অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আর নেই৷
ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার সন্ধ্যায় তার মৃত্যু হয়েছে।
মাহবুবে আলমের ছেলে সুমন মাহবুব বলেছেন, সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে তার বাবার মৃত্যু হয়েছে।
মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন মাহবুবে আলম।
তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। সোমবার বেলা ১১ টায় মাহবুবে আলমের মরদেহ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি প্রাঙ্গনে নেয়া হবে। সেখানে জানাজা শেষে মরদেহ মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর জ্বর নিয়ে ঢাকা সিএমএইচে ভর্তি হয়েছিলেন মাহবুবে আলম। সেখানে নমুনা পরীক্ষায় তার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার হঠাৎ অবনতি ঘটলে গত ১৮ সেপ্টেম্বর আইসিইউতে নেওয়া হয়।
তবে সর্বশেষ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষায় ফল নেগেটিভ এসেছি।
মাহবুবে আলম ২০০৯ সালে অ্যাটর্নি জেনারেলের পদে নিয়োগ পান। তারপর মৃত্যু অবধি ওই পদে ছিলেন। পদাধিকার বলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।
অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে সর্বোচ্চ আদালতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন মাহবুবে আলম।
এছাড়া সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ ও ষোড়শ সংশোধনী মামলা পরিচালনাও করেন তিনি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মামলায়ও যুক্ত ছিলেন মাহবুবে আলম। আলোচিত বিডিআর বিদ্রোহ হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
তার এসব ভূমিকা স্মরণ করেছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।
শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, “মাহবুবে আলম বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা পরিচালনায় অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন একজন প্রথম সারির যোদ্ধা। ”
শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “তিনি একজন প্রথিতযশা আইনজীবী হিসেবে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক আইনি বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ভূমিকা রেখেছেন এবং সবসময় ন্যায়নিষ্ঠ থেকে আইনপেশায় নিয়োজিত ছিলেন, যা অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।”
মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
তিনি এক মেয়াদে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং এক মেয়াদে সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
মাহবুবে আলমের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মৌছামান্দ্রা গ্রামে।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং ১৯৬৯ সালে লোক প্রশাসনে ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি নেন তিনি।
ছাত্র জীবনে বাম আন্দোলনে যুক্ত মাহবুবে আলম পরে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সহসভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভক্তির পর রাজনীতি ছেড়ে আইন পেশায় পুরোদমে সক্রিয় হন মাহবুবে আলম।
তিনি অবশ্য ১৯৭৩ সালেই বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে তালিকাভুক্ত হয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন।
মাহবুবে আলম ১৯৭৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে এবং ১৯৮০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইন পেশা পরিচালনার অনুমতি পান। ১৯৯৮ সালে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি।
১৯৯৩-৯৪ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে ২০০১ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন মাহবুবে আলম।
২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারির আগে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন মাহবুবে আলম।
সেনা নিয়ন্ত্রিত ওই সরকার আমলে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হওয়ার পর শীর্ষ আইনজীবীদের অনেকে পিছুটান দিলেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর পক্ষে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মাহবুবে আলম।
দৃশ্যত সেই কারণেই তার উপর আস্থাবান ছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান মাহবুবে আলম। তার পর থেকে টানা ১১ বছর তিনি এ দায়িত্বে বহাল ছিলেন।
সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জ থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন মাহবুবে আলম। তবে তাকে প্রার্থী না করে অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বই চালিয়ে যেতে বলা হয়।
মাহবুবে আলম ১৯৭৯ সালে ভারতের নয়াদিল্লির ‘ইনস্টিটিউট অব কনস্টিটিশনাল অ্যান্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজ’ থেকে সাংবিধানিক আইন ও সংসদীয় প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতি বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন।
ভ্রমণপ্রিয় হিসেবে পরিচিত এই আইনজীবী দেশে ও দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশ নিতে বিভিন্ন সময় ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, হংকং, কোরিয়া ও তানজানিয়াসহ অনেক দেশ সফর করেছেন।