বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মামুনুল হক ও চরমোনাই পীর ফয়জুল করীম কর্তৃক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধের হুমকির প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে প্রতিবাদ সমাবেশ ও কুশপুত্তলিকা দাহ শেষে বিক্ষোভ মিছিল করেছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।
শনিবার বিকেলে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো: আল মামুনের সঞ্চালনায় প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বক্তব্য রাখেন ভাস্কর শিল্পী রাশা, গৌরব৭১ এর সাধারণ সম্পাদক এফএম শাহীন, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনেট মাহমুদ, ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার সভাপতি মিলন ঢালীসহ নেতারা। প্রায় এক ঘন্টা শাহবাগ অবরোধ করে রাখে সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
প্রতিবাদ সমাবেশে ভাস্কর শিল্পী রাশা বলেন, “সৌদিআরব, ইরানসহ বিশ্বের সব মুসলিম দেশে ভাস্কর্য রয়েছে। জাতির পিতার ভাস্কর্য অপসারণের দাবি যারা তুলেছে, সেই মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ না নিলে আমরা দেশ ও জাতির ‘সমূহ বিপর্যয়ের’ আশঙ্কা প্রকাশ করছি। আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মুজিববর্ষ উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনে বাধা প্রদান এবং স্থাপিত ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার ভয়ঙ্কর হুমকি দিয়েছে চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি।বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতাকারীরা কখনোই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী এহেন বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সংবিধান লঙ্ঘন করে জাতির পিতাকে অবমাননা করা হয়েছে। এদেরকে অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।”
মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো: আল মামুন বলেন,
“গত ১৩ নভেম্বর করোনাকালীন যাবতীয় বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে তারা যেভাবে গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলার মাঠে সমাবেশ করেছে এবং যে ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি বিষেদগার করেছে, তা রাষ্ট্রদ্রোহিতাতূল্য অপরাধ হলেও এখন পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে সরকারি ব্যবস্থা কিংবা সরকারদলীয় কোনো প্রতিবাদ আমাদের নজরে পড়েনি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কোন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানায়নি। আওয়ামী লীগের নীরবতা আমাদেরকে ব্যথিত করেছে। জাতির পিতার অবমাননাকারী ধর্ম ব্যবসায়ী মামুনুল হক ও ফয়জুল করীমকে দ্রুত গ্রেফতার করলে আমরা ধরে নিবো আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছে। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা পিতাদের ন্যায় একাত্তরের পরাজিত অপশক্তিদেরকেও আমরা রাজপথেই মোকাবিলা করবো। একাত্তরের পরাজিত অপশক্তির দোসররা তৌহিদী জনতার ব্যানারে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্র চলমান রেখেছে। লালমনিরহাট, কুমিল্লার মুরাদনগরের ঘটনা ও সম্প্রতি ধর্ম ব্যবসায়ী মামুনুল হকের বক্তব্য একই সূত্রে গাঁথা। ইসলাম শান্তির ধর্ম। কেউ অপরাধ করলে দেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার হবে। দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। লালমনিরহাটে সহিদুন্নবী জুয়েল নামে এক মুসলিমকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে যা সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী। কোন ধর্মই সহিংসতা ও মানুষ হত্যা সমর্থন করে না। ধর্মের নাম ব্যবহার করে এই উগ্রবাদী গোষ্ঠী দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এদের মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা। সকল ধর্মের মানুষদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করা প্রত্যেকটি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। ধর্মীয় সভাগুলোতে উস্কানিমূলক অপপ্রচার চালিয়ে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। এহেন কর্মকাণ্ড কখনোই বরদাশত করবে না মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। ধর্মীয় উগ্রবাদ শক্ত হাতে দমন করতে হবে। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী দণ্ডপ্রাপ্ত দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে বলে গুজব ছড়িয়ে যারা নাশকতা করে মানুষ হত্যা করেছিলো সেই মৌলবাদী অপশক্তিই সম্প্রতি ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এরা ইসলামের শত্রু। এরা কখনোই ইসলাম ধর্মের আদর্শ ধারণ করে না। ধর্মীয় লেবাশে রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্র করাই এদের মূল উদ্দেশ্য। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে এরা জঙ্গিবাদ রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। এরা দেশ ও জাতির শত্রু। একাত্তরের পরাজিত অপশক্তি পাকিস্তানের দোসররা এহেন ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড দ্বারা বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ধর্মের নামে এরা অপরাজনীতি শুরু করছে। ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের আবেগকে পুঁজি করে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্যে হাসিলের চেষ্টা করছে।”
আল মামুন আরো বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবমাননাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার না করলে শাহবাগসহ সমগ্র দেশে রাজপথ, রেলপথ ও সড়কপথ অবরোধ কর্মসূচী পালন করবে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।আমরা লক্ষ্য করছি, করোনা সংকটেও কিছু ধর্মীয় লেবাশধারী দেশে করোনা নেই বলে প্রতিনিয়ত গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষদের জীবনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিভিন্ন মাদ্রাসায় গত এক মাসে প্রায় ২৪ জন শিশু বলাৎকারের শিকার হয়েছে এবং ইতিমধ্যে ২ জন মৃত্যুবরণ করেছে। বলাৎকার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ হারাম। অথচ ইসলামী দলগুলো বলাৎকারের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করছে না। ধর্ষণের ন্যায় বলাৎকারের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন ধর্মীয় সভায় ওয়াজের নামে গুজব ছড়ানো ও উস্কানিমূলক অপপ্রচার বন্ধ করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দেশের অনেক মাদ্রাসায় জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয় না, জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয় না, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো হয়না যা দেশের সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধান বিরোধী এসব কর্মকাণ্ডই ধর্মীয় উগ্রবাদকে আরোও উসকে দিচ্ছে। মাদ্রাসাগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি দেশের ইতিহাস চর্চা বাধ্যতামূলক করতে হবে। অন্যথায় দেশপ্রেম ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কে অবমাননা করার অপরাধে মামুনুল হক ও ফয়জুল করীমকে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। অন্যথায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ সমগ্র দেশে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে।”
মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ এর (৭) সাত দফা দাবি:
১। জাতির পিতাকে অবমাননা করার অপরাধে আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে ধর্ম ব্যবসায়ী মামুনুল হক ও ফয়জুল করীমকে গ্রেফতার করতে হবে।
২। দেশের প্রতিটি বিশ্বিবদ্যালয়,কলেজ ও জেলা, উপজেলায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করতে হবে।
৩। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
৪। বিভিন্ন ধর্মীয় সভা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় উস্কানিমূলক গুজব ছড়ানো ও অপপ্রচারকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
৫। ধর্ষণের ন্যায় বলাৎকারের অপরাধে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৬। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নিপীড়ন বন্ধে মনিটরিং সেল গঠন করে নজরদারি বাড়াতে হবে।
৭। মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত জাতীয় সংগীত বাজানো, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, শহীদ মিনার নির্মাণ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে।