজটা করে”।
এছাড়া সীমান্ত এলাকায় যারা মাদকের পাচার রোধে কাজ করে তারাও লোভে পড়েই এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে যায় বলে মনে করেন মি. চৌধুরী।
তবে অধ্যাপক ইমদাদুল হকের মনে করেন, ২০১৮ সালের মে মাসে বাংলাদেশের সরকার যে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেছিল সেই সময়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততাও বেড়ে যায়।
“মাদকবিরোধী যে অভিযান চলেছিল ফিলিপিন্সের অনুকরণে- যাদের দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা হবে ভাবা হয়েছিল তাদেরই একটা অংশ বেনেফিশিয়ারিতেপরিণত হয়। অর্থাৎ এই ব্যবসায় যে লাভ সেই সুবিধাটা তারা গ্রহণ করে। ফলশ্রুতিতে ওসি প্রদীপের মতো মানুষের সম্পৃক্ততাও তখন বেড়ে গিয়েছে। বাহিনীর অনেককে ব্যবসার প্রমোটারে পরিণত হতে দেখেছি” বলেন মি. হক।
এছাড়া মাদক পাচারের অভিযোগে বড় কোনও শাস্তিও হতে দেখেনি ব্যবসায়ীরা এটাও পাচার না ঠেকাতে পারার অন্যতম একটি কারণ বলে মনে করেন ইমদাদুল হক।
তার মতে, আটককৃতরা বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নভাবে পার পেয়ে যাওয়ায় তারা উৎসাহী হয় এই ব্যবসা চালিয়ে যেতে।
“আন্তর্জাতিক চক্র তাদের নেটওয়ার্ক চেইন, বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে পরিবেশটা তৈরি করেছে, দেশে একটা চাহিদা তৈরি করেছে- এখন এই ব্যবসার সুযোগটা তারা নিচ্ছে”।
সার্বিকভাবে জনসচেতনতা তৈরির মাধ্যমে এই মাদক পাচার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করেন মি. হক।
অন্যদিকে সঞ্জয় কুমার চৌধুরীর মতে – মাদক পাচার ঠেকাতে প্রত্যেকটা বাহিনীকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে, আলাদাভাবে কাজ করলে মাদকের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।
‘সীমান্তে কীভাবে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে যুগপৎভাবে কাজ করতে হবে বাহিনীগুলোকে’ বলেন মি, চৌধুরী। বিবিসি বাংলা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত