চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ১৯৮১ সালের ৩০ মে সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান। এ মামলাটি কোর্ট মার্শালে বিচার হয় এবং ১২ সেনা কর্মকর্তার ফাঁসির আদেশ হয়। কোর্ট মার্শালের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে সাজাপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তারা হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন। ওই রিট পিটিশন মামলা শুনানি হয় বিচারপতি ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি লতিফুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে। কিন্তু ওই মামলার শুনানিতে তখনকার সেনাপ্রধান হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের ভয়ে সন্তস্ত্র ছিলেন বিচারপতিরা। ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাতে-বিরাতে তাদের ফোন করা হতো। নিরাপত্তার কারণে তাদের বাড়িতে পুলিশ প্রহরা বসানো হয়। কিন্তু তারপরও ভয় কাটেনি বিচারপতিদের। ভয়ে রাতে তারা ঘুমোতে পারতেন না। বেডরুম ছেড়ে ঘুমোতেন অন্যঘরের মেঝেতে। এমনই এক ভীত সন্তস্ত্র পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের মনে। বিচারপতি লতিফুর রহমান পরে প্রধানবিচারপতি ও পরবর্তীতে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন।
বিচারপতি লতিফুর রহমান তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ, তত্বাবধায়ক সরকারের দিনগুলো ও আমার কথা’বইয়ে এ নিয়ে বিষদ লিখেছেন। সেখানে লিখেছেন,” আমি তখন লালমাটিয়ায় আমার নিজের বাড়িতে থাকি। হঠাৎ ঢাকার পুলিশ হেড কোয়ার্টাস থেকে ফোন করে আমাকে বলা হয় যে, আজ মধ্যরাত থেকে আমার বাসায় পুলিশ প্রহরা মোতায়েন করা হবে। সরকারের তরফ থেকে নিরাপত্তার জন্য এ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আমি একজন অস্থায়ী বিচারক হিসেবে একটু বিব্রতবোধ করতে লাগলাম। প্রত্যেক আসামির জন্য একজন করে উকিল নিয়োগ করায় শুনানি দীর্ঘায়িত হতে থাকল। ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, ড: জহির, সিরাজুল হক, আরও অনেকেই মামলার আইনজীবী নিযুক্ত ছিলেন। মামলা দুদিন চলার পর হঠাৎ বিচারপতি এ টি এম আফজাল এ মামলার অগ্রগতি জানার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করলেন এবং মত প্রকাশ করলেন যে, মামলাটি একটু দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করলে ভাল হয়। এতগুলো লোকের জীবন মরণের বিষয় এবং এতো আইনজীবী নিয়োজিত হয়েছে এ মামলায় স্বাভাবিকভাবে তার শুনানি একটু বিলম্বিত হবে। বিচারপতি আফজালের কথাতে আমি বুঝতে পারলাম যে, মেজর জেনারেল হোসেন মো: এরশাদ , যিনি সেনা প্রধান ছিলেন ,তিনি এ মামলাটি ত্বরান্বিত করার জন্য আফজালকে অনুরোধ করেছিলেন এবং আফজাল তার মনোভাব আমাকে জানালেন। বিচারপতি আফজাল বিশেষ ভদ্রলোক। তিনি সাধারণত এসব ব্যাপারে কাউকে অনুরোধ করার ব্যক্তি নন। তবে পরিস্থিতি নিশ্চয় খারাপ ছিল। বিশেষ করে আমার ব্যাপারে বিশেষ কোনো অসুবিধা ছিল। সেজন্য বন্ধু হিসেবে তিনি শুধু মামলাটি সত্বর নিস্পত্তি করার জন্য অনুরোধ করেন। তা ছাড়া রাত্রে ২/১টি টেলিফোন আসত। আমাকে ভয় দেখিয়ে বলা হত, মামলা দ্রুত করার জন্য। ইংরেজিতে আমাকে টেলিফোনে যেভাবে বলা হত, তাতে এ কথাগুলো ক্যান্টনমেন্টের কোনো সেনাকর্মকর্তা বলছেন বলে আমার ধারণা হল। আমি লালমাটিয়ায় আমার বাসায় সাধারণত যে বেডরুমে ঘুমাতাম, সে বেডরুম পরিবর্তন করে অন্য ঘরের মেঝেতে শুয়ে থাকতাম। আমি ও আমার বাসার সকলেরই একটু ভয় ভয় লাগত। সিনিয়র বিচারপতি ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী আমাকে জানান যে, তিনিও এরকম ফোন পেতেন। মামলা দ্রুত নিস্পত্তি করার জন্য ছুটির দিনেও আমরা কোর্ট করতাম।
এ মামলায় ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালে ১২ জন সেনাকর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এ রিট মামলার মোটামুটি বক্তব্য ছিল যে, সেনাকর্মকর্তাদের মানবাধিকার লংঘন করে কোর্ট মার্শালে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু কোর্টমার্শাল আইনগতভাবে গঠিত হয়েছে বলে এটর্নি জেনারেল কে. বাকের আমাদের সামনে বক্তব্য পেশ করেন। তিনি বক্তব্য উপস্থাপন করেন যে, সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের ৫ উপঅনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোর্টমার্শাল প্রতিরক্ষা শৃংখলা বাহিনী সংক্রান্ত আইনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের রিট মামলা দাখিল করার কোনো এখতিয়ার নেই। তা ছাড়া এটর্নি জেনারেল বক্তব্য পেশ করেন যে, জেনারেল কোর্ট মার্শাল সঠিকভাবে গঠিত হওয়ায় আইনগত ও কার্যবিধিগত কোনো দোষ বিচার করার ক্ষমতা আমাদের নেই। দুপক্ষের বক্তব্য শ্রবণ করে আমরা মামলার রায় প্রদান করলাম যে ,ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের বিচার আমাদের কোর্টের এখতিয়ার বিহর্ভূত। আমার সিনিয়র জজ বিচারপতি ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী আমাকে এ মামলার রায় লেখার জন্য বললেন এবং আমার লেখা ছোট রায়টি উনি কোর্টে পড়ে শুনান । এভাবে মামলাটি খারিজ করলাম। পরবর্তীতে সুপ্রিমকোর্ট আমাদের রায় বহাল রাখে।