ঢাকা   বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১   ভোর ৫:১২ 

সর্বশেষ সংবাদ

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে বাংলাদেশের প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল লাভবান হবে?

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর গত মাসে নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। শেখ হাসিনা বলেন, বন্দরটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহ বিশেষ করে আসাম ও ত্রিপুরার কাজে আসবে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অন্য দুটি রাজ্য মেঘালয় এবং মিজোরামও বন্দরটিতে প্রবেশাধিকার পেলে লাভবান হতে পারে।
রবিবার ভারতের প্রখ্যাত ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে রাহুল কর্মকার এমন মন্তব্য করে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর ব্যাখ্যা করেছেনঃ
১৯ ৪৭ এর দেশভাগ কীভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব ফেলেছিল?
স্বাধীনতার আগে ব্রহ্মপুত্র ও বরাক নদী প্রণালীর মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলোতে বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সহজ প্রবেশাধিকার ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সাথে সাথেই এই নদীগুলোর মাধ্যমে চা, কাঠ, কয়লা এবং তেল পরিবহন এবং স্থানীয়-স্তরের সীমান্ত বাণিজ্যে প্রভাব পড়ে নি, যা ১৯৫০ এর দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত (সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের রাজ্য) অবিভক্ত আসামের মর্যাদা বজায় রাখতে সহায়তা করেছিল। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের (বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান ছিল) মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনের সাথে সাথে বাণিজ্যের পরিমাণ কমতে শুরু করে, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে উত্তর-পূর্বাঞ্চল আলাদা হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে নদী ও স্থলপথে প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের সংকীর্ণ স্ট্রিপ ‘চিকেন নেক’ দিয়ে পণ্য পরিবহনের ফলে অঞ্চলটির খরচ অনেক বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর কোনো পরিবর্তন এসেছে?
১৯৭১ সালে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী নদী এবং স্থল বাণিজ্য ও যোগাযোগ রুটের পুনর্জন্ম হয় নি। দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস, প্রাথমিকভাবে ‘বাংলাদেশি’ ইস্যু এবং বাংলাদেশে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অগণিত চরমপন্থী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত ক্যাম্পের কারণে এগুলোতে কোনো উন্নতি হয় নি। এছাড়া, দেশ দুটি ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে নেয় নি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দৃশ্যপট পরিবর্তিত হতে শুরু করে। ২০১৫ সালে স্থল সীমান্ত বিরোধ-সমাধান চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর অবিশ্বাসের মাত্রাও কমে যায়
বিজ্ঞাপন
দুই দেশ নৌপথ, সড়কপথ এবং রেলপথ জুড়ে সক্ষমতা উন্নত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ঢাকা হয়ে আগরতলা এবং কলকাতার মধ্যে বাস সার্ভিস থেকে শুরু করে নদীতে কার্গো চলাচল, ট্রায়াল রান এবং ট্রান্স-শিপমেন্ট সফলভাবে পরিচালিত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের মানেটা কী?
গত পাঁচ বছরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির চাবিকাঠি হল উত্তর-পূর্বাঞ্চল। ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি যার দৃষ্টি এই অঞ্চলের উপর নিবদ্ধ এবং দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার এক নতুন মাত্রা উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে চারটি রাজ্যের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে সর্বোত্তমভাবে অন্বেষণ করতে সাহায্য করতে পারে। এই রাজ্যগুলোর (আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম) সাথে বাংলাদেশের ১,৮৭৯ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। রেলপথ এবং নৌপথের উপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে, দেশ ভাগের পূর্বের অনেক বাণিজ্য রুট পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। এই রাস্তাগুলোর অধিকাংশই চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে যায়, যা ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ। এই বন্দরের গুরুত্বের কারণে বৃটিশরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে রুট বানায়। যেমনঃ অরুণাচল প্রদেশ-আসাম সীমান্তের নিকটস্থ, অধুনা-লুপ্ত লেখাপানি স্টেশন।
বাস্তবে কি কিছু হয়েছে?
‘মাল্টি-মডাল এপ্রোচ’ এর মাধ্যমে ভারতের ‘মূল ভূখণ্ড’ এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে সংযোগের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরেই অনুভূত হচ্ছে। দেশভাগের পূর্বের বাণিজ্য রুটগুলো পুনরায় খোলার ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিবহন খরচ এবং সময় হ্রাস পাবে এবং বাংলাদেশও রাজস্ব পাবে এই ভাবনার পর গত পাঁচ বছরে বাস্তবে কাজ করা শুরু হয়েছে। ভারত সীমান্তের দুপাশে অবকাঠামোর কাজ করছে। ২০২১ সালের মার্চ মাসে, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ফেনী নদীর উপর নির্মিত একটি ‘মৈত্রী সেতু’ উদ্বোধন করেন৷ এতে দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম এবং চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব কমে মাত্র ১১১ কিলোমিটার হয়ে গেছে। সরকার সাব্রুমে একটি ‘মাল্টি-মডাল ট্রানজিট হাব’ নিয়ে কাজ করছে যেখানে সড়ক ও রেল সংযোগ থাকবে৷ যা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পৌঁছুতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে সংযোগকারী মেঘালয়ের ডাউকি, দক্ষিণ আসামের সুতারকান্দি এবং ত্রিপুরার আখাউড়ার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে দ্রুত প্রবেশের জন্য মিজোরাম খোয়াথল্যাংতুইপুই নদীজুড়ে (বাংলাদেশের কর্ণফুলী) সেতু নির্মাণে আগ্রহী। ব্রহ্মপুত্রের সাথে যুক্ত ভারত-বাংলাদেশ প্রটোকল রুট ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে কার্গো জাহাজ গোমতী নদী হয়ে ত্রিপুরা এবং কুশিয়ারা নদী হয়ে আসামের করিমগঞ্জে পৌঁছেছে। সূত্র –মানবজমিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত