সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়েছে। সোমবার সকাল পৌণে ১০ টায় কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈলের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্যে দিয়ে আলোচিত এই মামলার বিচার শুরু হয়।
মামলার বাদী সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের সাক্ষ্যের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়েছে বলে জানান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম।
এছাড়া মামলার ১৫ জন আসামিকে সকালে কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়।
এর আগে গত ২৬ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণের দিন থাকলেও করোনাভাইরাস মহামারীতে লকডাউন শুরু হওয়ায় তা স্থগিত করা হয়েছিল। পরে গত ১৬ অগাস্ট আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ২৩, ২৪ ও ২৫ অগাস্ট সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করে আদেশ দেন। খবর বিডি নিউজ টোয়েন্টফোর ডটকম।
সিনহা হত্যার বিচার শুরু
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় গত ২৭ জুন, ১৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিল আদালত।
আসামিরা হলেন: পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, মোহাম্মদ মোস্তফা, এপিবিএন এর তিন সদস্য এসআই মোহাম্মদ শাহজাহান, কনস্টেবল মোহাম্মদ রাজীব ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ, টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং সাবেক এএসআই সাগর দেব।
তাদের মধ্যে প্রদীপসহ ছয় আসামির পক্ষে জামিন আবেদন করা হলেও শুনানি শেষে বিচারক তা নাকচ করেছেন।
সকালে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আসামিদের সবাইকে কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে করে আদালতে নেওয়া হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১৫ তে দায়িত্বরত সহকারী পুলিশ সুপার মো. খায়রুল ইসলাম গতবছর ১৩ ডিসেম্বর আলোচিত এ মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
গতবছর ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ।
তিন বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া রাশেদ ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন।
ওই কাজে তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ।
কক্সবাজারের পুলিশ সে সময় বলেছিল, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে।
পুলিশ সেদিন ঘটনাস্থল থেকেই সিফাতকে গ্রেপ্তার করে। পরে নীলিমা রিসোর্ট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শিপ্রাকে।
সিনহা নিহতের ঘটনায় এবং গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধারের অভিযোগে টেকনাফ থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ, যাতে সিনহা এবং তার সঙ্গে থাকা সিফাতকে আসামি করা হয়।
আর নীলিমা রিসোর্ট থেকে শিপ্রাকে গ্রেপ্তার করার সময় মাদক পাওয়া যায় অভিযোগ করে তার বিরুদ্ধে রামু থানায় মামলা করা হয়।
কিন্তু পুলিশের দেওয়া ঘটনার বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতবছর ২ অগাস্ট উচ্চ পর্যায়ের এই তদন্ত কমিটি গঠন করে। পুলিশের বিরুদ্ধে ‘বিচার বহির্ভূত হত্যার’ অভিযোগগুলোও নতুন করে আলোচনায় আসতে শুরু থাকে।
সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস ৫ অগাস্ট ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ নয় জন পুলিশ সদস্যকে আসামি করে আদালতে মামলা করলে র্যাবকে তদন্তভার দেন বিচারক।
তাদের মধ্যে সাতজন পরদিন কক্সবাজারের আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। সিনহা হত্যার ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলার তিন জন সাক্ষী এবং শামলাপুর চেকপোস্টের দায়িত্বরত আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মাকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
মামলায় গ্রেপ্তার ১৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারীরা। তাদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল ছাড়া ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
ওই ১৪ জনের বাইরে টেকনাফ থানার সাবেক এএসআই সাগর দেবকে অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ গ্রেপ্তার পুলিশ সদস্যদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনার পর কক্সবাজারের পুলিশকে নতুন করে সাজানো হয়। এসপি থেকে কনস্টেবল- প্রায় সব পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয় অন্য জেলায়।
সিনহার সঙ্গী সিফাত ও শিপ্রার বিরুদ্ধে পুলিশ মাদক আইনে যে দুটি মামলা করেছিল, অভিযোগের ‘সত্যতা পাওয়া যায়নি’ জানিয়ে সেসব মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
কী ঘটেছিল
সিনহার বোনের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, সিনহা ও সিফাত ৩১ জুলাই(২০২০) বিকালে ডকুমেন্টারির জন্য ভিডিও ধারণ করতে নীলিমা রিসোর্ট থেকে বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের রাস্তার পাশের পাহাড়ে যান। ‘ডকুমেন্টারির প্রয়োজনেই’ সিনহার পরনে তখন কমব্যাট গেঞ্জি, কমব্যাট ট্রাউজার ও ডেজার্ট বুট ছিল।
রাত ৮টা পর্যন্ত পাহাড়ে ভিডিও ধারণ করে তারা ফিরতি পথে রওনা হন এবং রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে সিনহার প্রাইভেট কার শামলাপুর চেক পোস্টে পৌঁছায়। পরিদর্শক লিয়াকতসহ পুলিশ সদস্যরা সেখানে গাড়ির ‘গতিরোধ’ করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলায়।
এজাহারে বলা হয়, সিনহা অবসরপ্রাপ্ত মেজর হিসেবে পরিচয় দিলে পুলিশ সদস্যরা গাড়ির সামনের বাঁ দিকের দরজা খুলে ‘টেনেহিঁচড়ে’ সিফাতকে বের করে নিয়ে যান। সিফাত তখন দুই হাত তুলে নিজের এবং গাড়িতে বসা সিনহার পরিচয় দেন।
“আসামিরা ওই সময় আরও ক্ষিপ্ত হয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে।”
মামলায় বলা হয়, এ সময় সিনহা গাড়ি থেকে নেমে দুই হাত উপরে তুলে বারবার নিজের পরিচয় দেন। কিন্তু পরিদর্শক লিয়াকত তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন।
“বলতে থাকেন, ‘তোর মত বহুত মেজরকে আমি দেখছি। এইবার খেলা দেখামু’। এরপর লিয়াকত টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ফোন করে নিচুস্বরে সলাপরামর্শ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে লিয়াকত ফোনে প্রদীপকে বলতে থাকেন, ‘ঠিক আছে, শালারে শেষ কইরা দিতাছি’।
“ওই সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরিদর্শক লিয়াকত সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের শরীরের উর্ধ্বাংশে কয়েক রাউন্ড গুলি করেন। গুলির আঘাতে সিনহা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে যান এবং নিজের জীবন রক্ষার জন্য ঘটনাস্থল থেকে উঠে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন অন্য আসামিরা তাকে চেপে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। লিয়াকত আলি তখন সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতে আরও এক রাউন্ড গুলি করেন।”
এজাহারে বলা হয়, “এর পরপর ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে ওসি প্রদীপ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা সিনহার শরীর ও মুখে কয়েকবার লাথি মেরে তার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হন এবং নিজের বুট জুতা দিয়ে ঘষা দিয়ে নিহতের মুখমণ্ডল বিকৃত করার চেষ্টা করতে থাকেন।”
পুলিশ সদস্যরা এ সময় মামলার সাক্ষী এবং ঘটনাস্থলের আশপাশে উপস্থিত লোকজনকে ‘অস্ত্র উঁচিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে’ সেখান থেকে তাড়িয়ে দেন। এরপর রাত পৌনে ১২টার দিকে সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে উল্লেখ করা হয় মামলায়।