ঢাকা   মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১   সন্ধ্যা ৬:০৪ 

সর্বশেষ সংবাদ

পাকিস্তানী মানবাধিকার কর্মী কারিমা বালুচকে হত্যার নিন্দায় ঢাকায় বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সমাবেশ

কানাডায় নির্বাসিত পাকিস্তানের নারী মানবাধিকার কর্মী কারিমা বালুচকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার প্রতিবাদ এবং বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। মঞ্চের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো: আল মামুনের সঞ্চালনায় উক্ত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। আরোও বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ভাস্কর শিল্পী রাশা, কবি সরদার ফারুক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনেট মাহমুদ, ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার সভাপতি মিলন ঢালী, সাধারণ সম্পাদক দ্বীন ইসলাম বাপ্পীসহ নেতারা।
সমাবেশে সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, “কানাডায় নির্বাসিত নারী মানবাধিকার কর্মী কারিমা বালুচকে পাকিস্তানি আইএসআই হত্যা করে প্রমাণ করেছে যে, পাকিস্তান সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষক। বেলুচিস্তানের গণহত্যা বন্ধ করতে হবে। বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষদের প্রতি আমরা সংহতি জানাচ্ছি। কারিমা বালুচ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।”
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আল মামুন বলেন, “বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও সংগ্রামের পাশাপাশি বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মৌলিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। কানাডায় নির্বাসিত পাকিস্তানের নারী মানবাধিকার কর্মী কারিমা বালুচকে পাকিস্তানের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। উক্ত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। পাশাপাশি বেলুচিস্তান মুসলিমদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আমরা সংহতি জানাচ্ছি। বেলুচিস্তানের মানুষের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অত্যন্ত যৌক্তিক। পাকিস্তান সরকারের উচিত অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধ করে বেলুচিস্তানকে তাদের স্বাধীনতা প্রদান করা।

সম্প্রতি কানাডায় নির্বাসিত নারী মানবাধিকার কর্মী কারিমা বালুচকে হত্যার মধ্যে দিয়ে পাকিস্তান নিজেদেরকে সন্ত্রাস ও জঙ্গীদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। বেলুচিস্তানে মুসলিম গণহত্যা ও মানবাধিকার কর্মী কারিমা বালুচকে হত্যার অপরাধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্যাতন কতটা নিষ্ঠুর কতটা বর্বর কতটা অমানবিক ও নির্মম হতে পারে, বাঙালি জাতিই সম্ভবত: তা সর্বাপেক্ষা বেশী জানে। সেই ১৯৪৭ এর আগস্ট থেকে শুরু করে ১৯৭১ এর তাদের রাজত্বের শেষ দিনটি শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত আমরা তা দেখেছি। তার উপযুক্ত জবাবও বাঙালি জাতি দিয়েছে ২৩ বছর ব্যাপী ওই শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে নিয়মতান্ত্রিক পথে জনজীবনের নানা দাবীতে, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ন্যায় সঙ্গত দাবীতে তীব্র গণ আন্দোলন চালানোর ফলে হাজার হাজার বাঙালী তরুণ-তরুণীদের বিনাবিচারে অনির্দিষ্টকাল ধরে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে-তাদের অনেকের পরিবার পরিজনের আর্থিক জীবন ধ্বংস করে অনাহারে মৃত্যু বরণ করতে বাধ্য করেছে, একের পর এক সংবাদপত্রকে স্বাধীন মত প্রকাশের দায়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তাদের ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দীর্ঘদিন পাকিস্তান সরকার দমন-নিপীড়ন চালিয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ৩০ লক্ষ শহীদ হয়েছিল এবং দুই লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিকট বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ এর দাবি, অবিলম্বে কানাডায় নির্বাসিত নারী মান
ভাস্কর শিল্পী রাশা বলেন, “১৯৪৮ এ ভাষা আন্দোলনের পর (শুধুমাত্র মাতৃভাষার উপযুক্ত মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংঘটিত ঐ আন্দোলন) শত শত ছাত্র যুব কর্মীকে বিনাবিচারে কারাগারে আটক করে রাখা হয়েছিল -১৯৫২ সালে ঐ আন্দোলন অধিকতর তীব্রতা অর্জন করলে ঢাকার রাজপথে মিছিলরত শান্তিপূর্ণ সুশৃঙ্খল আন্দোলন কারীদেরকে নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করার মর্মান্তিক ঘটনাও তারা ঘটিয়েছিল। ১৯৭১ এর নয় মাস ব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও তাদের বাংলাদেশী দোসর রাজাকার আলবদর আলশামসরা মিলে যে ভয়াবহ গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অপহরণ, লুটপাট চালিয়েছিল তা এক নজির বিহীন ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। তাই পাকিস্তানী সরকার ও সেনাবাহিনীর হাত রক্তরঞ্জিত, তাদের মন ও আচরণ নিষ্ঠুর। সেদিন জানতাম, বাঙালিদেরকেই শুধুমাত্র তারা তাদের শত্রু মনে করে। আজ আমরা জানতে পারছি-না, তা নয়। পাকিস্তানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সকল জাতিসত্তাকেই সেখানকার পাঞ্জাবী শাসক ও শোষকগোষ্ঠী একই দৃষ্টিতে দেখে এবং তাদের প্রতি তাদের ব্যবহারও সমপরিমাণ নিষ্ঠুর। পাকিস্তানের অন্যতম ক্ষুদ্র প্রদেশ বেলুচিস্তানের মানুষেরা যাদের মাতৃভাষা বালুচ- দীর্ঘ দিন যাবত পাকিস্তানের পাঞ্জাবী বাহিনীর হাতে অনুরূপ নিষ্ঠুরতার যন্ত্রণায় ভুগছেন।

বেলুচিস্তানের মানুষ অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন, প্রগতিশীল এবং ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারী। তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেও নানাভাবে সমর্থন জানিয়েছিল। বেলুচিস্তান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল-তাই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন তাদের ওপর অনেক বেশী।
সিন্ধু ও পাখতুনিস্তান ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিল তখন বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশে পাখতুনিস্তান। বেলুচিস্তানের অল্প কিছু লোককে পাকিস্তানের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই জঙ্গীপনায় উদ্বুদ্ধ করেছে, প্রশিক্ষণ দিয়ে সশস্ত্র করেছে এবং সেখানকার সকল প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। ফারজানা মজিদ ও মামা কাদির কোয়েটার শহর থেকে ইসলামাবাদের জাতিসংঘ কার্যালয় পর্যন্ত এক লংমার্চে নেতৃত্ব দেন। তাঁদের দাবী গুম হয়ে যাওয়া বেলুচদের উদ্ধারে পাকিস্তান সরকারকে বাধ্য করতে জাতিসংঘের নজরে দাবিটি উত্থাপন করা। ফায়জানার ভাই স্বয়ং কয়েক বছর যাবত গুম হয়ে আছে এবং অন্তত: আরও ২০,০০০ বেলুচির জীবনে একই অত্যাচার নেমে এসেছে। তাঁরাও গুম। এদের মধ্যে ৬,০০০ বেলুচকে পরবর্তীতে হত্যা করা হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে এবং তাদের দেহ হেলিকপ্টার যোগে নিয়ে অজানা স্থানে পুঁতে রাখা হয়েছে। খনন করা হয়েছে গণকবর। এমন কি এব্যাপারে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য প্রকাশ হলে জানা গেল যে, বিচারপতিরা এই “ঘটনাকে বাধ্যতামূলক নিরুদ্দেশ বা অপহরণ” বলে উল্লেখ করলেও সরকার তাদের উদ্ধারে বিন্দুমাত্র পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তাদের লংমার্চ ছিল সুবিচার, স্বাধীনতা ও প্রিয়জনদের উদ্ধারের দাবি সম্বলিত এবং যাদেরকে গুম করা হয়েছে তাদের পরিবার-পরিজনরাই ছিলেন ঐ লংমার্চের আয়োজক। আক্ষরিক অর্থেই হাজার হাজার বেলুচ রাজনৈতিক নেতাকর্মী মানবাধিকার কর্মী বেলুচ বেসামরিক জনগণ ও সাধারণ সচেতনর নাগরিককে নিরাপত্তা কর্মীরা, জঙ্গিরা এবং জিহাদ পন্থীরা যারা পাকিস্তান-অধিকৃত বেলুচিস্তানের অধিবাসী তাদের বিরুদ্ধে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
এই জাতীয় অপহরণ প্রক্রিয়া বেলুচিস্তানে চালানো হচ্ছে ১৯৪৮ সাল থেকে যখন শাসকগোষ্ঠী নিষ্ঠুরভাবে বেলুচিস্তান দখল করে নেয়।”
কবি সরদার ফারুক বলেন, “বেলুচ জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করতে ধর্মীয় উগ্রবাদী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং সন্ত্রাসীরা সম্মিলিত ভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে আসছে। তাদেরকে যেন লাইন্সে দেওয়া হয়েছে যখন খুশী যে কোন বালুচকে মারতে, মারতে, খুন করতে, ধর্ষণ করতে কোন বাধা নেই। বেলুচিস্তান গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তানের পরিকল্পনা দিন দিন প্রকাশিত হচ্ছে। সেখানে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এখন সে দেশের সংবাদ মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী গত ছয় বছরে বেলুচিস্তান থেকেই প্রায় ১,০০০ মানুষের গুলিবিদ্ধ দেহ উদ্ধার হয়েছে। যেগুলি অধিকাংশই ছিন্নভিন্ন। তার মধ্যে ৫১% বেলুচ, ২২% পাখতুন। পাঞ্জাবী আফগান শরণার্থীদের দেহও মিলেছে । অনেক মৃত দেহই শনাক্ত করা যায় নি। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ রুখতে গত বছর একটি জাতীয় কর্মসূচী গ্রহণ করে ইসলামাবাদ। সেই কাজে নিযুক্ত জনৈক আধিকারীকই সমীক্ষাটি সামনে এনেছেন। দেখা গিয়েছে বেলুচিস্তানের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৯৪০ টির বেশী মৃত দেহ উদ্ধার হয়েছে। ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কয়েকটা জেলা থেকে উদ্ধার হয়েছে ৩৪৬ টি দেহ – নিখোঁজ ১১২ জন। ২০১১ সালে এলাকা নিয়ে অশান্তির জেরে পরিকল্পনা মাফিক ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। তাতে এখন পর্যন্ত১৮৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে – গত কয়েক বছরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে আহত হন প্রায় ৪,০০০।বেলুচিস্তান থেকে গত কয়েক বছরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত ৪৯ টি দেহ উদ্ধার হয়েছে – পাখতুন ১৫৯ – কালটি থেকে ২৬৮ টি দেহ উদ্ধার করা গেছে। ১৭৫ টি দেহ সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এমন ভয়াবহ নির্মমতা চালাচ্ছে পাকিস্তানের পাঞ্জাবী সেনা ও মৌলবাদীরা। বেলুচরা বলছেন ১৯৭১ এ পাক বাহিনী বাঙালীদের উপর যেমন অত্যাচার চালিয়েছিল আজ পাঞ্জাবীরা তাঁদের উপর তেমনই অত্যাচার চালাচ্ছেন। তারা ছাত্র, আইনজীবী, শিক্ষক এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন নেতা-কর্মীরাই মূলত: এই হত্যালীলার শিকার কয়েকটি দশক যাবত।
ফলে প্রতিবাদ স্বরূপ ফারজানা অন্যান্য হাজার হাজার মানুষ ইতিহাসের লং মার্চ অভিযান চালান কোয়ের্টার শাল এলাকা থেকে শুরু করে বেলুচিস্তানের রাজধানী । যেখান থেকে সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী করাচী এবং করাচী থেকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ পর্যন্ত দীর্ঘতম পথ তাঁরা পদযাত্রায় অতিক্রম করেন শুধুমাত্র ঐ অত্যাচারের অবসানের দাবীতে। পাকিস্তানী মিডিয়ায় তা তেমন একটা প্রকাশ করতে দেওয়া হয় নি। এমনকি, পাকিস্তানের যে সকল বুদ্ধিজীবীরা ঐ আন্দোলন কারীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন তাঁদেরকেও রেহাই দেয়া হয়নি। অত্যাচার আজ নির্মমতার ভয়াবহতম পর্যায়ে পৌঁছেছে।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সবচেয়ে আলোচিত